ছক্কা, ফেরা, ৩৭৫, ১৫৮ এর বর্ণিল ১৮ই এপ্রিল
পোস্টটি ১১২৯ বার পঠিত হয়েছেবড়ে মিঁয়া খ্যাত জাভেদ মিঁয়াদাদের শেষ বলে ছক্কা, দক্ষিন আফ্রিকার ২২ বছরের নির্বাসন থেকে মুক্তি, ব্রায়ান লারার মহাকাব্যিক ৩৭৫ ও ব্র্যান্ডন ম্যাককালামের ৭৩ বলে ১৫৮ রানের টর্নেডো তে ধন্য হয়েছে বছরের ‘১৮ই এপ্রিল’ তারিখটি । বিভিন্ন সময়ের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে একীভূত করার একটা চেষ্টা করা যাক। কি বলেন?
বড়ে মিঁয়ার সেই ছক্কা
শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি তখন এশিয়ার দুই চির প্রতিদ্বন্ধী পাকিস্তান ও ভারত। শ্রীকান্ত ও গাভাস্কারের ওপেনিং পার্টনারশিপেই উঠে গেছে ১১৭। গাভাস্কারের সাথে ভেংসরকার যোগ দিয়ে যোগ করলেন আরো ৯৯। ২১৬ তে দ্বিতীয় উইকেটের পতন হলেও ভারত স্কোর টেনে নিয়ে যেতে পারল টেনেটুনে ২৪৫ পর্যন্ত। ১৩২ বলে ৯৪ করা সুনীল গাভাস্কার ইনিংসের সপ্তম উইকেট হিসেবে আউট হওয়ার সাথে সাথেই ঘটে ভারতীয় ইনিংসের সমাপ্তি।
জবাব দিতে নেমে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ তে সওয়ার হয়ে বসে ইমরান খানের পাকিস্তান। যক্ষের ধনের মতো করে এক প্রান্ত আগলে রাখা মিঁয়াদাদ কে ছেড়ে একে একে সবাই ফিরতে থাকেন সাঁজঘরে। এমন কি ক্যাপ্টেন ইমরান খানও যখন ‘বড়ে মিঁয়া’ কে ছেড়ে আসেন, তখনও পাকিস্তান জয় থেকে দূরে ৩৭ রান! নবম উইকেট হিসেবে জুলকারনাইনও গেলেন ২৪১ এ। আরো দরকার পাঁচ রান। হাতে কেবল এক উইকেট।
নিঃসঙ্গ লড়াই চালিয়ে গেলেও মিঁয়াদাদ রান তুলছিলেন বলের সাথে পাল্লা দিয়ে। ১১৩ বলে ১১০ রানে অপরাজিত তিনি। ইনিংসের শেষ বল। বোলিংয়ে চেতন শর্মা। দরকার চার রান। বাউন্ডারীর বিকল্প নেই। এমন বিশাল চাপ মাথায় নিয়ে জাভেদ মিঁয়াদাদ করলেন অন্যরকম এক ইতিহাস। শেষ বলে ছয় মেরে দলকে তো জেতালেনই, নিজেও হয়ে গেলেন অমুছনীয় এক ইতিহাসের অংশ।
সেই ছক্কার ভূত নাকি বহুদিন তাড়া করে ফিরেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলকে।
অবিশ্বাস্য এক কীর্তির পর এমন উচ্ছ্বাস তো তাকেই মানায়।
বাইশ বছরের নির্বাসন থেকে ম্যান্ডেলার দেশের ফিরে আসা
বর্ণবাদের বিষাক্ত থাবায় ১৯৭০ সালে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয় দক্ষিন আফ্রিকা। তারপর কত রক্তাক্ত পথ-পরিক্রমা পাড়ি দিল আফ্রিকানরা। কালো মানুষদের দীর্ঘ দিনের ক্লান্তিহীন আন্দোলনের ফসলে ম্যান্ডেলার দেশে ফিরেছিল সমতা ও সাম্য।
কেপলার ওয়েসেলরা পেয়েছিলেন নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার দূর্লভ সম্মান।
রঙিন ক্রিকেটে আগের বছরের নভেম্বরেই ফিরেছিল তাঁরা, বাকী ছিল শুদ্ধ ক্রিকেটের শুভ্র আঙিনা। সেই আঙিনায় ফিরতেই ওয়েসেলসের নেতৃত্বাধীন দক্ষিন আফ্রিকা ক্রিকেট দল একমাত্র টেস্ট খেলতে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ব্রিজটাউনে ১৮ই এপ্রিলেই শুরু হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ। আফ্রিকানদের 'প্রত্যাবর্তনের' টেস্ট ম্যাচ। বর্ণবাদ কে ঝেঁটিয়ে বিদায়ের দৃপ্ত ঘোষণার টেস্ট ম্যাচ।
মজার ব্যাপার কি জানেন? সেই ম্যাচে দক্ষিন আফ্রিকার একমাত্র ওয়েসেলস ছাড়া বাকী সবারই অভিষেক হয়েছিল। এমন কি রিচার্ডসনের ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিনজনের অভিষেকও হয়েছিল সেই ম্যাচে। নির্বাসন থেকে ফেরা প্রোটিয়ারা টানা চারদিন শাসন করার পর, শেষ দিন এমব্রোস-ওয়ালশের জোড়া তোপে টালমাটাল হয়ে, ৫২ রানে হার মানতে বাধ্য হয়।
পঞ্চম দিনে আট উইকেট হাতে রেখে ওয়েসেলসদের দরকার ছিল মাত্র ৭৯ রান। উইকেটে ছিলেন ৭৪ রানে অপরাজিত অধিনায়ক ওয়েসেলস। কিন্তু ওয়ালশের বলে লারার হাতে ক্যাচ দিয়ে সেই যে বিপর্যয়ের সূচনা করে দিলেন, দক্ষিন আফ্রিকা অল আউট হয়ে গেল ১৪৮ এ! এমব্রোস ছয়টি ও ওয়ালশ চারটি উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন।
১৮ই এপ্রিল শুরু হওয়া এই ঐতিহাসিক টেস্টের প্রথম দিনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৬২ রানে অল আউট করে দিয়ে নিজেরা উইকেট-শূণ্য অবস্থায় দিন শেষ করে ম্যান্ডেলার দক্ষিন আফ্রিকা । ১ম দিন ৯ রানে অপরাজিত থাকা অভিষিক্ত হাডসন খেলেছিলেন ১৬৩ রানের স্মরণীয় এক ইনিংস ।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে কালো-ধলো। কেউ বসেছেন, কেউ দাঁড়িয়েছেন। নেই কোনো বৈষম্য!
ব্রায়ান লারার ৩৭৫
আগের চারটি টেস্ট ম্যাচের তিনটিই জিতে সিরিজ নিশ্চিত করে ফেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একটি জিতেছে ইংল্যান্ড। ১৬ই এপ্রিল এন্টিগায় সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্ট খেলতে নামল ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
টস জিতে ব্যাটিং নিলেন ক্যারীবিয়ান দলপতি কোর্টনি ওয়ালশ। আর ১১ রানে প্রথম উইকেটের পতনের পরপর নামলেন ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা। এক রান যোগ হতেই ১২ রানে ফিল সিমন্সও তাকে ছেড়ে আসলে সঙ্গী হিসেবে পেলেন জিমি এডামসকে। ব্যস! সেখান থেকেই শুরু হলো এক মহান শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির অনন্য প্রয়াস। সেটা যে ৩৭৫ এর চূড়া ছুঁয়ে ফেলবে তখন কি কেউ ভেবেছিল? কেউ হয়তো ভেবেছিল। নইলে সে ম্যাচে ৩৯ ওভারে ১১০ রান দিয়ে উইকেট শূণ্য থাকা ফিল টাফনেল, কেন শুধু শুধু মাইক আথরটনকে বলতে যাবেন, ‘লারা যেভাবে খেলছে সোবার্সের ৩৬৫ না ভেঙ্গে যায়’!
না, অবাক কিংবা অবিশ্বাসের কিছু নেই। মহান শিল্পীরা তুলি হাতে নিলেই কখনো কখনো যেন বোঝা হয়ে যায়, ইতিহাস হতে যাচ্ছে! ফিল টাফনেলও বোধকরি তেমন কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন।
১৬ তারিখ তিনি শেষ করলেন ১৬৪ তে। ১৭ তারিখও পুরো একটা গোটা দিন চলে গেল, তিনি তখনও নট আউট। গোধূলী বেলায় মাঠ ছাড়েন ৩২০ এ, ব্যাট উঁচিয়ে দর্শক অভিবাদনের জবাব দিতে দিতে।
এলো ১৮ই এপ্রিল ১৯৯৪, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গোটা ক্রিকেট বিশ্ব রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়, লারা কি করতে চলেছেন! স্যার ব্র্যাডম্যান পেছনে পড়লেন, গুচ পেছনে পড়লেন, ওয়ালী হ্যামন্ডও পেছনে পড়লেন, হানিফ মোহাম্মদকেও টপকে গেলেন একসময় । সামনে শুধু লেন হাটন আর স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স। হাটনের ৩৬৪ অতীত হলো, স্যার সোবার্সের ৩৬৫কেও দ্বিতীয় কাতারে ঠেলে দিয়ে ক্যারীবিয়ান রাজপুত্র উঠে এলেন একদম প্রথমে। থামলেন ৩৭৫ এ, বলাই বাহুল্য চাইলে এগিয়ে যেতে পারতেন আরো বহুদূর!
'হ্যাঁ, এই ব্যাট দিয়েই তো ৩৭৫ করেছি' তাই কি বলছেন বরপুত্র?
ম্যাককালামে রাঙানো আইপিলের উদ্বোধনী
ব্রেন্ডন ম্যাককালামের এই ইনিংসটি খুব বেশী দিন আগের নয়। শাহরুখ খানের ধামাকাদার পারফর্ম্যান্সকেও মলিন করে দিয়েছিলেন, যে ইনিংসে। খেলার সাথে মেলা জুড়ে দিয়ে আইপিএল এর সূচনাতেই ললিত মোদীরা জানান দিয়েছিলেন ‘ক্রিকেটাইনমেন্ট’ নামক কিছু একটা বিশ্ব ক্রিকেটে দিতে যাচ্ছেন তাঁরা। সেজন্যেই কি না, আইপিএলের ঝলমলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মাত করলেন বলিউডের নামিদামী সুপারস্টাররা! আর তা দেখে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মনে কি জন্ম নিয়েছিল কে জানে!
নাচ-গান ছাড়াই যে ক্রিকেট কতটা ‘বিনোদন’ দিতে পারে, সেটা প্রমাণ করতেই কি না প্রথম ম্যাচেই ব্যাটটাকে ধারালো তলোয়ার বানিয়ে তা দিয়ে যেন রক্ত ঝরালেন রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বোলারদের। বেধড়ক পিটুনিতে করলেন ৭৩ বলে তখনকার রেকর্ড ১৫৮! তাও আবার অপরাজিত!
দেখুন, কেমন তলোয়ারের মতো ব্যাটখানা উঁচিয়ে ধরেছেন! যদিও তাতে রক্ত নেই একটুও, পুরোটাই পেশিশক্তির চোখধাঁধানো সৌন্দর্য্য।
আক্ষরিক অর্থেই চিন্বাস্বামীর ‘স্বামী-ই’ যেন হয়ে উঠেছিলেন ম্যাককালাম। ১৮ই এপ্রিল, ২০০৮ এ আইপিএলের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচটাকেই যে ম্যাককালাম-ময় করে তুলেছিলেন তিনি।
- 0 মন্তব্য