• অলিম্পিক

বোল্ট এর চেয়েও "অতিমানব" পাভো নুর্মি !

পোস্টটি ২১১২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

৯.৮১ সেকেন্ড সময় নিয়ে ১০০ মিটার এ টানা ৩য় স্বর্ণপদক জয় করার পরে উসাইন বোল্ট বলেছেন- সেমিফাইনালের মাত্র ১ ঘন্টা ২০ মিনিট পরে ফাইনাল হবার কারণে তিনি কিছুটা ক্লান্ত ছিলেন বলে বিশ্বরেকর্ড করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি যদি  পাভো নুর্মি র কথা জানতেন , তাহলে বোধহয় একথা বলতেন না!

"Flying Finn" নামে পরিচিত পাভো নুর্মি  জন্ম নিয়েছিলেন ফিনল্যান্ড এর এক গরীব কাঠমিস্ত্রীর পরিবারে। তারা মাত্র ৪০ বর্গমিটার এর একটি বাসায় থাকতেন, যে বাসার সব আসবাবপত্র বানিয়েছিলেন তাঁর কাঠমিস্ত্রী বাবা।পাভো নুর্মি  ছোটবেলা থেকেই দৌড় এ আগ্রহী ছিলেন।প্রতিদিন ৬ কিলোমিটার হেটে বা দৌড়ে  সাঁতার কাটতে যেতেন এবং সাঁতার  শেষে একই দূরত্ব অতিক্রম করে ফিরে আসতেন  ! কিন্তু অল্প বয়সেই নুর্মির বাবা মারা যান এবং কিছুদিন পরেই তাঁর এক ছোট বোন মারা যায়। পুরো পরিবারটা বিপদে পড়ে যায়। তখন নুর্মি স্কুল ছেড়ে দিয়ে একটি বেকারিতে চাকরি নেন, তাঁর মা ক্লিনার এর চাকরি নেন এবং আরো কিছু রোজগারের আশায় তারা তাদের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট এর কিচেনটা ভাড়া দিয়ে নিজেরা ৫ জনের পুরো পরিবার একটা রুমে থাকেন ! বেকারিতে পরিশ্রম এর পরেও নুর্মির দৌড় এর প্রতি আগ্রহ ছিল।গরমকালে ক্রস কান্ট্রি দৌড় ও শীতকালে ক্রস কান্ট্রি স্কিইং প্র্যাকটিস করতেন নুর্মি। আরো কয়েকটা চাকরির পরে সেনাবাহিনীতে  যোগ দেন নুর্মি। এখানে তিনি বেশি  প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেতেন । ১৯২০ সালে ১৫০০মিটার,৩০০০ মিটার ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবার পর ফিনল্যান্ড এর অলিম্পিক দলে জায়গা পেলেন তিনি।

১৯২০ সালে বেলজিয়াম এর এন্টোয়ার্প এ অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়।নুর্মি ৫০০০ মিটার দৌড়ে ২য় হয়ে রূপা জেতেন।  এরপর ১০০০০মিটার দৌড় , ক্রস কান্ট্রি দৌড় এর ব্যাক্তিগত ও দলীয় ইভেণ্ট- এই ৩টিতে স্বর্ণপদক জেতেন নুর্মি।

paavonurmi_500

এই সাফল্যের ফলে তার পরিবার এর আর্থিক  অনটন দূর হয়।তাদের সেই অ্যাপার্টমেন্ট এ বিদ্যুৎ,পানির সংযোগ আসে।সেই সাথে আধুনিক আসবাবপত্রও আসে। সেই সাথে তিনি স্কলারশিপসহ লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়ে যান আবার। ১৯২৩ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে গ্রাজুয়েট হন এবং এরপর ১৯২৪ সালের অলিম্পিক এর জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। অলিম্পিক এর কিছু দিন আগে ইনজুরিতে পড়েন নুর্মি। তবে সুস্থ হয়েই দিনে ২ বার ট্রেনিং করা শুরু করেন তিনি! 

জুলাই ১০, ১৯২৪ ।  প্রথমে  ১৫০০ মিটার দৌড়ে  অলিম্পিক রেকর্ড করে সোনা জেতেন পাভো নুর্মি।এর ঘন্টাখানেক পরে ৫০০০ মিটার দৌড়ে  আবার অলিম্পিক রেকর্ড করে সোনা জেতেন  নুর্মি ! মানে ১.৫  কিলোমিটার দৌড়ানোর ঘন্টাখানেক পরে আবার ৫ কিলোমিটার দৌড়ে ১ম হলেন নুর্মি ! এবং ২ বারই অলিম্পিক রেকর্ড ! 

এর ২দিন পরে ১২ জুলাই ক্রস কান্ট্রি দৌড় এর ফাইনাল।সেদিন তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৪৫ডিগ্রি সেলসিয়াস ! ৩৮ জন প্রতিযোগীর মধ্য থেকে মাত্র ১৫ জন দৌড় শেষ করতে পারলো! যারা দৌড় শেষ করলো, তাদের মধ্যে ৮ জনকে পরে স্ট্রেচার এ  করে নিয়ে যেতে হল! প্রচন্ড গরমে অনেকে উল্টাপাল্টা দৌড়ানো শুরু  করলো! কিন্তু নুর্মি ছিলেন অবিচল। শেষ পর্যন্ত ২য় প্রতিযোগীর(তারই স্বদেশী ভিলে রিটোলা) চেয়ে প্রায় দেড় মিনিট কম সময় নিয়ে স্বর্ণপদক জিতলেন নুর্মি।এই ইভেন্টে একক ও দলীয় -এই ২টি স্বর্ণপদক জিতলেন নুর্মি!

এর পরের দিন ৩০০০মিটার দলীয় দৌড়েও ফিনল্যান্ডকে সোনা জিততে সাহায্য করলেন নুর্মি। এক অলিম্পিকেই মোট ৫ টি স্বর্ণপদক  হয়ে গেল নুর্মির।এরপর নিজের প্রিয় ইভেন্ট ১০০০০মিটার দৌড় এর পালা। কিন্তু ফিনল্যান্ড এর কর্মকর্তারা নুর্মিকে ১০০০০মিটার এ দৌড়াতে দিলেন না! কারণ তারা নুর্মির মত ফিনল্যান্ড এর "Star Performer" দের জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন, একজন চাইলেই সবকটা ইভেন্ট এ অংশ নিতে পারবে না! ক্ষুব্ধ নুর্মি নিজের দেশ এর ভিলে রিটোলাকে(যাকে তিনি ৫০০০মিটার ও ক্রস কাউন্টি-এই ২ ইভেন্টেই হারিয়েছিলেন) চোখের সামনে স্বর্ণপদক জিততে দেখলেন তাঁর প্রিয় ইভেন্ট  ১০০০০মিটার এ । দেশ এ ফিরে নুর্মি ঐ ১০০০০মিটারে বিশ্বরেকর্ড করলেন, যা টিকে ছিল প্রায় ১৩ বছর ! এই সময়ে ১৫০০মিটার,৩০০০মিটার,৫০০০মিটার এবং ১০০০০ মিটার-সবকয়টাতে বিশ্বরেকর্ড ছিলো পাভো নুর্মি র দখলে!

7a396e9b-7a9b-4f01-a5c9-c596378661b9

৪ বছর পরে ১৯২৮ সালের নেদারল্যান্ড এর আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে সেই ১০০০০মিটারেই নিজের দেশের সেই ভিলে রিটোলাকে হারিয়েই স্বর্ণপদক জেতেন নুর্মি ! তবে ৫দিন পরেই  ৫০০০ মিটারে আবার এই ভিলে রিটোলার কাছে হেরেই রূপা জেতেন নুর্মি ! এই দুটি দৌড়ের পরেই ক্লান্তি ভর করেছিল দুজনের উপরেই। তবে এই ক্লান্তি নিয়েই পরের দিন ৪ জুলাই ৩০০০মিটার স্টিপলচেজ এ  দৌড়ালেন এই দুজন।তবে ভিলে রিটোলা ক্লান্তির কাছে হেরে দৌড় শেষ করতে পারেন নি।তবে নুর্মি দৌড় চালিয়ে যান ও   ফিনল্যান্ড এরই  তৈভো লুকোলার পেছনে থেকে রূপা জিতেন !

৪ বছর পরে ১৯৩২ সালের অলিম্পিক এ  ১০০০০মিটার ও ম্যারাথন-এই ২টি ইভেন্ট এ অংশ নিতে চেয়েছিলেন নুর্মি।কিন্তু  তিনি অ্যামেচার নন-এরকম একটা অভিযোগ করে তাকে অলিম্পিক এ  অংশ নিতে দেয়া হয় নি-কারণ তখন পর্যন্ত শুধু  অ্যামেচার অ্যাথলেটদেরই অলিম্পিক এ  অংশ নিতে দেয়া হত।

পাভো নুর্মি আর অলিম্পিক এ অংশ নিতে পারেন নি।কিন্তু এর মধ্যেই যা অর্জন করেছেন, সেসব এর জন্যই অমর হয়ে থাকবেন! তবে ১৯২৪ অলিম্পিক এ  প্রচন্ড গরমের মাঝে  ক্লান্তি উপেক্ষা করে তাঁর ৫টি স্বর্ণপদক জয়ের ঘটনা অলিম্পিক এর ইতিহাসে  চিরস্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে !