স্মাইকেল, ক্যাসপার স্মাইকেল!
পোস্টটি ৩০৮২ বার পঠিত হয়েছেজীবনের সাফল্যের গল্পগুলো চাপা থাকেনা কখনোই। লক্ষ্যে পৌঁছতে তো চায় সবাই। কিন্তু টিকে থাকে ক’জন? জীবন যুদ্ধ এক-এক জনকে এক-এক রকম পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কেউ হাল ছেড়ে দেয় মাঝপথেই, কেউ শেষে এসে। লেস্টার সিটির সাফল্য আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে এই কথাগুলোই। মাহরেজের আলজেরিয়া থেকে উঠে আসা অথবা ভার্ডির কারখানায় কাজ করার গল্পগুলো তো এখন মানুষের মুখে-মুখেই। শুন্য থেকে শুরু করা লেস্টার সিটির খেলোয়াড়দের মধ্যে এমন একজন আছেন, যার শুরুটা ছিল ঠিক উল্টো। সে গল্পটা অনেকেরই অজানা।
১৯৮৬ সালে কোপেনহেগেনে জন্মের ৫ বছরের মাথায়ই তিনি বাবার সাথে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। পিতা যে তার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলরক্ষক! ওল্ড ট্রাফোর্ডের টানেলে ১০ বছর বয়সী ক্যাসপার স্মাইকেলের গোলকিপিং এর কিছু ভিডিও চিত্র আজও ইন্টারনেট ঘাটলে বের করা যায়। সোনালি চুলের ছোট্ট ক্যাসপার বাবার মতোই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলকিপারের জার্সি পরে ঠেকিয়ে দিচ্ছে স্টিভ ব্রুস অথবা পল ইনস তনয়ের পেনাল্টি কিকগুলো! তখন থেকেই বোধহয় স্বপ্নটা দেখে ফেলেছিলেন ক্যাসপার। বাবা পিটার স্মাইকেলের মতো বড় হয়েই গোলরক্ষকই হবেন তিনি।
১৯৯৯ সালের সেই ঐতিহাসিক ‘ট্রেবল’ জিতেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে বিদায় নেন পিটার স্মাইকেল। রেড ডেভিলদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই গোলকিপার এর বছর তিনেকের মাথায় পোর্তো আর আস্টন ভিলা ঘুরে নাম লেখান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটিতে। ততোদিনে ক্যাসপার স্মাইকেল সদ্য দাড়ি-গোঁফ গজান ১৬ বছরের এক বালক। পিটার স্মাইকেলের সাথে তিনিও নাম লেখালেন ম্যানচেস্টার সিটিতেই; যোগ দিলেন একাডেমির খেলোয়াড় হিসেবে! পিতার সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করার চাপটাও তখন থেকেই চেপে বসে কিশোর ক্যাসপারের কাঁধে।
তারপর যা ঘটার তাই হল! ছোট কাঁধে অতো চাপ কী সয়? বস্তি থেকে উঠে এসে বিশ্বকাপ জেতার গল্পগুলোর পেছনের ইতিহাস আমরা সবাই কম-বেশি জানি। কিন্তু আভিজাত্য আর জৌলুস থেকে শুরু যে বালকের তার জন্য তো সাফল্যের বিকল্প সাফল্যই! তাঁর জন্য নূন্যতম লক্ষ্যও বাবার কৃতিত্বের পুনরাবৃত্তি করা। তার চেয়ে কয়েকগুণ ভালো কিছু করা গেলেই কেবল তাঁকে সফল হিসেবে গোণায় ধরা হয়!
ক্যাসপার স্মাইকেলের ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম কিছুই ঘটেনি। বাবার মতোই ডেনমার্ক জাতীয় দলে খেলবেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবেন বড় কোন ক্লাবের হয়ে- শুরু থেকেই এমন সব কথা বার্ত শুনেই বড় হয়েছেন। ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার হাতেখড়িতেই সারা জীবন ধরে শুনে আসা ওইসব কথা বার্তাই প্রভাব বিস্তার করল ক্যাসপারের পারফরম্যান্সে। ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার সিটি থেকে ধারে খেলতে গেলেন বারি, কার্ডিফ, কভেন্ট্রির মতো নিচের স্তরের লিগের দলগুলোয়। আবু ধাবির শেখের টাকায় বদলে যাওয়া ম্যানচেস্টার সিটিতে তখন পরিবর্তনের জোয়ার। লিগ জয়ের লক্ষ্যে তেভেজ, ইয়া ইয়া তোরেদের মতো খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়ে চেহারাই পাল্টে ফেলেছে সিটি। সেই দলের অখ্যাত খেলোয়াড় ক্যাসপার স্মাইকেল। পিটার স্মাইকেলের ছেলে নামেই যাকে চেনে সবাই!
ক্যাসপারের সাথে চুক্তি নবায়ন না করে তাঁকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল সিটি। এখানে-ওখানে ধারে খেলে কাটানো ম্যানচেস্টার সিটি ক্যারিয়ারে নিজের ‘আসল’ ক্লাবের গোলবারের নিচে দাঁড়িছিলেন মাত্র আটবার। প্রিমিয়ার লিগের কোন দল তো কপালে জুটলই না, এমনকি দ্বিতীয় স্তরেও ঠাই হল না ক্যাসপারের। গেলেন ইংল্যান্ডের তৃতীয় বিভাগের দল নটস কাউন্টিতে। নটিংহ্যামের ক্লাবটিতে এক মৌসুম খেলে পরের মৌসুমেই আবার চ্যাম্পয়নশিপের (দ্বিতীয় বিভাগের) দল লিডস ইউনাইটেডের সাথে দু’বছরের চুক্তিতে নাম লেখালেন ‘পিটার স্মাইকেল পুত্র’। সেখনেও থিতু হতে পারলেন না। পরেরবারই ‘যাযাবরের’ মতো আবারও ক্লাব বদলালেন। বদলালেন বললে আসলে ভুল বলা হবে, বদলাতে বাধ্য হলেন। লিডস পরে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, দলের গোলকিপিং পজেশনে আরও ভালো কাউকে আনতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে ক্যাসপার স্মাইকেলকে।
ম্যানচেস্টার সিটি ও নটস কাউন্টির ম্যানেজার থাকার সময় দু’বারই সভেন গোরান এরিকসনের দলে ছিলেন ক্যাসপার স্মাইকেল। ২০১১-১২ মৌসুমে লেস্টার সিটির ম্যানেজার তখন সভেন গোরান এরিকসন। আগের দু’বারের মতো এবারও তিনি দলে নিলেন সেই ক্যাসপার স্মাইকেলকে। লিডস ইউনাইটেড থেকে তিন বছরের জন্য ফক্সদের হয়ে নাম লেখালেন স্মাইকেল। প্রথম মৌসুমেই দলের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলেন ২৫ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। পরের মৌসুমে আরও ভালো করলেন। এবার ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে ডাক পড়লো, অভিষেকটাও হয়ে গেল। ২০১৩/১৪ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় হয়ে লেস্টারের প্রমোশন পেল প্রিমিয়ার লিগে। উপহারস্বরূপ ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্যাসপারের সাথে চুক্তি নবায়ন করল লেস্টার সিটি! খেলোয়াড়ি জীবনের পঁচিশ বছর বয়সে এসে এই প্রথম টানা তিন মৌসুম এক ক্লাবে খেললেন ক্যাসপার স্মাইকেল। খাপছাড়া ক্যারিয়ারটা তখন থেকেই গুছিয়ে নেয়া শুরু করেছিলেন হয়ত।
ম্যানচেস্টার সিটি ছেড়ে তৃতীয় বিভাগের দলে নাম লেখানোর সময় প্রিমিয়ার লিগে আর কখনই না খেলতে পারার শঙ্কাটা নিশ্চয়ই জেগেছিল ক্যাসপারের মনে? বাকী জীবনটা পিতৃ পরিচয়ে ঢাকা পড়ে থাকার ব্যর্থতাটাও চোখ রাঙাচ্ছিল। প্রিমিয়ার লিগে পদোন্নতি পেয়ে ক্যাসপার হয়ত ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ ভেবে বসে থাকতে পারতেন। একসময় তো হারিয়েই যেতে বসেছিল ক্যারিয়ারটা। সেখান থেকে আবারও শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল ফেরত আসতে পারাটা তো সাফল্যই বটে!
প্রিমিয়ার লিগে এসে খবরের শিরোনামও হলেন। কিন্তু সব শিরোনামেই জড়িয়ে থাকল পিতার নামও। একরকম পরিচয় সংকটেই ভুগতে শুরু করলেন ক্যাসপার স্মাইকেল। পুরনো অপবাদ পিছু তো ছাড়লই না বরং প্রতিদিন আরও জোরালো হতে লাগল। ঘটনায় যারপরনাই বিরক্ত ক্যাসপার স্মাইকেল ওই বছর ডিসেম্বরে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তো বলেই বসলেন “ আমি জানিনা লোকজন কেন আমাকে এসে বলে আমি কখনই আমার বাবার মত হতে পারব না। আমি প্রায়ই ভাবি এবার বুঝি আর শুনতে হবে এসব। কিন্তু তা না! প্রতি মাসেই উল্টো বেড়েই চলছে এই ঘটনা”। ক্যাসপারের কথার সুরেই বোঝা যাচ্ছে তিনিও হয়ত ধরেই নিয়েছিলেন বাবার দেখান পথে হাঁটা হচ্ছে না তাঁর। শুধু ওই কথাইগুলোই কাঁটা হয়ে বিঁধছিল গায়ে। ২৯ বছর বয়সী, বিবাহিত আর দুই সন্তানের জনক কেন চাইবেন বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে?
প্রিমিয়ার লিগে প্রথম মৌসুমটা লেস্টারের জন্য ছিল টিকে থাকার লড়াই। তাতে অবদান ছিল স্মাইকেলেরও। আগের মৌসুমে অলৌকিকভাবে অবনমন এড়ানো সেই লেস্টার সিটি এখন প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ দল। আর সেই দলের গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মাইকেল। যার ওপর এরইমধ্যে নজর পড়ে গেছে বার্সেলোনার মতো ক্লাবেরও। যেন তেন গোলকিপার দিয়ে আর যাই হোক লিগ জেতা যায় না! মাহরেজ, ভার্ডিরা সব আলো কেড়ে নিতে পারেন, কিন্তু তাতে গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে দলকে নেতৃত্ব দেয়া ক্যাসপারের অবদান খাটো করা যাবে না একটুও। ক্যাসপার স্মাইকেলের নেতৃত্ব গুণটা যে বংশানুক্রমে পাওয়া!
আজ ওল্ড ট্রাফোর্ডে ক্যাসপার স্মাইকেলরা জিতে গেলে লিগ শিরোপাটাও নিশ্চিত হয়ে যাবে লেস্টারের। ছোটবেলার একটা বড় অংশই ক্যাসপারের কেটেছে ওল্ড ট্রাফোর্ডে খেলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। সেই মাঠেই প্রথমবারের মতো খেলতে নামছেন আজ। তবে বিপক্ষ দলের হয়ে। দল বদলাতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য কিন্তু বাবার মতোই! জিততে হবে শিরোপা।
চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকেট কাটতে এই ম্যাচে জয় চাই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেরও। এই ম্যাচের আগে পিটার স্মাইকেলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- কোন দলের পক্ষে তিনি? “পানির চেয়ে রক্তের ঘনত্ব বেশি, আমি চাই আমার ছেলে ওল্ড ট্রাফোর্ডেই শিরোপা জিতুক”- ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লেস্টার সিটি ম্যাচের আগে এক সাক্ষাৎকারে পেশাদারিত্বকে যাদুঘরে পাঠিয়ে ‘বাবা’ পরিচয়টা বড় করে তুললেন পিটার স্মাইকেল। ছেলের মতো বাবাও যে এতোদিন বাক্যবাণে জর্জরিত ছিলেন স্মাইকেলের এ কথায় তা অনেকটাই স্পষ্ট। সাথে পিটার স্মাইকেলের যোগ্য পুত্র শেখালেন চলার পথে লড়াই করার স্পৃহা থাকলেই হল, আজ হোক- কাল হোক সাফল্য ধরা দেবেই। আশে-পাশের মানুষের কথায় কান দিয়ে কোনোদিন আর যাই হোক মন্দ ব্যতীত অন্য কিছুই হয় না।
লেস্টারের রাতারাতি এক মৌসুমের মাঝেই এমন আমূল পরিবর্তনের খুঁটি-নাটি নিয়ে এরই মধ্যে পাতার পর পাতা লেখা হয়ে গিয়েছে; কখনও ভার্ডির রুপকথায় বা মাহরেজের বর্ষসেরা হবার কাহিনীতে, কখনও র্যানিয়েরির পিতজা পার্টি অথবা লেস্টারের সমর্থকদের নিয়ে। লেস্টার সিটির রূপকথা আসলে একটা উপন্যাস। ছোট-ছোট অনেক গুলো গল্পে ঠাসা। যেখানে একটি আরেকটির চেয়ে বেশি শিহরণ জাগানিয়া।
- 0 মন্তব্য