• ক্রিকেট

সাটক্লিফের বীরত্ব অথবা এক অজানা কল অফ ডিউটির গল্প

পোস্টটি ১৬৮৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

“ইট ওয়াজ আ গ্রেট অ্যান্ড গ্লোরিয়াস ভিক্টরি, আ স্টোরি এভ্রি নিউজিল্যান্ড বয় শ্যুড লার্ন অ্যাট হিজ মাদার’স নি।”

— ডিক ব্রিটেন্ডেন। নিউজিল্যান্ডের প্রখ্যাত ক্রিকেট রাইটার।.

 

সময়টা ১৯৫৩ সাল।

টেস্টে নিউজিল্যান্ডের অভিষেক হয়েছিলো প্রায় দুই দশক। এই দুই দশকে তারা যে ২৭টি টেস্ট খেলেছিলো, জিততে পারেনি তার একটিতেও। এই অবস্থায় ৫ ম্যাচের এক সিরিজ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আসলো নিউজিল্যান্ড।

প্রথম টেস্টে নিউজিল্যান্ডকে ইনিংস ও ৫৮ রানের ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে গেলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হলো জোহানেসবার্গে, বক্সিং ডে টেস্ট ছিল সেটা। টেস্ট শুরু হলো ক্রিস্টমাসের আগের দিন, ২৪ ডিসেম্বরে। জোহানেসবার্গের পিচ ছিল সিমারদের স্বর্গরাজ্য। প্রথমদিনের খেলা যখন শেষ হলো দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ৮ উইকেটে ২৫৮ রান। পরেরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ২ উইকেট ফেলে দিতে পারলেই খেলা শেষ এটা ভেবেই হয়তো ড্রেসিংরুমে ফিরলেন নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রা।

পরেরদিন ক্রিস্টমাসের জন্য একদিন বন্ধ থাকলো খেলা। ক্রিস্টমাসটা টিম হোটেলেই উদযাপন করলেন সবাই। ২৬ তারিখ ঘুম ভাঙলো দুঃসংবাদে।

“ট্রেন দুর্ঘটনায় নিউজিল্যান্ডে মারা গেছে ১৫১ জন। সেই ১৫১ জনের মধ্যে একজন নিউজিল্যান্ডের বোলার বব ব্লেয়ারের প্রেমিকা এবং বাগদত্তা নেরিসা লাভ।”

নিজের দেশে এইরকম একটা দুর্ঘটনার পরে কারোরই আর খেলার ইচ্ছে ছিল না। তারউপরে দুর্ঘটনায় নিহতদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি তখনো। খেলা আর হবে কিনা এ নিয়েই যখন অনিশ্চয়তা তখন নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন জিওফ্রে র‍্যাবোন সিদ্ধান্ত নিলেন তারা খেলবেন। নিজেদের জন্য না হোক, অন্তত দেশের মানুষের জন্য হলেও। বব ব্লেয়ারকে ম্যানেজার জন কেরের সাথে রেখে মাঠে গেলো নিউজিল্যান্ড দল। নিউজিল্যান্ড পরিণত হলো ১০ জনের দলে। এদিকে বব ব্লেয়ার শূন্যচোখে রেডিও টিউন করতে লাগলেন বারবার। মাঠে নিউজিল্যান্ডের পতাকা রাখা হলো অর্ধনমিত।

খেলা শুরু হতেই আগের ২৫৮ রানের সাথে আর মাত্র ১৩ রান যোগ করেই অলআউট হয়ে গেলো দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকা থামলো ২৭১ এ।

জোহানেসবার্গের পিচ যে সিমারদের সাহায্য করছিলো আগে থেকেই। সেই পিচে এবার গোলাবর্ষণ শুরু করলেন নেইল অ্যাডক আর ডেভিড আয়রনসাইড। বিশেষ করে অ্যাডকের বলে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো ব্যাটসম্যানদের। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি একজন বোলারের গুড লেংথের বল যদি লাফিয়ে উঠে শরীরে আঘাত হানে তখন আসলে ব্যাটসম্যানদের করার কিছু থাকেও না। চোখের পলকে র‍্যাবোন আর চ্যাপেলকে হারিয়ে নিউজিল্যান্ডের স্কোর হয়ে গেলো ৯/২।

বার্ট সাটক্লিফ নামলেন এরপরে। অ্যাডকের দুটা বল ঠেকালেন। তৃতীয় বল লাফালো। হুক করতে চাইলেন সাটক্লিফ। কিন্তু বল লাফিয়ে আঘাত হানলো সাটক্লিফের কানে। কান দুভাগ হয়ে গেলো। রক্তপাত শুরু হলো অবিরামধারায়।

তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সাটক্লিফকে।

এদিকে ‘গোলাবর্ষণ’ চলতে লাগলো সমানে। ২৪ রানে পড়লো তৃতীয় উইকেট। তৃতীয় উইকেট পড়ার পরে ক্রিজে আসলেন লরি মিলার। অ্যান্ড অ্যাডক স্ট্রাইকস এগেইন। বল লাগলো মিলারের বুকে। থুথুর সাথে রক্ত নিয়ে হাসপাতালে সাটক্লিফের সাথে যোগ দিলেন তিনি।

নিউজিল্যান্ড তখন ২৪/৩। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের দুজন প্লেয়ার তখন হাসপাতালে, আর একজন হোটেলে।

কিন্তু মিলার ডাক্তারের পরামর্শ কানে না তুলে মাঠে ফিরলেন। শুরুটা করলেন তিনিই। মাঠে যখন ফিরলেন তখন ২৩০০০ দক্ষিণ আফ্রিকান দর্শক তাঁকে দেখে হইহই করে উঠলো। যেন ফিরে এসেছেন কোন দিগ্বিজয়ী বীর। ফিরে ফ্রাঙ্ক মুনির সাথে যোগ করলেন ২৪ রান। তারপর আউট হয়ে গেলেন আয়রনসাইডের বলে।

স্কোর তখন ৮১/৬। ফলোঅন এড়াতেই দরকার তখনো ৪০ রান। হাতে আছে মাত্র ২ উইকেট।

ফ্রাঙ্ক মুনি অপেক্ষা করছিলেন টনি ম্যাকগিবনের জন্য। কিন্তু এই সময় তাঁকে অবাক করে বিশাল এক ব্যান্ডেজ মাথায় দিয়ে মাঠে নামলেন বার্ট সাটক্লিফ। শোনা যায়, সাটক্লিফকে নামতে নিষেধ করেছিলেন অধিনায়ক র‍্যাবোন। সাটক্লিফের জবাব ছিলো, “স্কোরবোর্ডটা দেখো।”

মিলারকে নামতে দেখে হইহই করে উঠেছিলো পুরো স্টেডিয়াম। সাটক্লিফ ফিরে আসায় দর্শকরা উঠে দাঁড়ালো তাঁর জন্য।

সাটক্লিফের প্ল্যান ছিল খুব সাধারণ। এই সবুজ পিচে রান তোলা কঠিন।

সুতরাং, মারো।

প্রথম দুই বল একটু ঠেকালেন। তারপরেই শুরু করলেন মার। ফ্রাঙ্ক মুনির সাথে ৫৭ রানের জুটি গড়তে সময় নিলেন মাত্র ৪০ মিনিট। ফলোঅনের শঙ্কা দূর হলো নিউজিল্যান্ডের।

96748

দলীয় ১৩৮ রান থেকে ১৫৪ রানের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গেলো নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং লাইন আপে।

১৩৮ রানে গেলেন মুনি।

১৪৬ রানে গেলেন ম্যাকগিবন।

১৫৪ রানে গেলেন ওভারটন।

খেলা শেষ। নিউজিল্যান্ড ১৫৪/৯।

সাটক্লিফ দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের সাথে ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন।

কিন্তু এ কী অবাক কান্ড!!!!

বব ব্লেয়ার মাঠে নামছেন!!!!!!!!!!!!

Bob-Blair

(বব ব্লেয়ার। মাঝে, দাঁড়ানো অবস্থায়)

তাঁকে মাঠে নামতে দেখে দর্শকরা  পর্যন্ত স্তব্দ হয়ে গেলো।

বব ব্লেয়ার হোটেলে বসে রেডিওতে খেলার খবর পাচ্ছিলেন। তিনি যখন শুনলেন দলের অবস্থা, ম্যানেজারকে বললেন মাঠে যেতে চান তিনি।

সাটক্লিফ ছুটে গেলেন তাঁর কাছে।

“আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দলের এই অবস্থা শুনে আমাকে ফিরে আসতে হলো।” ভেজাকণ্ঠে উত্তর দিলেন বব।

ক্রিজে কি ড্রেসিংরুমে নিউজিল্যান্ড দলের কেউ তখন সবাই চোখ মুছছেন।

ক্রিজে ননস্ট্রাইকিংএন্ডে দাঁড়ানোর আগে গ্লাভস দিয়ে চোখমুছে নিলেন একবার বব। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজলেন।

পেলেন কি?

পড়ে পাওয়া চৌদ্দআনা চিনতে ভুল হলো না সাটক্লিফের। হিউ টেফিল্ডের এক ওভারে ৩ ছক্কা মারলেন তিনি।

এই দুজন মিলে মাত্র ১০ মিনিটে তুললেন ৩৩ রান।

শেষপর্যন্ত বব ব্লেয়ারের আউটের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সাটক্লিফের বীরত্বগাঁথা। তবে তিনি অপরাজিতই থেকে গেলেন শেষপর্যন্ত। ১০৬ বলে ৮০ রান। মাত্র ১১২ মিনিটে। দক্ষিণ আফ্রিকা পেলো ৮৪ রানের লিড।

এরপরে এই ম্যাচ নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা অলআউট হয় ১৪৮ রানে। ৮৪ রানের লিড মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ২৩৩ রানের। নিউজিল্যান্ড অলআউট হয় ১০০ রানে। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ জেতে ১৩২ রানে।

ইতিহাস বলবে সাটক্লিফের কথা। যিনি মাথায় আঘাত নিয়েও ফিরে এসে খেলেছিলেন ৮০ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস।

কিন্তু ইতিহাস কখনো বব ব্লেয়ারের কথা বলবে না। বলবে না প্রেমিকা হারানোর কি অমানুষিক মানসিক ব্যথা সহ্য করে নেমেছিলেন মাঠে।

দলকে বাঁচাতে।

শারীরিক আঘাত আমরা সবাই দেখি, দেখতে পাই বলেই আহা-উহু করি।

কিন্তু মানসিক আঘাতের কথা কেউ বলে না।

তাই সাটক্লিফ লাইমলাইটে আসলেও বব ব্লেয়ার থেকে যান নিরবে।

নিভৃতে।