• ফুটবল

অ্যাটলেতিকো মাদ্রিদ এবং ডিয়েগো সিমিওনে:মূলপর্ব

পোস্টটি ৬৪৬৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আজকের গল্পটা শুরু করব সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দিয়ে।

 

 

ভিডিওটি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ বনাম মালাগা ম্যাচের একটি দৃশ্যের। সেখানে দেখা যাচ্ছে মালাগার কাউন্টার অ্যাটাকে বল নিয়ে এগোনোর সময় একটি অতিরিক্ত বল ঢুকে গেছে মাঠে। পরে দেখা যায় (ভিডিওটির শেষে) কাজটি মালাগার এক বলবয় ডিয়েগো সিমিওনের নির্দেশে করেছে যার জন্য পরে সিমিওনে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন। কিন্তু এই কাজটি করে লাভ কি! খেলা বন্ধ হবে, মালাগার কাউন্টার অ্যাটাকটি নষ্ট হবে অর্থাৎ অ্যাটলেটিকোর গোল না খাওয়া সুনিশ্চিত করা। হ্যাঁ, এটাই সিমিওনে টাইপ ফুটবল। এখানে ঠিক বেঠিক বলে কোন কাজ নাই, দিনশেষে জয়টাই মুখ্য তা সে যেভাবেই আসুক। একটি অসাধারণ ট্যাকটিকাল দল, অসাধারণ কিছু চিন্তার মাঠে সফল প্রয়োগ, ভয়াবহ আবেগ, কিছু অসাধারণ শারীরিকভাবে দক্ষ খেলোয়াড় আর যেভাবেই হোক জয় ছিনিয়ে আনার প্রবণতা- এইভাবেই আজকের দুর্দান্ত অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তৈরী করেছেন দ্য ট্যাকটিকাল ওয়ান খ্যাত ডিয়েগো পাবলো সিমিওনে। একটি খালি ক্যানভাস তিনি এমনভাবে সাজিয়েছেন যেটা দেখে মানুষ সুন্দর না বললেও মুগ্ধ হতে বাধ্য, যেটার সাফল্যগাথা রীতিমত ঈর্ষান্বিত।

কোচ হিসেবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার সময়ই সিমিওনে বুঝতে পারলেন এখানে দলে একক নৈপুণ্য খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কিন্তু এখানে রয়েছে একঝাক তরুণ প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় মুখ। আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের স্কাউটিং সিস্টেম বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি। ফলে তরুণ মুখের যোগান এখানে কখনই কমে না। তাই তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোন দল নয় বরং ১১ জনের সমন্বিত এক শক্তি বানানোর পরিকল্পনা মাথায় নিলেন যেখানে সবার দায়িত্ব সমান হবে। আবার ১১ জনের মধ্যে কেউ কোন কারণে খেলতে না পারলে (ইঞ্জুরি বা সাস্পেন্সান) যে দলের অনেক বড় ক্ষতি হবে তা নয়, সেই জায়গায় তার তৈরী অন্য কেউ কাজটি অবলীলায় করে যেতে পারবে। ছোট একটি স্কোয়াড কিন্তু সবাই নিজের দায়িত্ব বুঝবে এবং করার ক্ষমতা রাখবে। কোচ সিমিওনে বিশ্বাস করেন ‘যে দল যত কম গোল খাবে, তাদের জেতার সম্ভাবনা ততটাই বেড়ে যাবে।’ তাই তিনি এমন এক শক্তি বানানোর কাজ শুরু করলেন যেটা প্রতিপক্ষ যেন মাঠে গোল দিতে না পারে এজন্য সুসংগঠিত, দৃঢ়, প্রয়োজনবোধে নির্মম এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত।

সিমিওনে শুরুতে বেশ কয়েক রকমের ফর্মেশন নিয়ে কাজ করে বেছে নিলেন ৪-৪-২ লাইন আপকে যেটা ক্ষেত্রবিশেষে ৪-৪-১-১ হয়ে কাজ করে। এখানে তিনি প্রতিপক্ষকে তাদের অর্ধে সাথে নিজেদের অর্ধের অল্প কিছু অংশেও বলের দখল ও জায়গা দুইই দিলেন। নিজেরা 

 

 1

 উপরে ও নীচে ছবিতে মাঠে অ্যাটলেতিকোর ফর্মেশন

atletico-pressing-midfield

 

নিজেদের অর্ধে মাঝমাঠে ৪ জন ও নীচে ৪ জন দুই লাইনে বিন্যস্ত থাকবে। আর উপরে থাকবেন দুজন ফরোয়ার্ড যাদের কাজ হবে নীচে থেকে লম্বা বাড়ানো পাসগুলো কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের গোলবারে হানা দেওয়া। মাঝে মাঝে মাঝমাঠের দুপাশের দুজন উইং দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করবে তখন ক্রসের জন্য এই ফরোয়ার্ডদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজন অনুসারে একজন ফরোয়ার্ড নেমে অতিরিক্ত মিডফিল্ডারের কাজ করবে।

 

 Untitled2

 

এই পুরোটা হচ্ছে সিমিওনের অধীনে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের গড়ন। মাঠে তারা অসম্ভব রকমের ধারাবাহিকভাবে এই গড়ন মেনে চলে। এখন আমরা একটু দেখার চেষ্টা করি মাঠে কাজ করে কেমনে সিমিওনের দল?

 

 2

 

উপরের ছবিটি আমরা যদি খেয়াল করি দেখব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের দুই লাইন নীচে নেমে আছে নিজেদের অর্ধে। এখন প্রতিপক্ষকে আক্রমণের জন্য উপরে উঠে আসতে হবে বল নিয়ে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের অর্ধে প্রতিটা খেলোয়াড়দের নিজস্ব এলাকা আছে। এলাকাগুলো এমন যেন এগুলো একটা অন্যটার সাথে না মিশে। যখন প্রতিপক্ষের কোন খেলোয়াড় বল নিয়ে অ্যাটলেটিকোর অর্ধে আসে তখন যে খেলোয়াড়ের এলাকায় প্রবেশ করে সে বলে দখলের জন্য বা বল নিয়ে আর না এগোতে দেওয়ার জন্য প্রেস করে। ফলে বাধ্য হয়ে পাস দিতে হয় পজেশন রাখার জন্য নতুবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বল হারাতে হয়। বল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কোন খেলোয়াড়ের এলাকা থেকে বের হলে সে আবার ধীরেসুস্থে নিজের এলাকায় ফিরে এসে অবস্থান নেয়।

 

Zone

 

বিপক্ষদল আক্রমণের জন্য যদি মাঠের মাঝের দিক না, উইং বেছে নেয় তবে কাজটা তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে যায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে। নিচের ছবিটি যদি আমরা খেয়াল করি তাইলে দেখব প্রতিপক্ষের ডান উইং অর্থাৎ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বাম উইং এ বল আছে। এক্ষেত্রে অ্যাটলেটিকোর LB, LM ও একজন CM খেলোয়াড়টিকে প্রেস করছে। এসময় একজন CF নেমে মাঝমাঠ কাভার করছে।

 

atletico-pressing-defensive-third

 

প্রয়োজনবোধে একজন CB ও বেশ বামে চলে চলে গেছে এবং RB ও RM মাঝে এসে গেছে। বিপক্ষের বলসহ খেলোয়াড়টিকে তিনজন মিলে প্রেস করার ফলে তার যেমন বল নিয়ে উঠার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, তেমনি ডি বক্সের মাঝে ক্রস করা বা লং বলে উইং পরিবর্তনও প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় হয় তাকে নীচে পাস দিতে হবে না হয় নিজেকেই নীচে নামতে হবে না হয় বল হারাতে হবে। এ অবস্থায় পাস দেওয়ার চেষ্টা করলে বল ইনটারসেপ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এখন মনে করি কোন একদল বল মাঝমাঠ পার করে ফেলছে সেক্ষেত্রে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের রয়েছে ফাউলের সুযোগ। আর তাও যদি কোন খেলোয়াড় কোনভাবে ডি বক্সে ঢুকেই যায় তাইলে আরও অপ্রতিরুদ্ধ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের। নিচের ছবিটি খেয়াল করুন। ডি বক্সে বল রয়েছে। অ্যাটলেটিকোর প্লেয়াররা একদিকে

 

atletico-tight-large_trans++2oUEflmHZZHjcYuvN_Gr-bVmXC2g6irFbtWDjolSHWg

 

নিজেদের দুই লাইন যেমন রেখেছে বারের সামনে তেমনি ছোট একটা জায়গায় জনবহুল এলাকা তৈরী করেছে। ছবিটি ভালো করে খেয়াল করুন দেখবেন চারজন ডিফেন্ডারের মাঝে রয়েছে তিনজন মিডফিল্ডার। ফলে যেমন পাস দেওয়া অসম্ভব তেমনি গোলবার মুখে এই দুই লাইনের জন্য শট নেওয়াও অসম্ভব। আর নিলেও গোল কিপার তো রয়েছেই। এমনি ভয়ংকর সুন্দর ভাবে ডিফেন্ড করে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। তারা প্রতিপক্ষকে এত চাপে রাখে যে চিন্তার কোন অবকাশ নেই। আচ্ছা দেখুন তো একবার গুণে ছবি দুইটিতে কয়জন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের খেলোয়াড় দেখছেন? ১০ জন তো? আর একজন কিন্তু উপরে মিডফিল্ডে ঠিকই ফাকা জায়গা খুঁজে লং বলের জন্য অপেক্ষা করছে। সুযোগ পেলেই প্রতিআক্রমন শুরু কোন সময় না নষ্ট করে।

নীচের GIF টি লক্ষ্য করুন তারা আসলে নিজেদের ডি বক্সের কাছাকাছি ডিফেন্ডিং এর সময় প্রতিপক্ষকে নুন্যতম চিন্তার সময়টুকুও দেয় না। ফলে কাজ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায় বিপক্ষের জন্য। বলের আশেপাশে ছয় জন খেলোয়াড়!

 

NoThinkTime

 প্রতিপক্ষের চিন্তার কোন সময় নেই যখন বল অ্যাটলেটিকোর ডি বক্সের কাছাকাছি 

যেহেতু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের আক্রমণ কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফলে দ্রুত আক্রমণে যাওয়ার সময় বল হারানোর সুযোগ থাকে। সবার এটাই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে এসময় বিপক্ষ যদি দ্রুত অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ডিফেন্স ভাঙতে চায় অর্থাৎ যেহেতু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের অর্ধে তার মানে তারা নিজেদের এলাকা থেকে উঠে এসেছে সেক্ষেত্রে কিছুটা অরক্ষিত তাদের ডিফেন্স ফলে এবার অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে কাউন্টার অ্যাটাকের চেষ্টা। কিন্তু এক্ষেত্রেও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের পূর্ব পরিকল্পনা রয়েছে। তারা বল হারালে সাথে সাথে কাউন্টার প্রেসিং শুরু করে। হয় প্রতিপক্ষের পাসিং লেন বন্ধ করে না হয় ম্যান অন ম্যান মার্কিং করে। খুব বিপজ্জনক অবস্থায় চলে গেলে ফাউল করে খেলা বন্ধ কর তারা। আর এইসময়ের মাঝেই তারা খুব দ্রুত নিজেদের এলাকায় চলে আসে।

 

ManPressing

 উপরে দেখুন বল হারিয়ে ম্যান অন ম্যান মার্কিং আর নীচে বল হারিয়ে দ্রুত নিজেদের জায়াগায় ফিরে আসা

BackToZone

 

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ বল পাওয়ার সাথে সাথেই খুব দ্রুত আক্রমণে যায়। তারা ওয়ান টাচ নীতির ব্যবহার করার চেষ্টা করে অর্থাৎ এক স্পর্শের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পাস। যতটা কম সম্ভব টাচের মাধ্যমে এবং ভয়াবহ দ্রুত পাসের মাধ্যমে তারা উপরে যায় ফলে বিভ্রান্তির মাঝে পরে যায় বিপক্ষ। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের প্রতিটা খেলোয়াড় পাস দিয়েই নিজে ফাকা জায়গা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে যেন বল তাকে আবার পাস করতে পারে। এভাবেই তারা প্রতিপক্ষের ডি বক্সে দ্রুত হানা দেয়।

 

FastPassing

 দ্রুত পাসিং আর অসাধারণ বোঝাপড়া

 

মজার ঘটনা এখনও শেষ হয়নাই। মনে করি কোন একদিন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের প্রতিপক্ষ চায় না যে তারা নিজেরা আক্রমণ করবে। ফলে তারা নিজেদের হাফে বল নিয়ে থাকবে আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগ পাবে না। এক্ষেত্রে অ্যাটলেটিকোর এক মক্ষম অস্ত্র রয়েছে। তারা বল প্রেস করে ছিনিয়ে ডিফেন্সিভ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের উইং ব্যবহার করে আক্রমণ করে। LB, LM/ RB, RM নিজেদের মধ্যে পাসিং এর মাধ্যমে বল উপরে আনে এবং ভালো অবস্থানে আশা মাত্রই ক্রস করে। ডি বক্সের মাঝেই তাদের ক্রসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা CF রা বল গোলবারে প্রবেশের চেষ্টা করে। এছাড়াও তারা ডেড বল (কর্নার বা ফ্রি কিকে) থেকে হেডে গোল করতেও অনেক দক্ষ।

যেহেতু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ডিফেন্সিভ ঘরানার ফুটবল খেলে তাই এক গোল দিতে পারলেই বা ইউসিএলের নক আউট খেলাগুলোতে কাঙ্ক্ষিত অ্যাওয়ে গোল বা লিড পেলেই আরও ভয়াবহভাবে নিজেদের ডিফেন্স গুটিয়ে নেয়। তাদের মাঝমাঠ ও নিচের লাইন আরও নিচে 

 

Untitled4

 

নেমে যায়। এসময় মাঝমাঠের লাইনের সাথে এই ডিফেন্সিভ লাইনের দূরত্ব আরও কমে যায়। ছোট কিন্তু জনবহুল জায়গার কারণে ডিফেন্স ভেদ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। অসাধারনভাবে এই পদ্ধতিটা তারা আয়ত্ত এনেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ যতই আক্রমণ করুক ফল পায়না। নীচের ছবিতে দেখুন অসহায় রিয়াল মাদ্রিদ! রামোস ও পেপে কত উপরে উঠে এসেছে! 

 

Untitled5

 

এতক্ষণের কথাগুলো থেকে এই জিনিসটা বোঝা যায় যে এভাবে খেলার জন্য অ্যাটলেটিকোর খেলোয়াড়দের অনেক দৌড়াইতে হয়। নিজেদের এলাকা সুরক্ষিত রাখার জন্য, প্রেস করার জন্য বা কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য কিংবা ব্যর্থ কাউন্টার থেকে ফিরার জন্য তাদেরকে সব সময়ই অনেক দৌড়াইতে হয়। এই জন্যই সিমিওনে তার খেলোয়ারদের শারীরিকভাবে অনেক শক্তিশালী এবং ক্রসে খেলার জন্য বাতাসে অনেক দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এইখানে আসলে সিমিওনের পাশাপাশি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ট্রেনারেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। এত শারীরিকভাবে খেলার পরেও ছোট স্কোয়াড নিয়েও দীর্ঘমেয়াদি কোন ইঞ্জুরিতে দলের খেলোয়াড়রা তেমন একটা পরে নাই।

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে অন্যান্য দলগুলোর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল তারা বল ছাড়াই খেলা নিয়ন্ত্রন করে। অন্যরা বল পায়ে ফুটবল খেলে আর অ্যাটলেটিকো অন্যের পায়ে বল রেখে নিজেরা খেলে। সিমিওনে তাদেরকে শিখিয়েছেন নিজেদের এলাকায় ঠিকমত থাকা, প্রতিপক্ষকে পাস বা শট নিতে না দেওয়া, কাউন্টার অ্যাটাকের সময় ফাকা জায়গা খুঁজে নেওয়া। এসবই করতে হয় বল পায়ে না থাকা অবস্থায় আর এগুলো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা অবলীলায় মাঠে করে দেখাচ্ছেন। সেইসাথে মাঠে অসম্ভব শক্তির প্রয়োগ, প্রতিপক্ষের মেজাজ বিগড়িয়ে তাদের খেলা নষ্ট করা এসবও কিন্তু সিমিওনের ট্যাকটিকস। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের খেলার সময় মাঠে প্রায়শই বড় অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখা যায়। যেমন গোলকিপার শট নিতে দেরি করা, থ্রো ইনে টাইম নেওয়া কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে সেই সময় বল না দেওয়া বা স্ট্রাইকারের গিয়ে প্রতিপক্ষের গোলকিপারের সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। এসবই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ঠাণ্ডা মাথার কাজ প্রতিপক্ষের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে না দেওয়ার জন্য। তারা মাঠে সুযোগ খুজতেই থাকে কিভাবে ধ্বংস করা যায় প্রতিপক্ষের মনোযোগ। খেলোয়াড় হিসেবেও কিন্তু এমনই সুযোগ সন্ধানী ছিলেন সিমিওনে।  প্রতিপক্ষকে ভয়াবহ ট্যাকেলে ধরাশায়ী করতে সিদ্ধহস্ত। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচ এমনই এক ঘটনার সাক্ষী। বারবার শারীরিক আক্রমণের শিকার ব্যাকহামের এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ডই খেয়ে বসে। সিমিওনে নিজে হলুদ কার্ড খেলেও ঠিকই কিন্তু প্রতিপক্ষকে ১০ জনের বানিয়ে নিজের কাজটা হাসিল করে নিয়েছিলেন।

 

 

এই ঘটনা নিয়ে সিমিওনের মন্তব্য কি ছিল জানেন?

'I had tackled him, and we both fell to the ground. As I was trying to stand up that was when he kicked me from behind. And I took advantage of that. And I think any person would have taken advantage of that in just the same way.'

সুযোগটা যে নিয়েছিলেন এটা আর অস্বীকার করেন নাই। কোচ সিমিওনে নিজের এই গুণগুলো তার খেলোয়াড়দের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন যা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠের খেলা দেখলেই বোঝা যায়।

এটাই নতুনরূপে দেখতে পাওয়া অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের গল্প। যেখানে একজনের উপর কোন চাপ নেই। চাপটা সবাই মিলে ভাগ করে নেয়। মেসি, রোনালদো ছাড়া চাপে পড়ে বার্সা, রিয়াল কিংবা তারাও কি কখনও এত এত প্রত্যাশার চাপে ভেঙে পড়েন না? কিন্তু অ্যাটলেটিকোর তেমন কিছুই নেই। এখানে যা হয় সবই ওই ১১ জনের মিলিত চেষ্টার ফল। সিমিওনে বানিয়েছেন এমন এক দল যার মূলকথা ‘দশে মিলি করি কাজ’ যারা হারার আগে হারে না। প্রথম পর্বে আমি বলেছিলাম তাদের আর্থিক সংকটের কথা। কিন্তু ভালো পাফরমেন্স তাদের এই সমস্যারও অনেকটাই সমাধান করে দিয়েছে। আগের চেয়ে সম্প্রচার সত্ত্বে অর্থের পরিমাণ বেড়েছে, লীগ জেতার অর্থ সাথে নিয়মিত চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ভালো করার জন্য সেখান থেকেও মোটা অংকের অর্থ পাচ্ছে তারা। তাইলে এইটা কি এক নতুন যুগেরই সুচনা দেখতেছি আমরা! সেটা সময়ই বলে দিবে আমাদের। আপাতত মুগ্ধ হয়ে তাদের ডিফেন্সই দেখি, ফাঁকা ক্যানভাসে তুলির ছাপই দেখি যেটা বেশির ভাগ মানুষের মতে অসুন্দর কিন্তু কার্যকরী।

একসময় রিয়াল সমর্থকরা মাঠে ব্যানার নিয়ে আসত অ্যাটলেটিকোর উদ্দেশ্যে 'we want more worthy opponent.’ তাদেরকে দমাইলো। বার্সার মেসি, নেইমার, সুয়ারেজ জুটিকে সাধারণ পর্যায়ে নিয়ে আসল এদের ডিফেন্স। আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সেমিফাইনালের প্রথম লেগে এত বিধ্বংসী আক্রমণ করেও বায়ার্ন এদের ডিফেন্স ভাঙতেই পারল না বরং হারের লজ্জা নিয়ে ফিরে আসলো। দুই লেগ মিলিয়ে এওয়ে গোলের সুবিধায় উঠে গেল ফাইনালে। গল্পের শুরুতে বলা এই 'সেরা' দলগুলোকে যে ছোট টীম আর তার জাদুকর মিলে প্রতিনিয়ত আটকে দিচ্ছে তারাও কি তাইলে নিজেদের অবস্থানে ‘সেরা’ বলার দাবীদার নয়?