মেঘে মেঘে কেটে গেছে অনেক বেলা
পোস্টটি ৪০৬৭ বার পঠিত হয়েছেছেলেবেলায় আব্বু প্রায়ই আমার বয়স হিসেব করতে গিয়ে দুষ্টুমি করে আঙ্গুল দিয়ে গুনতেন ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৫... এভাবে, আর বলতেন 'বয়স তো তোর কম হলো না দেখছি! মেঘে মেঘে বেলা তো কম হয়নি রে!' কথার ভঙ্গিমায় উপস্থিত সবাই হেসে উঠতেন।
আমার মধ্যে ক্রিকেটের অমৃত সুধার বীজটা রোপণ করে দিয়েছিলেন আব্বু-ই। অফিস থেকে ইনকিলাব পত্রিকা নিয়ে ফিরতেন। ইনকিলাব পত্রিকার খেলার পাতা নিয়ে বসার আগেই জহুর এলাহীর সেদিনকার রান আব্বু নিজেই বলে দিতেন। জহুর এলাহী খেলতেন কলাবাগানের হয়ে। রানের বন্যা বয়ে দিয়েছিলেন সে বছর। ঠিক মনে নেই, কোন বছর। সম্ভবত ১৯৯৮-২০০০ এর দিকে হবে। তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রিকেটীয় আসর ছিল ঢাকা ডিভিশনের লীগ। বড় বড় তারকা খেলোয়াড়রা খেলতে আসতেন। শুনেছি, ওয়াসিম আকরাম-জয়সুরিয়ার মতো প্লেয়াররাও খেলে গেছেন এখানে।
জহুর এলাহী যে পাকিস্তানী সেটাই জেনেছি অনেক পরে, বড় হয়ে। 'কলাবাগান' সে বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কি না জানি না। প্রায়ই দেখতাম পত্রিকার পাতায় কলাবাগানের জয় আর জহুর এলাহীর রানের খবর। মোহামেডান-আবাহনী কে চিনেছি আরো পরে। আমি তখন চিনতাম কেবল কলাবাগানকেই। বিদ্যুৎ-অপি, আকরাম-নান্নুরা কে কোন দলে খেলতেন সেসব কিছুই মনে নেই। মনে আছে কেবল কলাবাগান ও জহুর এলাহী।
একটা সময় কলাবাগান কে ভুলে গিয়েছিলাম সোনারগাঁও ক্রিকেটার্সের খবর নিতাম শুধু। মোঃ আশরাফুল খেলতেন সে দলে, অধিনায়কও ছিলেন। সোনারগাঁও ক্রিকেটার্স কয়টা জিতল, কেন হারল, আর কত ম্যাচ আছে... এসব খুব আগ্রহভরে খবর রাখতাম। সম্ভবত ২০ কি ২২ পয়েন্ট নিয়ে সেবার সোনারগাঁও ক্রিকেটার্স রানার্স আপ হয়ে গিয়েছিল।
মাশরাফি'র আবাহনী তো টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মাশরাফি অফ স্পিন করতেন। ইঞ্জুরির কারণে, ফিজিওর পরামর্শে ফাস্ট বোলিং করতেন না। কিন্তু ম্যাচ প্র্যাকটিস করা দরকার। তাই দলে খেলতেন, অধিনায়কত্ব করতেন, বোলিংয়ের সময় অফ স্পিন করতেন। মাশরাফি যে 'বাই বর্ন ক্যাপ্টেন' সেটা আরো বছর আটেক আগেই প্রমাণ করেছিলেন তিনি।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কর্ণধার আ হ ম মোস্তফা কামাল সম্ভবত সেটা জানতেন। আর তাই নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, 'তোমার কিছু করা লাগবে না। তুমি আমার টিমে শুধু ক্যাপ্টেন হিসেবেই খেলো'।
মোহামেডানের জৌলুস খুব একটা দেখিনি, শুধু শুনেছি। একবার তো পিচ্চি সোহরাওয়ার্দী শুভকেই অধিনায়ক করে দিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী সবে তখন অনুর্ধ্ব উনিশে ক্যাপ্টেন্সি করে এসেছে! অনুর্ধ্ব উনিশে নেতৃত্ব দেয়া মাহমুদুল হাসানকেও বোধহয় অধিনায়কত্ব দিয়েছিল তাঁরা।
ক্লাব ক্রিকেটে সানোয়ার হোসেন কে আমার একজন লিজেন্ড মনে হয়। বিমান বাংলাদেশের হয়ে খেলতেন। বিমান মনে হয় এবারের আসরে নেই। কেন নেই জানি না!
এখনো ইন্দিরা রোড, উত্তরা, অগ্রণী ব্যাংক, ইয়ং পেগাসাস... নামগুলো কেমন যেন ঘোর জাগায়! হাবিবুল বাশার সূর্যতরুণে খেলেছিলেন সম্ভবত ২০০৮-০৯ এর দিকে। ক্লাবটার নাম সেই প্রথম শুনেছিলাম। আকরাম খানের বদৌলতে ওল্ড ডিওএইচএস এর নাম অবশ্য আরো আগেই শুনেছিলাম। স্মৃতিশক্তি প্রতারণা না করলে বলতে পারি, স্টীভ টিকোলোও খেলে গেছেন ওল্ড ডিওএইচএসে।
প্রাইম ব্যাংক, গাজী ট্যাংক, প্রাইম দোলেশ্বর, ব্রাদার্স, ভিক্টোরিয়া, পারটেক্স... কত নাম! ক্রিকেট কোচিং স্কুল বা সিসিসি ক্লাবটা কে চিনেছি অনেক পরে। শেখ জামাল, লিজেন্ড অব রুপগঞ্জ তো বলতে গেলে সেদিনই এলো!
অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। আব্বুর মতো আঙ্গুল দিয়ে গুনলেও ৯৮, ৯৯... করে করে ২০১৬, প্রায় আঠারো বছর! হ্যাঁ, ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের টুকটাক খবর রাখা হচ্ছে আঠারোটি বছর ধরে। এই আঠারো বছরে কত কি হলো, কত জন এলো-গেল, কত বদল-রুপান্তরও ঘটল। কেবল পরিবর্তন ঘটেনি এই দেশের ঘরোয়া অবকাঠামোয়! সাবের হোসেন চৌধুরী গেলেন, আলী আজগর লবি, সিনা ইবনে জামালি, মোস্তফা কামাল গিয়ে এখন নাজমুল হাসান পাপন সাহেব আছেন।
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট কে শক্তিশালী করার কথা শুনছি সেই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই। এখনো হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবে তেমন ভরসাও নেই। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের সেই জৌলুসও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বিপিএল চলে এসেছে এখন। সব জৌলুস তাই ঐ টুর্নামেন্টের জন্যেই যেন বরাদ্দ, ঠিক যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ রেখে আইপিএলের জন্য মাস দেড়েক সময় বরাদ্দ করা হয়।
মেঘে মেঘে অনেক সময় হয়ে গেছে। কূলীন টেস্ট পরিবারের সদস্য হয়েছি-ও প্রায় সোয়া একযুগ হতে চলল। আরো কত যুগ গেলে এ দেশের ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রকরা ঘরোয়া অবকাঠামোর মানোন্নয়নে নজর দেবেন? জাতীয় ক্রিকেট লীগ কে 'পিকনিক' টুর্নামেন্ট থেকে সিরিয়াস ক্রিকেটে উন্নীত করবেন? ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রকদের ঘুম ভাঙতে আরো কত দেরী, পাঞ্জেরী?
_____
- 0 মন্তব্য