• ফুটবল

৭-১ থেকে রাশিয়া : তিতের ব্রাজিল

পোস্টটি ১৭১৫৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সেই দুঃস্বপ্ন

 

৮ জুলাই, ২০১৪। ব্রাজিলের বেলো হরিজন্টে শহরের এস্তাদিও মিনেইরো স্ট্যাডিয়াম। প্রায় ৫৮,০০০ মানুষ বিকাল পাঁচটার মাঝে উপস্থিত। কারণ সেমিফাইনালে জার্মানীর বিপক্ষে মাঠে নামছে স্বাগতিক ব্রাজিল। খেলা শুরুর আগে রুটিনমাফিক ব্রাজিলের জাতীয় সংগীত শুরু হল। সাউথ আফ্রিকার বিশ্বকাপে জার্মানরা ভুভুজেলার যে আওয়াজ শুনেছিল, তার থেকে কয়েকগুণ তীব্রতায় গ্যালারি থেকে ব্রাজিলের জাতীয় সংগীত ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র স্ট্যাডিয়াম আর তার চারপাশের এলাকায়। যেন ব্রাজিল কোন ফুটবল ম্যাচে নয়, যুদ্ধে এসেছে। ব্রাজিলিয়ানরা বুঝিয়ে দিল, “তারা ফুটবলে বাঁচে, ফুটবলই তাদের জীবন।”

 

অবশ্য জার্মান সৈনিকদের খুব বেশিক্ষণ লাগেনি উৎসবমুখর স্ট্যাডিয়ামে শ্মশানের নিস্তব্ধতা আনতে। মুলার, ক্লোসা, ক্রুস, খেদিরাদের মুহুর্মুহু আক্রমণে মাত্র ৩০ মিনিটেই ০-৫ গোলে এগিয়ে যায় জার্মানরা। ব্রাজিলের জালে এক এক করে গোল জড়ায় আর গ্যালারীর দর্শকদের গলার চিৎকার চোখের জলে রূপ নেয়। ৯০ মিনিট শেষে ব্রাজিল ১ গোল শোধ দিতে পারলেও স্কোরলাইন ১-৭। ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য আর লজ্জাজনক হারের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হল সেই ৫৮,০০০ মানুষ। সে ম্যাচের ক্ষত এতটাই ছিল যে এরপরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ব্রাজিলের ০-৩ গোলে নেদারল্যান্ডের কাছে হার বেশিরভাগ ব্রাজিলিয়ানের চোখেই পড়ে নাই।

 

 

140708-tunku-brazil-germ-tease_osetuc

 

 

ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবল সংস্কৃতি ইংল্যান্ডে আনতে কাজ করা ইংলিশ কোচ সাইমন ক্লিফর্ড সেদিন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি খুশি যে ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ৭-১ এ শেষ হয়েছে, ২-১ বা ৩-১ এ নয়। জার্মানরা মাঠে অনবদ্য ছিল। আধুনিক ফুটবলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্রাজিল ফুটবলে যে পরিবর্তন দরকার ছিল তা বুঝি এইবার আসবে। সবকিছু ভেঙ্গে নতুন করে সাজাতে পারলে ব্রাজিল আবার সেই ১৯৫০ এর ফুটবলে ফিরতে পারবে এবং তারা ফিরবেই।”

 

 

দুঙ্গাতে ভরাডুবি

 

সে সময়ে দরকারী পরিবর্তন না এনে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেয় দুঙ্গাকে। পুরোপুরি ভেঙ্গে নতুন করে সাজানোর মত মানুষ দুঙ্গা মোটেও ছিলেন না। তবুও বিপদে সব সময়ে ব্রাজিলকে সাহায্য করা দুঙ্গাতেই ভরসা রাখে ফেডারেশন।

 

 

brazil-s-new-manager

 

 

পরের বছর অনেক কষ্টে কোপা আমেরিকার নক আউটে পর্বে উঠে প্যারাগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নেয় দুঙ্গার শিষ্যরা। আরও এক বছর দলকে নিয়ে কাজ করার পরে ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারের তিন রাউন্ড পার করে দেখা গেল দুঙ্গার ব্রাজিল কোয়ালিফিকেশন স্লটের বাইরে ছয় নাম্বারে। ব্রাজিলিয়ানদের শংকা এবার বুঝি বিশ্বকাপে যাওয়াই হুমকির মুখে। ফেডারেশন শেষ সুযোগ দিল দুঙ্গাকে সে বছরেরই কোপা আমেরিকা সেন্টেরিওতে। কিন্তু পেরুর কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া ব্রাজিল যে এগোনোর বদলে পিছিয়েই যাচ্ছে তা দেরীতে হলেও এবার বুঝলো ফেডারেশন।

 

২০১৬ সালের জুনে অবশেষে এল পরিবর্তন। চাকরি পেলেন ২০১৪ ভরাডুবির পরে উপেক্ষিত, ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের প্রথম পছন্দ করিন্থিয়াস কোচ তিতে। বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে বেশিদিন সময় লাগেনি তাঁর। টানা ৮ ম্যাচ জিতে স্বাগতিক ব্যতীত প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের টিকিট কাটে ব্রাজিল। সেই থেকে আর ফিরে তাকাতে হয় নাই তিতে আর তার শিষ্যদের। কিন্তু কিভাবে? একটু পেছনে যেতে হবে।

 

 

ইউরোপের সাথে দুরত্ব

 

১৯৮২ সালে সর্বকালের সেরা ব্রাজিল দলের বিশ্বকাপ ব্যর্থতা পুরো ফুটবল বিশ্বে এক পরিবর্তন আনে। টুর্নামেন্ট জেতার সাথে সাথে আক্রমাণাত্মক সুন্দর ফুটবল যে উপহার দেওয়া সম্ভব তা সুন্দর ফুটবল বা জোগো বনিতোর জনক ব্রাজিলিয়ানরাই আর মানত না। ফলশ্রুতিতে রক্ষণ সামলে রাখার চল শুরু হয়। আস্তে আস্তে রক্ষণ আগলে দুই উইং ব্যবহার করে আক্রমণের চল শুরু হয় ফুটবল বিশ্বে। ব্রাজিলও এর বাইরে কিছু না। আক্রমণে গেলে আক্রমণভাগে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দুই উইং ব্যবহার করেই চলতে থাকে মূল রণসজ্জা। মাঝেসাঝে ভয়াবহ প্রতিভাবান কেউ (যেমনঃ রোনালদিনহো) এলে মাঝমাঠে নিজের মত খেলার সুযোগ পেতেন কিন্তু তাও রক্ষণ আগলে।

২০০৮ সালে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে পেপ গার্দিওলার আগমনে বিশ্ব ফুটবলে আসে পরিবর্তনের হাওয়া। বার্সেলোনাতে গার্দিওলার ব্যবহৃত ‘পজিশনের বদলে পজেশন’ নীতি মেনে সাফল্য আনে স্পেন আর জার্মানী। দুই দলের একাডেমির একই বয়সী খেলোয়াড়দের অসাধারণ বোঝাপড়া কাজে লাগিয়ে এই দুই দল পেপ গার্দিওলার নতুনত্বকে সাফল্যের সাথে বরণ করে নেয়। এই পরিবর্তনের সময়ে ব্রাজিলের কোন কোচের ইউরোপে শিরোনামে না আসাটাই বলে দেয় ব্রাজিলে এই নতুন চিন্তাধারায় এগোনোর মানুষের কত অভাব। এই পরিবর্তনের সময়ে ব্রাজিল ফুটবলকে পুরনো খোলস থেকে বের না করার ফলাফল তো ২০১৪ সালে জার্মানী চোখে আঙ্গুল দিয়েই দেখিয়ে দিল।

 

 

ছাত্র তিতের আগমন

 

বায়োডাটা খুঁজে দেখতে গেলে দেখা যাবে তিতেও ইউরোপে কোচ হিসেবে অনুপস্থিত। দুইটা ব্রাজিলিয়ান লীগ, একটা কোপা লিবার্তাদোরেস এবং করিন্থিয়াসের হয়ে চেলসিকে হারিয়ে একটি ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপার ঝুলিতে। কিন্তু না জানাকে জানার ইচ্ছায় ছাত্র হিসেবে বার বার ইউরোপে ফিরে এসেছেন প্রচন্ড পড়ুয়া তিতে। নতুন নতুন কৌশল শিখে ব্রাজিলে গিয়ে নিজের মত ব্যবহার করে সাফল্যও পেয়েছেন। ৩-৫-২ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা তিতে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ডি আলেসান্দ্রোর কাছে থেকে ইউরোপের ৪-৪-২ এর গল্প শোনেন। নিজের ফুটবল জ্ঞানের প্রতি ক্ষুধা বুঝতে পেরে ইউরোপে পড়াশোনা করতে চলে আসেন।

 

ব্রাজিলের সাথে ইউরোপের দলগুলোর মাঠে খেলোয়াড়দের মাঝে সুদৃঢ যোগাযোগের কৌশলগত পার্থক্য এসময় চোখে পড়ে তাঁর। ইউরোপিয়ান কৌশল ব্রাজিলে নিজের ক্লাবের রক্ষণে ব্যবহার করে লীগ  শিরোপা আর ক্লাব বিশ্বকাপ আনেন। দুর্দান্ত রক্ষণের সাথে এক গোলের ব্যবধানে জেতাকে ডালভাত বানিয়ে মরিনহোর ছোঁয়া আনেন মাঠে। এরপরে আবার ইউরোপে আসেন। এবার জানতে চান সম্প্রতি সফল হওয়া দলগুলোর রহস্য। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি এক নোটবুকে নোট করতে করতে ৬৪ খেলা দেখেন। সেখান থেকে জোয়াকিম লোর বিশ্বকাপজয়ী জার্মানীর ৪-১-৪-১ এ খেলার কৌশল সম্পর্কে জানেন। সেটার পেছনের স্পেন আর বার্সেলোনা নিয়ে জানতে গিয়ে পরিচয় হয় পেপ গার্দিওলার সাথে। দুজনের মাঝে গড়ে ওঠে সখ্যতা।

 

বিশ্বকাপ শেষে ব্রাজিল কোচের চাকরি না পেয়ে ব্যথিত হৃদয়ে আবার করিন্থিয়াস কোচ হিসেবে যোগ দেন। এবার পজিশন আর পজেশনের অদ্ভূত খেলা দেখিয়ে জিতে আসেন লীগ শিরোপা। একদিকে দুঙ্গার ব্যর্থতা অন্যদিকে ব্রাজিলে তিতের নতুন নতুন ফুটবলের ক্রমাগত সফলতা তাঁকে এনে দেয় তাঁর স্বপ্নের চাকরি।

 

 

2016-06-20T211827Z_10076555_S1AETLBFVVAB_RTRMADP_3_SOCCER-BRAZIL-COACH

 

 

দলগত খেলা

 

কোচ হিসেবে আনচেলত্তিকে গুরু মানা তিতে ব্রাজিলকে বাইরে থেকে জার্মানীর ৪-১-৪-১ এর মত করেই গড়ে তুলেছেন। কিন্তু ভেতরটা গার্দিওলা আর আনচেলোত্তির মিলিত আদর্শে তাঁর নিজের চিন্তায় সাজানো। পাওলিনহোকে চাইনীজ লীগ থেকে টেনে আনেন, মাঠে ক্যাসেমিরোকে নতুন ভাবে জায়গা করে দেন, কৌতিনহোকে মাঝমাঠে পরিচয় করিয়ে দেন, সামনে তরুণ জেসুসকে আনেন আর রক্ষণকে অনেকটা উপরে এনে আক্রমণে নিজেদের বোঝাপড়ার উপর ভিত্তি করে বলের দখল রেখে আক্রমণ। নেইমার-কৌতিনহোর বল পায়ে রাখার প্রবণতাকে ফুলব্যাকদের আক্রমণ মানসিকতার সাথে ব্যবহার করে আক্রমণে বেশ সফল তিতে। একত্রে অসাধারণ প্রতিভাধর এই দল মাঠে নিজেদের মাঝে একসাথে বেশ কিছু সময় কাটানোর পরে নিজেদের শক্তি আর দুর্বলতা সম্পর্কে জেনে তা নিয়ে কাজও করেছে। নেইমারকেন্দ্রিক ব্রাজিল দলকে নতুন করে সাজিয়ে এক দলগত রূপ এনে দিয়েছেন যেখানে নেইমার আরও ক্ষুরধার। সাথে মাথায় রেখেছেন দল নেইমারকেন্দ্রিক হলেও “নেইমার-আবশ্যিক” নয়। বিগত এক দশকে ব্রাজিলের সবচেয়ে স্থিতিশীল দল গড়েছেন পরম যত্নে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারানো ম্যাচ দেখে মাঠে সাবেক আর্জেন্টিনার কোচ সিজারে লুই মেনোত্তি উচ্ছসিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘এই ব্রাজিল একত্রে খেলে, এ ব্রাজিল ‘৭০ এর ব্রাজিলের মত খেলে।’

 

অসাধারণ প্রতিভাবান নেইমারের ফুটবল মাঠের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে ধাপে ধাপে বাড়ানোর জন্য কাজ করা তিতের অধীনে নেইমার আর ব্রাজিল দুজনেই উজ্জ্বল। বাবার মত দলের সকল খেলোয়াড়কে আগলে রাখা তিতে সন্তানদের যেকোন ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। সবাইকে মিডিয়া থেকে দূরে আগলে রাখা কোচের ব্যাপারে মার্সেলো বলেছিল, “তিতে বললে আমি খুন করতেও পিছপা হব না।” সম্ভবত ব্রাজিল স্কোয়াডের বাকি ২২ জনের কেউই দ্বিতীয়বার ভাববে না।

 

 

BESTPIX-Brazil-v-Argentina-2018-FIFA-World-Cup-Russia-Qualifier

 

 

শেষ ভাল যার, সব ভাল তার

 

কখনো ব্রাজিলের বাইরে কোচ হিসেবে কাজ না করলেও ফুটবলের একনিষ্ঠ ছাত্র অ্যাদেনোর লিওনার্দো বাচ্চি ওরফে তিতে। বিশ্বকাপ সামনে রেখে তাঁর দলের মূলকথা, “আমরা শিখেছি কিভাবে শিখতে হয়”। সমগ্র ব্রাজিলে এই মূহুর্তে ইউরোপিয়ান ফুটবলের ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানাশোনা সম্ভবত তাঁরই। ফুটবলপাগল ব্রাজিলিয়ানদের ৭-১ গোলের দুঃস্বপ্নকে দুই বছরে বিশ্বকাপ স্বপ্নে পরিণত করার মূল কারিগর তিতে সাহেব এখন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনে হারানোর ক্ষমতা রাখেন। সফলতা ছাড়া ব্রাজিলিয়ানরা কাউকেই মনে রাখে না। তাই তিতেকেও বিশ্বকাপ না পেলে এক সময় ভুলে যাবে সাধারণ জনগণ। তবে ব্রাজিল ফুটবলে ‘তিতে’ নামটা সফল এক পরিবর্তনের অপর নাম হয়েই থেকে যাবে।