ফুটবল মাঠের অভাগাদের গল্প
পোস্টটি ৭১৪৭ বার পঠিত হয়েছে
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ১১ জন নিয়ে গড়া দুইটি দল প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে গোল করে ম্যাচ জেতার চেষ্টা করে। তাইলে কি গোল দেওয়াটাই ফুটবল মাঠের শেষ কথা? খালি চোখে আমাদের কাছে ব্যাপারটা এমনই। বিপক্ষের থেকে বেশি গোল দিয়ে জেতাই হল আমাদের মত দর্শকদের কাছে ফুটবল। যে গোল দিবে সে নায়ক, যে পারবে না সে ভিলেন। তাই যারা গোল করে বা গোল করতে সাহায্য করে তাদের নিয়েই আমরা সারাদিন আলোচনায় মেতে থাকি। রোনালদো, মেসি, নেইমার, সুয়ারেজ, বেল, মুলার, অ্যাগুয়েরো, ইনিয়েস্তা, ভারডি, কেন, হিগুয়াইন, মদ্রিচ, ক্রুস, গ্রিজম্যান- এরাই আমাদের আলোচনার ফর্দে সবসময় উপরের দিকে থাকে। কিন্তু একশ্রেণীর ফুটবলার আছে যারা মাঠে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, এদেরকে বাধা দেয়, যাদের কারণে আমাদের এই নায়করা মাঝে মাঝে ভিলেন হয়ে যায়, যারা এত আলোয় আসে না কিন্তু নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে দলকে ঠিকই জিততে সাহায্য করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। হ্যাঁ আমি ফুটবল মাঠে নীচের দিকে খেলা ‘ডিফেন্ডার’দের কথা বলছি। যারা বেশিরভাগ সময় উপেক্ষিত মিডিয়ার আলো থেকে কিন্তু যাদের সুদৃঢ় অবদান ছাড়া জেতা কল্পনাও করা যায় না। আজকের এই গল্পটা তাদেরকে নিয়েই। কিভাবে তারা মাঠে কাজ করে, কিভাবে গোল করার চেষ্টা রুখে দেয়, তাদের গুরুত্বই বা কতটুকু!
খেলার মাঠে ডিফেন্ডারদের সবচেয়ে বড় কথা যেটা মাথায় রাখতে হয় তা হচ্ছে তারা একটা মিলিত শক্তি, কোন একক নৈপুণ্য এখানে মুখ্য নয়। কোচের পছন্দ অনুযায়ী ৩, ৪ বা ৫ জন খেলোয়াড় ডিফেন্ডার হিসেবে মাঠে থাকে। তাদেরকে অবশ্যই এবং অবশ্যই একটা লাইনে সুসজ্জিত হয়ে থাকতে হয় যেটা নিজেদের বোঝাপড়ার উপর গড়ে উঠে। যত ভালো বোঝাপড়া তত ভালো ডিফেন্সিভ লাইন আর তাতে প্রতিপক্ষের ততই অফসাইড ট্র্যাপে পড়ার সম্ভাবনা।
উপরের ও নীচের ছবি দুইটিতে ডিফেন্ডারদের লাইন দেখা যাচ্ছে
ম্যানেজারের চিন্তা বা কৌশলের উপর নির্ভর করে এই লাইনটি কত উপরে বা নীচে থাকবে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যদি বক্সের কাছাকাছি এসে পরে তখন ডিফেন্ডারদেরকে বক্সের বাইরে অবস্থান নিয়ে বলকে ডিবক্সে নিয়ে যেতে বাধা দিতে হয়। সুস্পষ্টভাবেই এটা বলা যায় প্রতিপক্ষের কোন খেলোয়াড় বক্সের ভিতরে বল নিয়ে ঢুকতে পারলে কিংবা বক্সের ভিতরে কাউকে পাস দিতে পারলে গোল করার বা পেনাল্টি আদায় করে নেওয়ার সুযোগ বেড়ে যায় তাই ডিফেন্ডারদেরকে ডিবক্সের বাইরে থেকেই কাজ শেষ করার চিন্তা মাথায় রাখতে হয়।
যদি প্রতিপক্ষের কেউ বল নিয়ে বক্সে ঢুকে যায় তাইলে তখন ডিফেন্ডারদের ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। এছাড়াও যদি প্রতিপক্ষ উইং দিয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যায় তাইলে তখন তাদের বাড়ানো ক্রস আটকানোর জন্য ডিফেন্ডাররা বক্সে প্রবেশ করে।
উপরের ছবিটি খেয়াল করলে দেখা যাবে ৫টি এলাকায় ভাগ করা আছে ডিবক্স ও আশপাশের এলাকা। প্রথম চেষ্টা থাকে ২, ৩ ও ৪ নং এলাকায় বল ঢুকতে না দেওয়া। কোনভাবে বল নিয়ে কেউ ঢুকলে তখন ভিতরে এসে তারা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করবে। আর যদি প্রতিপক্ষ বল নিয়ে ১ বা ৫ নং এলাকায় যায় সেক্ষেত্রেও তারা ডিবক্সে ঢুকবে ক্রস আটকানোর জন্য।
প্রতিটা ডিফেন্ডারের নিজস্ব এলাকা আছে ডিফেন্ডিং এর সময়। প্রতিপক্ষের যেকোন খেলোয়াড় সেই এলাকায় বল সহ বা ছাড়া প্রবেশের সাথে সাথেই তাকে মার্কিং এর আওতায় আনবে এলাকার মালিক। বল সাথে থাকলে তা নিজের পায়ে আনার চেষ্টা করবে প্রেস করে বা ইন্টারসেপ্টের মাধ্যমে এবং নিজের এলাকা থেকে বের করে দিবে। যদি বল ছাড়া ঢুকে সেক্ষেত্রে প্রেস করে তাকে এলাকা থেকে বের করে দিবে এবং সেইসাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবে বল মাঠের যেখানে আছে সেখানে, যেন বল তার এলাকায় থাকা খেলোয়াড়ের কাছে আসলেই সে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে।
কখনও কখনও প্রয়োজনে নিজের এলাকা ছেড়ে উঠে আসে ডিফেন্ডাররা। তবে এই সিদ্ধান্ত তাদের অনেক ভেবে নিতে হয়। কারণ উঠে এসে বল কেড়ে নিতে পারলে কোন সমস্যা নেই কিন্তু তা না হলে বিপদজনক জায়গায় প্রতিপক্ষ বল পেয়ে যেতে পারে যেটা দলের বিপদ বয়ে আনতে পারে।
প্রতিপক্ষ যদি কাউন্টার অ্যাটাক করে সেক্ষেত্রে ডিফেন্ডাররা ধারাবাহিকভাবে কিছু নিয়ম মেনে অ্যাটাকটি নষ্ট করার চেষ্টা করে। যদি বল পায়ে প্রতিপক্ষ শুধু জোরে দৌড়ে পার হওয়ার চেষ্টা করে তাইলে পাশ থেকে ট্যাকেল করার চেষ্টা করে ডিফেন্ডাররা। কিন্তু ড্রিবল করে এগোতে থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। ড্রিবলে খুব একটা পারদর্শী না এমন কারও পায়ে বল থাকলে তারা ট্যাকেল করে বল নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যদি নিয়ন্ত্রণে ভালো এমন কারও কাছে বল থাকে তাহলে তারা প্রথমেই ট্যাকেল না করে বরং খেলোয়াড়ের সাথে দৌড়ে, তার সামনে অবস্থান নিয়ে সময় নষ্ট করার চেষ্টা করে যেন অন্যান্য ডিফেন্ডাররা এই সময়ের মাঝে নিজ অবস্থানে চলে আসতে পারে। খুবই মনোযোগী থেকে তারা খেলোয়াড়ের পা ও বলের অবস্থান নখদর্পণে রাখে। আর ডিবক্সের খুব কাছাকাছি চলে এলে ট্যাকেল ছাড়া অন্য কোন উপায় আর থাকে না! প্রতিপক্ষ যত পারদর্শী হয় বলের নিয়ন্ত্রণে ট্যাকেলের সময় নির্ধারণে ডিফেন্ডাররা ততটাই ধীরস্থির হয়। কারণ ওয়ান ওন ওয়ান ক্ষেত্রে ট্যাকেলের সুযোগ একবার। সেটা সফল না হলে মানে ট্যাকেল কাটিয়ে বল একবার বের করে ফেলতে পারলে প্রতিপক্ষের জন্য কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এজন্য প্রতিভাবান ড্রিবলারদের সাথে ওয়ান ওন ওয়ান অবস্থায় পরে গেলে ডিফেন্ডারদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সৃজনশীলতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ কোনভাবে ট্যাকেলের সময়টা ঠিকঠাক না হলে তাকে কাটিয়ে নিতে কোনই সমস্যা হবে না প্রতিপক্ষের।
ডিফেন্ডারদের একটা দরকারি জিনিস সব সময় মাথায় রাখতে হয় ‘সামনের খেলোয়াড়ের শক্তিশালী পা কোনটি?’। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের অপেক্ষাকৃত দুর্বল পায়ে বল রাখতে পারলে পাস, শট বা ক্রস নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকাংশেই। তাই তারা প্রতিপক্ষের শক্তিশালী পায়ের কাছাকাছি একটা পা রাখার চেষ্টা করে। এতে করে নিজের ইচ্ছামত সেই পায়ে বল নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে পারে প্রতিপক্ষের জন্য। ফলে দুর্বল পায়ে বল আনতে হয়। আর একবার দুর্বল পায়ে বল এসে গেলে তার সামর্থ্য কমে যায় ফলে বল কেড়ে নেওয়া বা এলাকা থেকে বল বের করে দেওয়া সহজ হয়ে যায় ডিফেন্ডারের জন্য। সকল খেলোয়াড়ের শক্তিশালী বা দুর্বল পা সম্পর্কে তো আসলে জানা সম্ভব না তাই যে পায়ে তারা ড্রিবল করে সেই পাকেই সাধারনত শক্তিশালী হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
হলুদ জার্সির খেলোয়াড়ের শক্তিশালী ডান পাতে বল থাকার সময় চার্জ এবং বল বাম পায়ে দেওয়ার পর শারীরিকভাবে তাকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা
ডিবক্সে বল একবার ঢুকে গেলেই ডিফেন্ডাররা সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করে। কেননা সেখানে যেকোনো ভুল বড় রকমের বিপদের কারণ হতে পারে। যেকোন ভুল সিদ্ধান্ত পেনাল্টি এনে দিতে পারে প্রতিপক্ষকে। তাই বক্সের ভেতরে ট্যাকেলের সময় তারা টাইমিং সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকার চেষ্টা করে যেন তা কোনভাবেই ফাউল না হয়। হাত শরীরের সাথে লাগিয়ে রেখে কিংবা শরীরের পেছনে রেখে তারা হ্যান্ডবল যেন না হয় তার চেষ্টা করে। যদি শট নেওয়ার মত অবস্থা আসে তাইলে শট নেওয়ার পূর্বমুহূর্তেই বেশিরভাগ ডিফেন্ডার স্লাইডিং ট্যাকেলকেই সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়।
ডিফেন্ডিং এর জন্য দাড়ানো আসলে ফুটবল মাঠের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। বল গোললাইন ক্রস করার আগে পর্যন্ত কোন থামাথামি নেই এখানে। যদি কোন কারণে গোলকিপার ওয়ান অন ওয়ান অবস্থায় পড়ে যায় বা নিজের জায়গা ছেড়ে এগিয়ে যায় তাইলে ডিফেন্ডাররা গোললাইনে অবস্থান নেয় প্রয়োজনে বল ক্লিয়ারের জন্য।
ভিডিওতে বিভিন্ন সময় গোলকিপার জায়গাচ্যুত হওয়ার ফলে গোললাইনে এসে ডিফেন্ডারদের নিশ্চিত গোল বাঁচানো দেখা যাবে
যখনই কোন একটা টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় বা কোন একটা মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয় তখন তা মাপা হয় গোল বা এসিস্টের এককে। যার ফলে মাঠের নীচে খেলোয়াড়রা যতই ভালো খেলুক না কেন তারা লিস্ট তৈরির শুরুতেই পিছিয়ে পরে যায়। ডিফেন্ডারদের ক্ষেত্রে এখনও এ ধরনের কোন একক গড়ে উঠে নাই জন্যই তারা সর্বদাই উপেক্ষিত। ডিফেন্ডারদের মাঝে ব্যালন ডিঅর পেয়েছেন মাত্র তিন জন। বেকেনবাওয়ার (১৯৭২ ও ১৯৭৬), ম্যাথিয়াস সামার (১৯৯৬) এবং সবচেয়ে কাছকাছি ২০০৬ সালে ক্যানাভারো। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পথে পুরা টুর্নামেন্টে ইটালির জালে বল জড়িয়েছিল মাত্র দুইবার। গ্রুপ পর্বে একটা আত্মঘাতী গোল ছিল আর দ্বিতীয়টা ছিল ফাইনালে জিদানের প্যনাল্টি। এই অকল্পনীয় পারফর্মেন্সের পুরস্কার হিসেবে সেই ডিফেন্সের নেতা তথা দলনেতা ক্যানাভারোর হাতে সে বছর ব্যালন ডি অর উঠেছিল। ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে আরও এক তরফা হয়ে যাচ্ছে। ফলে সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হলেও পকেটে একটা ব্যালন ডিওর বা এ ধরনের কোন ব্যাক্তিগত পুরস্কার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আলেসান্দ্র নেস্তা, পাওলো মালদিনি, রবার্তো কার্লোস, ফ্রাঙ্কো ব্যারেসি, কার্লোস পুয়োল, কাফু, ফিলিপ লাম, লোথার ম্যাথিউস, হাভিয়ার জ্যানেত্তি সহ আরও অনেক ভারি ভার নাম পাওয়া যাবে এই লিস্টে।
একজন ডিফেন্ডারকে একাধারে গতিশীল, শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং দূরদর্শী হতে হয়। তারা গতি আর শক্তির সাথে সঠিক সিদ্ধান্তের মিশ্রণ দিয়ে মাঠে প্রতিপক্ষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠে। ডিফেন্ডারদের সবচেয়ে বড় সুবিধা তারা একদম নীচে থেকে খেলাটা দেখতে পারে ফলে পুরো মাঠ সম্পর্কে তাদের যে ধারনাটা থাকে তা আর অন্য কারোরই থাকে না। এজন্য পরবর্তীতে কোচিং জীবনে তারা অন্যান্যদের থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকে। মাঠে তাদের ভুমিকা এমন যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুলের কোন সুযোগ নেই। তাদের ছোট একটা সিদ্ধান্ত যেমন দলকে বড় বিপদ থেকে বাচিয়ে দিতে পারে তেমনি তাদেরই ছোট একটা ভুল দলকে বড় বিপদে ফেলে দিতে পারে! তারা ফুটবল মাঠের এমন সৈনিক যারা নিজেদের কাজের মান অনুসারে মিডিয়ার আলো পায় না। কারণ তারা গোল করে না, গোল আটকায় কিন্তু মানুষ ফুটবলে শুধু গোলই দেখতে চায়! তাদের প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা সফল দলগুলোর দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারব! তাইতো ফার্গি বলেছিলেন, ‘আক্রমণভাগ তোমাকে ম্যাচ জেতাবে আর ডিফেন্স তোমাকে টুর্নামেন্ট জিতাবে।’
- 0 মন্তব্য