খেললেন, হারলেন, কাঁদলেন
পোস্টটি ৪৩৫৩ বার পঠিত হয়েছেবিশ্ববিখ্যাত বীর আলেক্সান্ডার দি গ্রেট বলেছিলেন, 'এলাম, দেখলাম, জয় করলাম' । এই একই কথা একটু ঘুরিয়ে কিছুদিন আগে আমাদের মুস্তাফিজের জন্য ব্যবহার করেছি আমরা । আইপিএল ফেরত মুস্তাফিজের জন্য আমরা বলেছি, 'গেলেন, দেখলেন, জয় করলেন' ।
সেই একই কথা-ই লিওনেল মেসির জন্য যেন তিনশ ষাট ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে হয়ে গেলো, 'খেললেন, হারলেন ও কাঁদলেন' !
টানা তৃতীয় ফাইনালে খেলেছেন মরিয়া হয়ে । প্রাণপণ দৌড়েছেন, বল নিয়ে দিয়েছেন ভোঁ দৌড়, চেষ্টা করেছেন সতীর্থদের দিয়ে গোল করাতে, নিজেও করতে চেয়েছেন । গোলে শট নিয়েছেন, ফ্রি কিকে বাঁক খাওয়াতে চেয়েছেন, ড্রিবলিংয়ে ডিফেন্সের সব বাঁধা থোড়াই কেয়ার করে ছুটতে চেয়েছেন নিজের মতো । কিন্তু চাইলেই যে সব হয় না । তাঁর বিধি যে অন্যভাবে লেখা । তাই হলো না, কিছুই হলো না ।
পরপর তিন বছর ফাইনাল খেলেও রইলেন শিরোপা-শূণ্য । এক-দুইবার নয়, টানা তিন-তিনবার বড় ব্যথা নিয়ে দেখলেন, প্রতিপক্ষের উদ্যম বিজয়োল্লাস । আহা, পৃথিবী কত নিষ্ঠুর !
এবারের কোপা আসরে আর্জেন্টিনার আঠারোটি গোলে নয়টিতেই সরাসরি অবদান তাঁর । করেছেন পাঁচটি, করিয়েছেন চারটি । আসরের শুরু থেকে গঞ্জালো হিগুয়েন ছিলেন দুর্দান্ত ছন্দে । জোড়া গোল করেছেন দুই ম্যাচে । অথচ সেই হিগুয়েন কি না গোলকিপার কে একা পেয়েও জালে বল জড়াতে ভুলে যান ! ফিরে আসে যেন গত দু আসরের ফাইনালে সওয়ার হওয়া অদ্ভুত সেই 'ভূত' !
আগুয়েরোর মাথা ছুঁয়ে আরেকটু হলেই বলের ঠিকানা হচ্ছিল চিলির জালে । কিন্তু সেখানে বাঁধ সাধলেন চিলির গোলপোষ্টের নীচের অতন্দ্র প্রহরী 'ব্রাভো' । তাঁর বেরসিক আঙ্গুল বলটাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো, গোলবারের উপর দিয়ে । মেসিকে দিলো না উচ্ছাসে মেতে উঠার এক দূর্লভ সুযোগ । ফাইনালে যে কখনোই গোল-উচ্ছাসে মেতে উঠা হয়নি, আর্জেন্টাইন জাদুকরের ।
একশ কুড়ি মিনিট পর এলো টাইব্রেক নামক ভাগ্যের দোলাচল । তাতে রোমেরো-বীরত্বে আর ভিদাল-ভুলে, তিনি সুযোগ পেলেন আর্জেন্টিনাকে লিড এনে দেয়ার । হায়, ঈশ্বর ! কি হলো এটা ! মেসি বল মেরে দিলেন গোলবারের বাইরে । হ্যাঁ, লিওনেল মেসি । সময়ের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার করলেন পেনাল্টি মিস ! এরপর চিলি আর কোন সুযোগই দিল না ।
তিনি বুঝতে পারছিলেন, কি ভয়ংকর ভুল তিনি করে ফেলেছেন । সাথে সাথে হতাশায় দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন । সতীর্থরা যখন পেনাল্টি কিক নিচ্ছেন, তখন তিনি করছেন অস্থির চিত্তে পায়চারী । কখনো মাথায় হাত, কখনো গালে হাত, কখনো চোখ-মুখ ঢাকছেন হাত দিয়ে... কি করবেন এছাড়া... তখন যে তাঁর আর করার কিছু নেই ।
এক সময় নামলো যবনিকা । চিলির রক্তলাল-উচ্ছাসে দ্বিতীয়বারের মতো রক্তক্ষরণ ঘটলো, আর্জেন্টিনার । লিওনেল আন্দ্রেস মেসি তখন সাইড বেঞ্চের একটা বেঞ্চিতে বসে আছেন । চোখে-মুখে বেদনার ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি ।
বরাবরই তিনি আবেগ লুকিয়ে রাখেন পর্দার আড়ালে । তাঁর কান্না বাইরের কেউ দেখে না । তাঁর কান্না দেখে সতীর্থরা, দেখে 'গুরু' ম্যারাডোনা, দেখে কোচ সাবেলা । আজ যেন আর ধরে রাখতে পারলেন না । বহু কষ্টে এতদিন চেপে রাখা নোনাজল সব উছলে উঠে বেরিয়ে নামলো দুই চোখ বেয়ে ।
উঃ সে কী দৃশ্য ! কাঁদছেন মেসি !
খোচা খোচা দাঁড়ি, যন্ত্রণাদগ্ধ মুখ, গড়িয়ে পড়া অশ্রুজল... এ কোন মেসি ! এত কষ্ট তাঁর ! অসহ্য সে কষ্ট, মেসি বুঝি তাঁর কঠিন শত্রুর জন্যও কখনো কামনা করবেন না ।
দেশের জন্য খেলেন না, ক্লাব-অন্তঃপ্রাণ তিনি... এসব প্রতিনিয়ত শুনতে হয় যার, সেই তিনি আকাশী-সাদা জার্সীতে কাঁদছেন । স্বদেশ কে বহু বছরের আরাধ্য, বহু আকাংখিত একটা শিরোপা এনে দিতে না-পারার বেদনায়, তিনি কাঁদছেন ! যন্ত্রণায় গুমরে মরছেন । আহা, সে কী ভীষণ ব্যথা !
শুনলাম তিনি অবসর নিচ্ছেন । হয়তো বা অভিমান কিংবা অতি আবেগ থেকে তাঁর এই সিদ্ধান্ত । অভিমান হওয়ারই কথা, তিনি যে রক্তে-মাংসে মানুষ !
যত বড় মহাপুরুষই হোন, টানা তিন ফাইনালে হারের ধকল সামলানোর ক্ষমতা বুঝি বিধাতা তাকে দিয়ে পাঠাননি । নাকি ফুটবল বিধাতা কে একহাত দেখে নিতে চান তিনি । হুঁহ আমাকে ট্রফি দিবে না তো, দিয়ো না । আমি চলে যাচ্ছি । ট্রফি-বুভুক্ষু আমার দেশ মাতৃকাকে এবার অন্তত একটা ট্রফি দিয়ো !
আচ্ছা ভালো কথা, টানা তিন ফাইনালে হারের পরও কি মেসির 'মহাপুরুষত্ব' আছে ?
- 0 মন্তব্য