মুন্নাকে মনে পড়ে...
১৯৮১ সাল। গুলিস্তান ক্লাবের হয়ে সেবার পাইওনিয়ার লিগে অভিষেক হলো ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর ফুটবলারের। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে খেলেও কিশোর ছেলেটি সবার মনযোগ কেড়ে নিল। মাঠের সবাই বলাবলি করতে লাগল, 'নাহ! এই ছেলের এলেম আছে বটে, একদিন সে বড় কিছু হবে!'
সেই “বড় কিছু” হওয়ার সুযোগটা এসে গেল খুব শিগগিরই। নারায়নগঞ্জ জেলার হয়ে একটা ম্যাচে খেলার সুযোগ হয়েছিল ছেলেটির। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয় দল- কী ধার, কী ভারের বিচারে অনেক এগিয়ে। বড় উপলক্ষে নিজের জাতটা চিনিয়েছিল সেই ছেলে। ম্যাচ শেষে তখনকার বাফুফে সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, এই ছেলে একটা “গোল্ডমাইন”। খুব তাড়াতাড়িই ওকে জাতীয় দলে দেখা যাবে ।
সেই শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানো নয়। মোনেম মুন্না নামের সেই ফুটবলার মাতিয়েছে ঢাকা। ১৯৮২ সালে শান্তিনগরে নাম লেখা, পরের বছরই ১৫ বছর বয়সী মুন্নার অভিষেক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়ে। আজকের এই নামজাদা দলটি তখন খেলত দ্বিতীয় বিভাগে। অভিষেকের বছরেই দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠে প্রথম বিভাগে।
তিন বছর পরই আবার ক্লাববদল। এবার নতুন ঠিকানা ব্রাদার্স ইউনিয়ন। সেই সাথে আজকে আমরা যেটাকে প্রিমিয়ার লিগ বলি, সেটাতেও অভিষেক হয়ে যায় মুন্নার । এখানেও অবশ্য খুব বেশিদিন থাকেননি। পরের বছর পাড়ি জমান আবাহনীতে। এই আবাহনীর আকাশী-নীল জার্সিতেই পরে মুন্নাকে চিনেছে বাংলাদেশ। আবাহনী ও মুন্না- এরপরের ১১ বছর নাম দুইটি হয়ে ছিল সমার্থক।
আবাহনীকে সম্ভাব্য সব শিরোপাই এনে দিয়েছেন। তবে ঠিক সাফল্যের খতিয়ান দিয়ে মুন্নাকে যাচাই করাটা অসম্ভব। মুন্না ছিল এক মাদকতার নাম, দুর্নিবার এক আকর্ষণের নাম, যে চুম্বকের টানে মানুষ পিলপিল করে মাঠে ছুটে যেত। “ক্যারিশাম্যাটিক” কথাটার জন্মই যেন হয়েছিল তার জন্য। আবাহনী-মোহামেডান মানেই ছিল তখন রুদ্ধ্বশ্বাস উত্তেজনা, ম্যাচের আগেই সাজ সাজ রব। একদিকে আসলাম, মুন্না, রুমি; অন্যদিকে কায়সার হামিদ, সাব্বির – তখন মানুষ যেন বুঁদ হয়ে ছিল ফুটবলে। ১৯৯৪ সালে রেকর্ড ২০ লাখ টাকা দিয়ে আবাহনী চুক্তি করেছিল মুন্নার সাথে। সেই যুগে ২০ লাখ টাকা, তাও আবার একজন ডিফেন্ডারের জন্য, ভাবা যায়? মুন্না নিজেকে কোন চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভাবুন!
এর মধ্যেই ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়ে যায় মুন্নার। বিশ্বস্ত পায়ে জাতীয় দলের রক্ষণ সামলে গেছেন সবসময়। মুন্নার নেতৃত্বেই ১৯৯৫ সালে মিয়ানমার থেকে চার জাতির টুর্নামেন্ট 'মারদেকা কাপ'-এর শিরোপা জেতে। দেশের বাইরে সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা জয়। আর অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুন্নাই।
তবে বাকিদের চেয়ে মুন্না নিজেকে আলাদা করে রেখেছিলেন আরেকটা জায়গায়। এপার বাংলার মতো মাতিয়েছিলেন ওপার বাংলাও। ১৯৯১ সালে ইস্টবেঙ্গল কোচ নঈমুল মুন্নাকে কলকাতার ক্লাবটির হয়ে খেলার প্রস্তাব দেন। কলকাতায় গিয়ে যেন আক্ষরিক অর্থেই “এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন”। টানা দুই মৌসুম ক্লাবকে শিরোপা এনে দেন। কলকাতার ঘরে ঘরে তখন মুন্না নামটা হয়ে উঠেছিল ভীষণ জনপ্রিয়। মাঠে এতোটাই দাপটের সাথে খেলতেন, সমর্থকরা তাকে আদর করে নাম দিয়েছিল “কিংব্যাক”।
খেলা ছাড়ার পরে জড়িয়ে ছিলেন ফুটবলে। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে ক্লাবকে অনেক সাফল্যও এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তি খুব বেশিদিন তাকে জড়িয়ে থাকতে দিল না। ২০০০ সালের দিকে কিডনিতে জটিলতা ধরা পড়ে মুন্নার। সেই রোগটা তাড়া করে বেরিয়েছে সবসময়ই। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে চিরবিদায় নেন “কিংব্যাক”। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন অন্যলোকে পাড়ি জমান মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।
মুন্না আজ নেই, কিন্তু ঢাকার মাঠের প্রতিটি ঘাসের ডগায় রয়ে গেছে তার স্মৃতি। আজও আকাশী-নীল জার্সি পরে মাঠে নামে আবাহনী। কে জানে, অন্যলোক থেকে হয়তো সেটা দেখেন মুন্না!