• ফুটবল

ইস্তাম্বুলের অলৌকিক ঘটনা

পোস্টটি ১৭৮০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল তুরস্কের ইস্তাম্বুলে হয়।এই ম্যাচ নিয়ে শুরু থেকেই অনেক আগ্রহ ছিল।কারণ ছিল লিভারপুল।সত্তর-আশির দশকে দাপট চালানো দলটি অনেক বছর পরে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে।তার চেয়েও বড় কারণ ছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে লিভারপুলের ফর্মের অদ্ভূত বৈপরীত্য।ইংলিশ লিগে তারা হয়েছিল ৫ম, চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল হোসে মরিনহোর চেলসি ।অথচ সেই চেলসিকেই সেমিফাইনালে হারিয়ে তারা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠে।ইংলিশ লিগে প্রতিবেশী ও চিরপ্রতিদন্দ্বীএভারটনের পিছনে পড়ে ৫ম হবার কারণে পরবর্তী চ্যাম্পিয়নস লিগে না খেলাটা তাদের নিশ্চিত হয়ে যায় , যেহেতু উয়েফার নিয়মানুযায়ী ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ১ম ৪ দল চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে পারবে।তাই লিভারপুল ফাইনালে জিতলে উয়েফা কি করে সেটা দেখার আগ্রহ ছিল।

খেলার ১ম মিনিটেই ফ্রিকিক পেল মিলান এবং আন্দ্রে পিরলোর করা ফ্রিকিক থেকে পাওলো মালদিনির ভলিতে গোল!১-০! ২ বছর পর আবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবলের ট্রফি উচু করার স্বপ্ন নিজেই  দেখালেন মালদিনি।গোল খেয়েই যেন জেগে উঠল লিভারপুল।একের পর এক আক্রমণ করতে লাগল।মিলানও প্রথাগত ইতালিয়ান স্টাইলে না খেলে আক্রমণ করতে লাগল।কিছুক্ষণ পরেই লিভারপুলের হ্যারি কিউয়েল ইনজুরিতে পড়ায় বদলি হিসেবে নামেন ভ্লাদিমির স্মিসার,যিনি পরবর্তীতে ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।এরপর আক্রমণ-পাল্টাআক্রমণে ম্যাচ জমে উঠে।মিলানের শেভচেঙ্কোর একটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল হয়।৩৮ মিনিটের সময় লিভারপুলের লুইস গার্সিয়ার শট মিলানের আলেসান্দ্রো নেস্তার হাতে লাগায় লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা পেনাল্টির আবেদন জানান।কিন্তু রেফারি খেলা চালিয়ে যান এবং পাল্টা আক্রমণ থেকে মিলানের হার্নান ক্রেসপো(এককালে বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়) গোল করে ২-০ তে এগিয়ে দেন দলকে।এর ৫ মিনিট পরেই কাকার এক দুর্দান্ত পাস থেকে ম্যাচে নিজের ২য় গোল করে হতভম্ব লিভারপুলের দুর্দশা আরো বাড়িয়ে দেন ক্রেসপো।৩-০ ! কিছুক্ষণ পরেই প্রথমার্ধের খেলা শেষের বাঁশি বেজে উঠে।মিলানের বিশ হাজার সমর্থক “FORZA MILAN” লেখা ব্যানার নিয়ে চিৎকার করছে। অন্যদিকে স্তব্ধ হয়ে আছে লিভারপুলের গ্যালারি।২০ বছর পরে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবলের ফাইনালে উঠার আনন্দ মাত্র ৪৫ মিনিটেই শেষ!

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে লিভারপুল স্টিভ ফিনানের বদলি হিসাবে ডিয়েটার হামানকে নামায়।ফলে আক্রমণের ধার বাড়ে।কিন্তু মিলানও বসে ছিল না।ফ্রিকিক থেকে শেভচেঙ্কোর নেয়া দুর্দান্ত শট আরও দুর্দান্তভাবে ঠেকিয়ে দেন লিভারপুল গোলকিপার জের্জি দুদেক।কিন্তু ম্যাচে ফেরার জন্য লিভারপুলের দরকার ছিল আরও দুর্দান্ত কিছু ।পরের মিনিটেই সেটা করে দেখান স্টিভেন জেরার্ড।জন আর্ন রিসের করা ক্রস থেকে দারুণ হেডে মিলান গোলকিপার ডিডাকে পরাস্ত করেন তিনি।৩-১ !গোল পেয়ে লিভারপুলের আক্রমণের ধার আরো বেড়ে যায়। ২ মিনিট পর  স্মিসার এর দারুণ এক শটে আবারও ডিডা পরাস্ত, ৩-২!এটি ছিল ৬মাসের মধ্যে স্মিসার এর ১ম গোল। ”অল রেড” দের গ্যালারি যেন প্রাণ ফিরে পেলো !উজ্জীবিত লিভারপুল আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।২ মিনিট পরেই এর ফল পেয়ে যায় তারা। মিলানের বক্সের ভিতরে বল নিয়ে বিপজ্জনকভাবে ঢুকে পড়া জেরার্ডকে ফেলে দেন জেনারো গাত্তসো, অবধারিতভাবেই পেনাল্টি দেন রেফারি।জাবি আলন্সোর ডান পায়ে নেয়া পেনাল্টি শট ডিডা ফিরিয়ে দিলেও  বাম পায়ে নেয়া ফিরতি শটে লিভারপুলের সমতা নিশ্চিত হয়।৫৪ মিনিটে যে স্কোরলাইন ছিল ৩-০, ৬০ মিনিটে সেই স্কোর হয়ে যায় ৩-৩ !

মাত্র ৬ মিনিটে ৩ গোল খেয়ে বসা মিলান দল তারপরও আক্রমণ চালিয়ে যায়।৭০ মিনিটে তারা আবারও লিড নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু শেভচেঙ্কোর শট গোললাইন থেকে ক্লিয়ার করেন জিমি ত্রাওরে।এরপর নির্ধারিত ৯০ মিনিটে আর কোন দল গোল করতে পারে নি।খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে।

অতিরিক্ত সময়ে মিলানের আক্রমণের ধার বেশি ছিল।লিভারপুলের খেলোয়াড়দের মাঝে ক্লান্তি ভর করছিল।এরই ফলশ্রুতিতে মিলান বেশ কয়েকটা গোলের সুোগ পায়।তবে সেরা সুযোগটা আসেঅতিরিক্ত সময়ের প্রায় শেষ মুহূর্তে।শেভচেঙ্কোর শট দুদেক ফিরিয়ে আবার শেভচেঙ্কোর কাছেই ফেরত দেন, শেভচেঙ্কোর ফিরতি শট কর্ণারের বিনিময়ে রক্ষা করেন দুদেক।এর কিছুক্ষণ পরেই অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলাও শেষ হয়।

টাইব্রেকার! দুই দলই নিজেদের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি(মিলান ২০০৩ সালে এবং লিভারপুল ১৯৮৪ সালে) জিতেছিল টাইব্রেকারে।মিলান প্রথমে শট নেবার সুযোগ পায়।জের্জি দুদেকের বুদ্ধিদীপ্ত কিপিংয়ে ৪টি করে শট শেষে লিভারপুল ৩-২ এ এগিয়ে।মিলানের ৫ম শট নিতে আসলেন শেভচেঙ্কো।২ বছর আগে তাঁর নেয়া শটেই টাইব্রেকারে জুভেন্টাসকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মিলান।কিন্তু এবার শেভচেঙ্কোর শট দুদেক বাম হাতে ফিরিয়ে দিতেই “অল রেড” দের বাকি খেলোয়াড় ও স্টাফেরা দুদেকের দিকে ছুটে গিয়ে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।রাফায়েল বেনিতেজের “আন্ডাডগ”রা কার্লো আনচেলত্তির “হট ফেভারিট”দের হারিয়ে দিল! ২১ বছর পরে অ্যানফিল্ডে ফিরল চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি ! ২০ বছর আগে এই লিভারপুল সমর্থকদের অবিমৃষ্যকারিতায় “হেইসেল ট্র্যাজেডি” ঘটে, যার শাস্তি ইংলিশ ক্লাবগুলোকে প্রায় ১০ বছর ভোগ করতে হয়েছিল।সেই সমর্থকেরা আবার আনন্দের বড় উপলক্ষ পেল।৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ম্যাচ জেতার ঘটনাটি "Miracle of Istanbul"নামে পরিচিত হয়ে যায়।

এই জয়ের পরেও ইংলিশ ফুটবল ফেডারেশন তাদের ৪র্থ ক্লাব হিসেবে এভারটনকেই সুযোগ দেয় পরের বছর চ্যাম্পিয়নস লিগের বাছাইপর্ব খেলার জন্য।ফলে উয়েফা বাধ্য হয়ে লিভারপুলের জন্য নিজেদের নিয়ম পরিবর্তন করে লিভারপুলকেও বাছাইপর্ব খেলার সুযোগ করে দেয়।