• ক্রিকেট

মোঃ আমির : লর্ডসে অধঃপতিত, লর্ডসে প্রত্যাবর্তিত, লর্ডসেই কি করবেন প্রায়শ্চিত্ত ?

পোস্টটি ১৫৯৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

গুণীজনেরা কহেন,

"সুখ্যাতি অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা ঢের বেশী কঠিন ।" গুণীজনদের এই বচন বর্ণে বর্ণে, পংক্তিতে পংক্তিতে পুরোপুরি মিলে গেছে মোঃ আমিরের জীবনের সাথে । যত দ্রুততার সাথে তাঁর উত্থান হয়েছিল, পতনের গতি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী, অনেক দ্রুত ।

 

কৈশোরের লাবণ্য মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই ‘ধরা কে সরা জ্ঞান’ করতে শিখেছিলেন । বিধাতা তাকে দিয়েছিলেন উজার করে । তাঁর বাঁহাতে যেমনি ছিল পেস, সুইং, গতি তেমনি ছিল তাঁর অধ্যাবসায়, পরিশ্রম ও সাধনা । সব মিলিয়ে একজন সম্ভাব্য বিশ্বজয়ীর ছায়া তাঁর মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকেই । স্বদেশী 'আইকন' ওয়াসিম আকরাম তাঁর মধ্যেই দেখতে পাচ্ছিলেন নিজের পুনর্জন্ম ! কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে টেনে আনছিলেন কিংবদন্তী অলরাউন্ডার এ্যালান ডেভিডসনকেও । আমির ব্যাটিংটাও মোটামুটি পারতেন যে !

ওয়াসিমের সাথে তুলনা যখন বড্ড বাড়াবাড়ি পর্যায়ে তখন ওয়াকারের বুঝি আর সহ্য হলো না । বলে বসলেন, আমিরের মাঝে তিনি নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছেন ! কিভাবে ? আমির তখন মাথায় সাদা ব্যান্ড পড়তে শুরু করেছেন, সেটা নাকি ওয়াকার কে মনে করিয়ে দিচ্ছিল ফেলে আসা তাঁর তরুণবেলা ।

 

দুরন্ত তাঁর গতি, বলকে দু’দিকেই সুইং করাতে পারেন অনায়াসে । হয়ে উঠতে পারেন পুরনো বলেও ভয়ংকর । আর কি চাই ! পাকিস্তান বোলিং আক্রমণ যেন বহুদিন পর ফিরে পেল তাঁর হারানো স্বর্ণ অতীত । আসিফের সাথে জুটি বেঁধে হয়ে উঠলেন ব্যাটসম্যানদের ত্রাস । টু ডব্লিউ'র পর বিশ্ব বুঝি পেল টু 'এ', আসিফ-আমির ।

 

মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোথা থেকে কোথায় পৌছে গেলেন ! সেবার ইংলিশ-গ্রীস্মে, অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে খেললেন দুর্দান্ত । অজিদের একশ'র নীচে গুড়িয়ে দিয়ে টেস্ট সিরিজ শেষ করলেন ১-১ সমতায় । ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও ইংগিত দিচ্ছিলেন ২-২ এ সমতা আনার ।

লর্ডসে যখন চতুর্থ টেস্টে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড খেলতে নামছে, তখন ২-১ এ পিছিয়ে পাকিস্তান । কিন্তু বল হাতে নিয়ে মোঃ আমির যা শুরু করলেন, তাতে ম্যাচটা যে আমিরের হতে যাচ্ছে তা নিয়ে সংশয় খুব একটা ছিল না । সংশয় ! হ্যাঁ, ওটাই করলো সর্বনাশ । ঐ ম্যাচের তো বটেই আমিরের ক্যারিয়ারেরও । আর সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা করলো ক্রিকেটের । ক্রিকেটে ঢুকে গেলো সন্দেহ, সংশয় । স্পট ফিক্সিংয়ে বিষাক্ত হলো বিশুদ্ধ ক্রিকেট ।

মাজিদ খান নামক এক জুয়াড়ির হাত ধরে উঠে এলো একের পর এক লোম খাড়া করা তথ্য । বাট, আসিফ, আমিরে দূষিত হলো ক্রিকেটের শুদ্ধ অঙ্গন, একটু যেন থমকে গেলো ক্রিকেটের চিরন্তন স্পন্দন ।

 

বয়স অল্প, উঠতি প্রতিভা, ক্রিকেটের সম্পদ, আনকোরা তরুণ... এসব বিবেচনায় আমিরের সামনে প্রস্তাব এলো রাজস্বাক্ষী হওয়ার । জিওফ লসন আমিরের বেড়ে উঠার পরিবেশ টেনে এনে, দাঁড়ালেন তাঁর পক্ষে । ক্রিকেট পন্ডিতেরা পক্ষে-বিপক্ষে জুড়ে দিলেন নানান তর্ক । একটা সময় পিসিবিও দাঁড়ালো আমিরের পাশে । অনুতপ্ত আমিরের চাওয়া তখন শুধু আরেকটি সুযোগ ।

 

অবশেষে কঠোর পরিশ্রম, নিরলস সাধনা আর অনেকখানি অপেক্ষার পর আমির সুযোগ পেলেন ক্রিকেট মাঠে ফেরার । বল নামক ছোট্ট গোলকটি নিয়ে ব্যাটসম্যানদের নাকাল করার বৈধতা পেলেন, অনেক সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর । ততদিনে আমিরের জীবন থেকে চলে গেছে পাঁচ বছরেরও বেশী সময়, এর মধ্যে জেলও খেটেছেন । অগণিত দুঃসহ মুহূর্তগুলোর কথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।

 

তাঁরই সমসাময়িক ট্রেন্ট বোল্ট, মিচেল স্টার্ক, টিম সাউদি, জুনাঈদ খানরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এখন । অথচ এদের বহু আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভিত খুঁজে পেয়েছিলেন আমির । ফিক্সিং কেলেংকারিতে অধঃপতিত হয়ে, পিছিয়ে না পড়লে এদ্দিনে কোথায় পৌছতেন, কে জানে !

যেই লর্ডস থেকে তাঁর পতনের সূচনা সেই লর্ডসেই প্রত্যাবর্তন করছেন তিনি । সেবার ইংলিশদের কাছে নাকানি চুবানি খেয়েছিল তাঁর দল । হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে । কিন্তু ছয় উইকেট নিয়ে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তোলার কাজটা তিনি সেরে রেখেছিলেন প্রথম সুযোগেই ।

 

বিপিএল মাতিয়ে, পিএসএল দাপিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাদা বল হাতে নিয়েছিলেন আগেই । বাকী ছিল রক্তরাঙা লাল চর্মগোলকটি । এবার সেটাও হাতে নেয়ার অপেক্ষায় তিনি । তাও আবার ক্রিকেটের পূণ্যভূমি লর্ডসে । শ্বেত পোষাকে, বিশুদ্ধ ক্রিকেটে, কালিমা-মুক্ত স্বচ্ছ এক ক্যারিয়ার গঠনের লক্ষ্যে দৌড় শুরু করবেন তিনি ।

তিনিই সম্ভবত প্রথম ফিক্সার যিনি দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও সুযোগ পেয়েছেন সব ভুলে নতুন এক ক্যারিয়ার গড়ার । মোঃ আজহার উদ্দীনের শত টেস্ট খেলার আকুতি শোনা হয়নি, ক্রণিয়ের মতো লেজেন্ডের সব কৃতিত্ব যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল প্রতারণার দায়ে । ক্রিকেট সমাজের বৃহত্তর এক অংশের শুভকামনা ও সমর্থনে, দ্বিতীয়বারের মতো ক্যারিয়ার শুরু করা আমির কতটা কি করতে পারবেন তা হয়তো সময়ই বলে দেবে । সোয়ান-কেপির মতো কেউ কেউ অবশ্য খুব একটা ভাল চোখে দেখছেন না, একজন ফিক্সারের এমন পুনর্বাসন !

 

লর্ড থেকে লর্ডস । তাহলে লর্ডসের হোম অব ক্রিকেট তো, প্রভুরই মাঠ । তা প্রভুর মাঠে, আমিরের সফল প্রায়শ্চিত্ত কি ঘটবে ? প্রত্যাবর্তনটা কি হবে বিধাতার আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোন চিত্রনাট্য মেনে ? ছয় বছর আগের সেই পাপের মোচন কি সম্ভব হবে ? নাকি অপেক্ষা করছে অন্য কোন বিস্ময় ?