ডন ব্র্যাডম্যানকে নৈবেদ্য
পোস্টটি ৩২০৫ বার পঠিত হয়েছে১.
এইমাত্র সাজঘরে ফিরলেন সিডনি বার্নস। পুরো দল নিয়ে পরের ব্যাটসম্যানের জন্য অপেক্ষা করছেন ইংলিশ ক্যাপ্টেন নরম্যান ইয়ার্ডলি। এরপরে যিনি নামবেন আজই তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ। অবশেষে ‘তিনি’ নামলেন। ইয়ার্ডলি তার সতীর্থদের সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন গার্ড অফ অনার দেয়ার জন্য। কারণ যিনি নামলেন তাঁর নাম স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
ওভালের সেই ম্যাচ খেলতে নামার আগে ডনের ব্যাটিং গড় ছিল ১০১.৩৯। আর মাত্র ৪টি রান করতে পারলেই গড় হত ঠিক ১০০। কিন্তু কি আশ্চর্য, সারা জীবন যার ব্যাট থেকে রান বের হয়েছে স্রোতের মত, সেই তিনিই কিনা জীবনের শেষ টেস্টে এরিক হলিস নামের এক অখ্যাত স্পিনারের গুগলিতে ০ রানে আউট হয়ে গেলেন? কে জানে, শেষ টেস্ট খেলতে নেমে ডনের চোখে পানি এসে পড়েছিল কিনা। সেই পানির কারণেই হয়তো বলটা ঠিকমত দেখে খেলতে পারেননি তিনি!!!
২.
আঠারো বছর আগে। অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে প্রথম ইংল্যান্ড সফরে এসেছে ২২ বছরের একটি ছেলে। ঘরোয়া ক্রিকেটের অনেক রেকর্ড ওলটপালট করে দিয়ে এসেছে সে। প্রথম টেস্টে তেমন সুবিধা করতে পারলো না ছেলেটা। তবে দ্বিতীয় টেস্ট থেকে তাঁর ব্যাট যেন হয়ে উঠলো খোলা তলোয়ার। সেই টেস্টে করলো ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল হান্ড্রেড, তারপরের টেস্টে করলো ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল। এক ম্যাচ গ্যাপ দিয়ে শেষ টেস্টে আবারও ডাবল। জানা যায়, সেই সফরে অফিশিয়াল, প্রস্তুতি ম্যাচ সব মিলিয়ে তিনি করেছিলেন প্রায় ৩০০০ রান।
সুপারম্যান? নোওওও। হিজ নেম ইজ ব্র্যাডম্যান। ব্র্যাডম্যান। বি-আর-এ-ডি-এম-এ-এন।
৩.
ব্র্যাডম্যানের যুগে ওয়ানডে কিংবা টি-২০’র কোন বালাই ছিল না। তাই বলার উপায় নেই যে এই যুগে জন্মালে তিনি কেমন খেলতেন। আচ্ছা, বাদ দেন। আসেন একটা গল্প বলি। :)
একবার ব্ল্যাকহিথ নামের এক জেলায় যান ব্র্যাডম্যান। উদ্দেশ্য সেই জেলার প্রথম স্টেডিয়ামের উদ্বোধন উপলক্ষে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলা। সেই ম্যাচে ২৫৬ রান করেন তিনি। তবে এখানে কত রান করেছেন তার চেয়েও বড় কথা হল কীভাবে করেছেন তা। তখন ওভার হত ৮ বলে। তিনি সেঞ্চুরি করলেন মাত্র ৩ ওভার অর্থাৎ ২৪ বলে। এই টি-২০’র যুগেও কি সেটা ভাবা যায়? তার ৩ ওভারের স্ট্যাট ছিল এরকমঃ
প্রথম ওভারঃ ৬, ৬, ৪, ২, ৪, ৪ ,৬, ১।
দ্বিতীয় ওভারঃ ৬, ৪, ৪, ৬, ৬, ৪, ৬, ৪।
তৃতীয় ওভারঃ ১, ৬, ৬, ১, ১, ৪, ৪, ৬।
ব্র্যাডম্যান এই যুগে খেললে কেমন খেলতেন সেই সিদ্ধান্ত বরং আপনারাই নিন।
৪.
ব্র্যাডম্যান অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেলেন ১৯৩৭ সালে। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে পেলেন ইংল্যান্ডকে, অ্যাশেজে। এবং প্রথম ২ টেস্ট হেরে চলে গেলেন খাদের কিনারায়।
এরমধ্যেই সাবেক অধিনায়ক বিল উডফুল বলে বসলেন, ব্র্যাডম্যান নয়, অধিনায়ক হিসেবে তাঁর পছন্দ ছিল স্ট্যানলি ম্যাককেব।
অস্ট্রেলিয়া চাপে ছিল। কিন্তু ব্র্যাডম্যান যে তার চেয়েও বেশী চাপে ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। ‘ডু অর ডাই’ অবস্থায় খেলতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা হল খুবই বাজে। ১৩০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেললো তারা। তবে স্ট্যানলি ম্যাককেব দাঁড়িয়ে গেলেন। দলীয় স্কোর যখন ১৮১/৬, তখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। যে বৃষ্টিতে ফুটবল খেলা যাবে অনায়াসেই কিন্তু ক্রিকেট কখনোই নয়। সেদিনের মতো খেলা সেভাবে শেষ হলেও পরেরদিন স্কোরবোর্ডে ২০০ উঠতেই ব্র্যাডম্যান একটা মাইন্ডগেম খেললেন। আগের দুই টেস্টে স্টিকি উইকেটে নিজেরা ব্যাট করেছেন, ইংল্যান্ডকে এই উইকেটে ব্যাটিং করানোর সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?
ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নামলো। পিচ মাইনফিল্ড হয়েই ছিল, তাতে গোলাবর্ষণ শুরু করলেন ‘গোলন্দাজ’ মরিস সিভারস। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন স্যার গ্যাবি অ্যালেনও কম সেয়ানা নন। ব্র্যাডম্যান আর তার মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছিল পুরোদমে। ২০০ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ব্র্যাডম্যান যদি ‘ট্রাম্প’ করে থাকেন, গ্যাবি অ্যালেন ‘ওভারট্রাম্প’ করলেন ৭৬ রানেই ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে।
দিনের খেলা শেষ হতে তখনো বাকি ৪৫ মিনিট।
সেইসময়ে ব্র্যাডম্যান যে সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে অনায়াসে সর্বকালের সেরা সিদ্ধান্ত বলা যায়। তিনি ৯ আর ১১ নাম্বার ব্যাটসম্যানকে ব্যাট করতে নামার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
সেদিন অস্ট্রেলিয়া দিনশেষ করলো ৩/১ এ।
ব্র্যাডম্যানের কপালের ভাঁজ কিন্তু বড় হচ্ছিলো আরও। আবহাওয়ার পূর্বাভাস যে আরও বর্ষণের খবর দিচ্ছিলো।
পরেরদিন রবিবার ছিল ‘রেস্ট ডে’।
ব্র্যাডম্যানকে বাঁচিয়ে দিল এই রবিবার।
সোমবারে যখন অস্ট্রেলিয়া আবার ব্যাট করতে নামলো তখন আকাশের মেঘ কেটে গেছে। কেটে গেছে ব্র্যাডম্যানের মনের মেঘও। সূর্যমামা মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে পিচ শুকানোর ‘মহান’ দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। তাই ২য় উইকেট হিসেবে যখন স্মিথ আউট হলেন পুরো মেলবোর্নে ‘ব্র্যাডম্যান’ ‘ব্র্যাডম্যান’ রব। কিন্তু ব্র্যাডম্যান ৪ নাম্বারে পাঠালেন কিথ রিগকে, ৫ নাম্বারে পাঠালেন বিল ব্রাউনকে। উদ্দেশ্য আর কিছুই না। ‘রান তুলতে পারলে ভালো, না হলে সময় কাটাও।’
৬ষ্ঠ এবং ৭ম ব্যাটসম্যান হিসেবে নামলেন যথাক্রমে ওপেনার জ্যাক ফিঙ্গলটন এবং ডন ব্র্যাডম্যান। স্কোর তখন ৯৭/৫। লিড ২২১ রানের।
নেভিল কার্ডাসের ভাষায়, “খেলার তখন ক্রাইসিস পয়েন্ট। সবকিছুই নির্ভর করছিল ব্র্যাডম্যান কি করেন তার উপরে।”
ব্র্যাডম্যান করলেন। ভালমতোই করলেন। আগের রাত থেকেই ফ্লু’তে ভুগছিলেন। ফ্লু নিয়েই সেদিন শেষ করলেন ব্যক্তিগত ৫৬ রানে। পরদিন ৫৬ থেকে ১০০, ১০০ থেকে ১৫০, ১৫০ থেকে ২০০, ২০০ থেকে ২৭০ রানে ৯ম উইকেট হিসেবে যখন আউট হলেন তার আগে ফিঙ্গলটনের সাথে গড়েছেন ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে রেকর্ড ৩৪৬ রানের পার্টনারশিপ। অস্ট্রেলিয়া অলআউট হল ৫৬৪ রানে।
এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। ৬৮৯ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ব্যাটিঙে ‘ক অক্ষর গোমাংস’ ফ্লিটউড স্মিথের দুর্দান্ত বোলিঙে ইংল্যান্ড ৩২৩ রানে অলআউট হয় । অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জেতে ৩৬৫ রানে।
অধিনায়ক স্যার ডনের অমরত্বের পথে যাত্রাও শুরু হলো এই টেস্ট দিয়েই।
৪র্থ টেস্টে ব্র্যাডম্যান করলেন ২১২। ৫ম টেস্টে করলেন ১৬৯। সিরিজ নিশ্চিত হল তাতেই। এই সিরিজের ভিত্তির উপরেই পরবর্তীতে গড়ে উঠলো ‘দ্য ইনভিন্সিবল।’
২-০ তে পিছিয়ে পড়েও ৩-২ এ সিরিজ জেতা একমাত্র ক্যাপ্টেন স্যার ডন।
৫.
মানবজীবন বড়ই আফসোসময়। আমার নিজেরও অনেক কিছু নিয়ে আফসোস আছে। খেলার কথা যদি ধরা যায় তাহলে ১৯৫৪’র হাঙ্গেরি, ১৯৫৬-৬০’র রিয়াল মাদ্রিদ, ১৯৭০’র ব্রাজিল আর ১৯৭৪'র টোটাল ফুটবলের হল্যান্ডের কথা বলবো অবশ্যই। আর একটা হল ব্র্যাডম্যানের খেলা দেখতে না পারা। দুনিয়ার সেরা ব্যাটসম্যানটির খেলা দেখা হয়নি এই দুঃখ আমার কখনওই যাবে না।
৬.
আজ স্যার ডনের ১০৮তম জন্মদিন। কে জানে, এককালে যাদের বিপক্ষে খেলেছেন তাদেরকে নিয়েই হয়তো আজ স্বর্গে কেক কাটবেন তিনি। থাকবেন ডগলাস জারডিন, হ্যারল্ড লারউডসহ আরও অনেকে।
শুভ জন্মদিন, স্যার ডন। ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যানের তালিকাটা আমরা শুরু করি ২ নাম্বার থেকে। কারণ ১ নাম্বারের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ শুধুই আপনার।
আপনার জন্মদিনে আপনার এক ভক্তের সামান্য নৈবেদ্য হিসেবে এই লেখা।
- 0 মন্তব্য