মেসির নিষেধাজ্ঞা ও কিছু প্রশ্ন....
পোস্টটি ২৪৬৮৫ বার পঠিত হয়েছেরেফারির উদ্দেশ্যে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করায় চার ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছেন লিওনেল মেসি। খেলা চলাকালীন এক ম্যাচ সহকারীকে উদ্দেশ্য করে স্প্যানিশ ভাষার কুখ্যাত কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। হাল আমলের টিভি সিরিজ নারকোসের মূল চরিত্র পাবলো এস্কোবারের ভাষা চর্চার কল্যাণে সেই শব্দগুলো এখন বাংলা ভাষায়ও স্থান করে নেয়ার অপেক্ষায়! 'প' বর্গের শব্দের সাথে সহকারী রেফারির মা-কে উদ্দেশ্য করেও বাজে কথা বলার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বার্সেলোনা ফরোয়ার্ডকে। ফিফার কাঠগড়ায় চার ম্যাচ নিষেধাজ্ঞার সাথে মেসিকে গুণতে হচ্ছে অর্থদন্ডও।
চিলির বিপক্ষে ৯০ মিনিটের ওই ম্যাচের পর রেফারির দেয়া রিপোর্টে এই ঘটনার কোনো উল্লেখই ছিল না। লাতিন অ্যামেরিকার ফুটবল অভিভাবক কনমিবলও তাই নিশ্চুপ ছিল সোমবারের আগ পর্যন্তও। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করছে চিলি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পাঠানো ভিডিও টেপটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে ঘটনার মোড়। সৃষ্টি করেছে বিতর্কও। ওই টেপ ঘেটেই মেসির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে কনমিবল।
আর এই ঘটনাই বেশ কয়েকটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ফিফার নীতি তথা ফুটবলকেই। রেফারির বিরুদ্ধে যে কোনো ধরণের লাঞ্ছণার বিচার হতে হবে ফুটবলের স্বার্থেই; কিন্তু তাতে স্বচ্ছতা থাকবে শতভাগ। এক্ষেত্রে প্রথমবারেই লিওনেল মেসিকে দোষী সাব্যস্ত করা গেলে বোধ হয় কোনো রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না কোনো পক্ষকেইও। রেফারির ম্যাচ রিপোর্টে এড়িয়ে যাওয়া বিষয়টি নিয়ে পরে জলঘোলা করাটা তাই প্রশ্নবিদ্ধই মনে হয়। বিশেষ করে অভিযোগের তীরটা যখন আসে প্রতিপক্ষ দলের কাছ থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না রেফারির ম্যাচ রিপোর্টে সহকারীদের অবদান নিতান্তই কম নয়! ‘নিরপেক্ষ রেফারি’র সাথে অভব্য আচরণের শাস্তিটা যদি রেফারিই নিজে না দিতে পারেন সেখানে প্রতিপক্ষ চিলির সেই প্রশ্নে হন্ত দন্ত হয়ে অভিযোগ দায়ের করাটা দৃষ্টিকটুই। আর্জেন্টিনার কাছে হেরে বাছাইপর্বে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ‘বিশেষ’ কোনো খেলোয়াড়কে নিষিদ্ধ করার জন্যই যে চিলি এমন পদক্ষেপ নেয়নি- সে প্রশ্নের জবাব খোঁজা কী অবান্তর হবে?
ভবিষ্যৎ ফুটবল কী এমনই হওয়া উচিত? ম্যাচ শেষ ভিডিও টেপ তন্ন তন্ন করে খুঁজে প্রতিপক্ষের দোষ ত্রুটি বের করে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের” নিকট হস্তান্তর পূর্বক উপর্যুপুরি শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা? চার দিনের এই নিষেধাজ্ঞা আগামী দিনের ফুটবলের জন্য যে উদাহরণ সৃষ্টি করল- তা কি বিতর্কিত নয়?
রুঢ় বাস্তবতা হল- ফুটবল মাঠে কেউই ‘সুশীল’ নন। এমন একজন ফুটবলারও খুঁজে পাওয়া সম্ভব না যিনি কটু কথা না বলেই পার করে দিয়েছেন আস্ত একটা ক্যারিয়ার। এই কটু কথার আবার রকমফের আছে। গালি-গালাজেরও যে শ্রেনীবিন্যাস আছে সেটা আশা করি এই লেখার পাঠকদের আলাদা করে বুঝিয়ে দেবার কিছু নেই।
ধরে নেয়া যাক, মেসি একরকম শব্দ ব্যবহার করেছেন চিলির বিপক্ষে। আবার অন্য কোনো এক ম্যাচে ‘তুলনামুলক’ ভদ্র শব্দ ব্যবহার করে রাগ ঝেড়েছেন রেফারির ওপর। কেমন গালির জন্য ক ম্যাচ কাটাতে হবে ঘরে বসে- এই সংক্রান্ত বিধি নিষেধ কি ফিফার আইন বইতে বিদ্যমান?
অথবা মেসির বেড়ে ওঠা, পরিবেশ একরকম হওয়ায় মেসি যে ধরণের শব্দ চয়ন করে অপরের বংশ উদ্ধার করবেন, একই ঘটনায় ইব্রাহিমোভিচ সুইডেনে বড় হওয়ায় তাঁর অভ্যাগম হবে আলাদা। এ ক্ষেত্রে কার জন্যে শাস্তির বিধানটা কেমন হবে? কারও জানা নেই।
মেসির নিষেধের আজ্ঞার কারণে উদ্ভব হওয়া প্রশ্নের সংখ্যা শেষ হচ্ছে না এখানেই। শুক্রবার হওয়া ম্যাচের পর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। আর্জেন্টিনার পরবর্তী ম্যাচ বুধবার রাতে। এই সময়ের মাঝে মেসিসহ আর্জেন্টিনা দল ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে পরের ম্যাচের ভেন্যু লা পাজে। বলিভিয়ার বিপক্ষে খেলতে।
সোমবার অবশ্য মেসির বিপক্ষে অভিযোগ আনার কথা জানানো হয়েছিল আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে। ততোক্ষণে পুরো দলটাই অবস্থান করছিল বলিভিয়ায়। হয়ত এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার কৌশলটা কষে ফেলেছিলেন এদগার্দো বাউজা। আলাদা করে বলবার প্রয়োজন নেই সেই কৌশলে মেসির উপস্থিতি কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর্জেন্টিনা দলের জন্য।
সোমবার সতর্ক করার ঘটনা বিবেচনায় নিলেও মেসিবিহীন প্ল্যান ‘বি’ প্রস্তুত করতে বাউজা আসলে সময় পেয়েছেন মাত্র ২৪ ঘন্টা। আর নিষেধাজ্ঞার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে বলিভিয়া ম্যাচের মাত্র ৬ ঘন্টা আগে! ‘ফিফা’র এমন কান্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের দেখা সচারচর কমই মেলে। অনেকেই অবশ্য এক ডিগ্রী এগিয়ে আইসিসি সাথে টেনে মিল খুঁজতে চাইছেন এই ঘটনার!
কিক অফের মাত্র ৬ ঘন্টা আগে একটা দলকে এমন ‘চমকে’ দেয়াটা একরকম অন্যায়। অথবা ফিফার নিয়ম-নীতির ফারাক। গত চারদিন ধরে মেসিকে আটকাতে ছক কষতে থাকা বলিভিয়ার খেলোয়াড়দের কথাই একবার ভাবুন? মেসি থাকবেন না জানলে হয়ত বাড়তি একটা ডিফেন্ডার খেলানোর সিদ্ধান্তই নিতেন না ভদ্রলোক! অথচ তিনিও তাঁর কৌশল বদলাতে সময় পাচ্ছেন মাত্র ছয় ঘন্টাই!
সবকিছুর পরও ধরে নেয়া যাক, সহকারী রেফারিকে উদ্দেশ্য করে গালমন্দ করার শাস্তি চার ম্যাচের নিষেধাজ্ঞাই। তাহলে খেলার মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়া ট্যাকেলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের পা ভেঙে দেয়ার শাস্তি কেমন হওয়া উচিত? এ ক্ষেত্রে শুক্রবার রাতেই ওয়েলস আর আয়ারল্যান্ড ম্যাচে শেমাস কোলম্যানকে করা ট্যাকেলের কথা উল্লেখ করা যায়। অথবা মেসির বর্তমান সতীর্থ আর্দা তুরানের রেফারির দিকে বুট ছুড়ে মারার ঘটনার কথাও বলা চলে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে বার্সেলোনার বিপক্ষে খেলার সময়ই রেফারির দিকে বুট ছুড়ে মেরেও মাত্র একটা হলুদ কার্ড দেখেই পার পেয়েছিলেন আর্দা তুরান। পরে আলাদা কোনো শাস্তিও ভোগ করতে হয়নি। অথচ একবার ভাবুন তো একই ঘটনা যদি মিশর না মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ফুটবল লিগে ঘটত সেখানে হয়ত ‘লিগ ছাড়াই’ হতে হত বেচারাকে!
প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে কনুই মেরে ইব্রাহিমোভিচকে মেনে নিতে হয়েছে প্রায় একইরকম শাস্তি। কিন্তু ইব্রার ‘পাপের’ তদন্ত শেষ হয়েছিল অল্প সময়েই। আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পরবর্তী ম্যাচের বেশ আগেই এফএ জানিয়ে দিয়েছিল তাঁদের সিদ্ধান্ত। একটা দেশের ফুটবল সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেলে, ফুটবলের রক্ষক ফিফার কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ পাবার আশা করা তো নৈতিক অধিকার! কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথমে রেফারির রিপোর্টে না থাকা, পরে প্রতিপক্ষের তোড় জোড়ে সংযোজন, এরপর তা নিয়ে কালক্ষেপণ, সবশেষে ম্যাচের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে বিচার শালিস করে সিদ্ধান্ত জানানো- সবরকম অনিয়মই উপস্থিত!
মাঠে রেফারির চোখ না এড়ালে বড়জোর লাল কার্ডের খড়্গে দুই ম্যাচ মাঠের বাইরে থাকতে হত আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে। কিন্তু চার ম্যাচ নিষেধাজ্ঞার পরিমাপকটা আসলে কী? শুধুমাত্র খারাপ শব্দ ব্যবহারের জন্যই?
কোন শব্দ ব্যবহারে কেমন শাস্তি হবে এমন জটিল ধাধার সমাধান মেলানো কঠিনই। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের ভাষা ও সাংস্কৃতিক অসাদৃশ্যতা পুরো ব্যাপারটাকে কেবল দুর্বোধ্যই করে তুলবে। কিন্তু এর সঠিক সমাধান না করেই হুট হাট এমন সিদ্ধান্ত স্বাভাবতই প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটায়। এমন জটিল বিষয় সমাধানে কি ফিফার শক্ত কোনো নিয়ম-নীতিই নেই? বিশেষ করে মেসির চার ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ফিফার কাছ থেকে আরও বিস্তর ব্যাখ্যা এখন সময়েরই দাবি।
- 0 মন্তব্য