আমাদের ফুটবল সাথে আমরা
পোস্টটি ৩১৫৫ বার পঠিত হয়েছে
- আরে ঐ যে, ওই বছর ফাইনালে ব্রাজিলের ওই খেলোয়াড়টা জার্মানির ওই গোলকিপারকে কাটিয়ে একটা গোল দিয়েছিল না! এখনো চোখে লেগে আছে।
- এটা তো কিছুই না। ফ্রান্সের ওই টেকোটা যে ইতালির খেলোয়াড়টাকে মাথা দিয়ে মেরে দিয়েছিল না? দিয়েই লাল কার্ড। বেচারা!
- ইতালি যে কই হারিয়ে গেল!
- আরে মনে আছে কি নেদারল্যান্ডের ওই উড়ন্ত গোলের কথা? স্পেনকে যে উড়িয়ে দিল?
- মনে আছে ওই যে ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির একটা গোলের কথা? কি ভাবে দূর থেকে মারল!
- তুই তো লাকি সেবার মেসিকে দেখতে গেলি ঢাকার মাঠে।
- আমি আর কি, বড় ভাই তো এবার কোপায় মেসির একটা খেলা দেখতে গিয়েছিল!
- আরে বাদ দে মেসি, মেসি! এবার না খেলেও রোনালদো যেভাবে পর্তুগালকে ইউরো চ্যাম্পিয়ন বানালো!
- কি তোরা সব বাচ্চাকাচ্চা! এখন কি আর এইসব দেশের ফুটবলের সময় আছে? এটা তো মৌসুমি সমর্থকদের জিনিস। আসল ফুটবল তো ক্লাব ফুটবল মিয়া।
- আমি মাদ্রিদিস্তা!
- আমি কাতালান!
- আমি রেড ডেভিল!
- যাই হোক না কেন আমার জীবন আর্সেনাল ছাড়া অচল!
- আমি বাবা ক্লপের হ্যাভি মেটালে বিশ্বাসী। এবার লিভারপুল দেখাবে মজা!
- ইস! এত সহজ না। এবার পচেত্তিনো দেখো কি করে?
- বলা যায় না যদি গার্দিওলা কোন জাদু দেখায় দেয়?
- মরিনহো কি বসে থাকবে নাকি?
- দেখ আবার কি করে বায়ার্নের টীমটা!
- যে দল বানালো এবার অ্যাটলেটিকো! রিয়াল-বার্সা না কেপে যায় আবার।
- কে যেন এবার এক ব্রাজিলিয়ান অল্প বয়স্ক খেলোয়াড় কিনেছে দেখ কেমন হয়!
- যত যাই বলিস কেউই ম্যারাডোনার মত হতে পারবে না।
- পেলে তো আসলে তারও অনেক উপরে।
- কেন যে তোরা ইতালিয়ান লীগ পাত্তাই দিস না! দেখ এবার জুভেন্টাস কি করে?
- এবার ট্রেবল আমাদের।
- ট্রেবল কি এত সহজ যে চাইলেই পাওয়া যায়?
… … … ...
… … … …
কতিপয় বাঙালি ফুটবল ভক্তদের ফুটবল আড্ডা। হয়তবা এর মধ্যে কেউ একজন আমি বা আপনি! এভাবেই চলে আমাদের ফুটবল আড্ডা, আমাদের ফুটবল গল্প, আমাদের ফুটবল জ্ঞানের চর্চা। মেধাবী থেকে অজ্ঞ, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে চায়ের দোকানে, অন্ধভক্ত থেকে নব্যভক্ত, ফুটবল বোদ্ধা থেকে নিজেকে ফুটবল বোদ্ধা জাহিরে চেষ্টা করা মানুষটি- সবাই নিজের দলের প্রতি বিশ্বস্ত, তাদের দলকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের চেষ্টায় মত্ত। শতভাগ বিশ্বাস আর পরিপূর্ণ আবেগের এক অসাধারণ মিশেল প্রতিটি মানুষের ভেতরে। কিন্তু কোথায় যেন আমাদের একটু সমস্যা রয়ে গেছে। যে স্বপ্ন আমরা ভেঙে গেলে ব্যথিত হই, যে স্বপ্ন পূরণে আমরা খুশি হই সে স্বপ্ন কি আদৌ আমাদের?
আমাদের দেশেও যে ফুটবল খেলা হয়, আমাদেরও যে একটা লীগ আছে। আমাদের আশেপাশেও যে কিছু ক্লাবভিত্তিক দল আছে। আমাদের কাছাকাছিও যে এমন অনেকে আছে যাদের একটু পরিচর্যা করলে আমাদের দেশের পতাকাকে আরো উপরে নিতে পারে। হয়তবা এমনও হতে পারে যে একদিন আমরা নিজের দেশের পতাকা টাঙ্গাচ্ছি ছাদে বিশ্বকাপের সময়! আমাদের কথায়, আড্ডায় কেন তারা জায়গা পায় না? আমাদের কথার সিংহভাগ জুড়ে অন্যদের নিয়ে কথা বলে অল্প কিছুও তো থাকতে পারত নিজেদের জন্য বরাদ্দ! কিন্তু কেন পুরোটাই তাদের দখলে? আমাদের স্বপ্ন কেন শুধু এমন যে আমরা এল ক্লাসিকো দেখতে যাব, ম্যানচেস্টার ডার্বি দেখতে যাব- কেন আমরা আমাদের দেশের ক্লাব ফুটবলের কোন দ্বৈরথ দেখতে যাব না! কেন আমরা শুধু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, জার্মানির খেলা দেখব মাঠে গিয়ে এমনটা ভাবি! কেন সেখানে লিস্টে বাংলাদেশের নামটা উল্লেখ নেই?
বাঙালির ফুটবলের প্রতি আবেগটা আছে, প্রচন্ড পরিমাণে আছে। ব্রাজিল নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার পরে জলে ভেজা চোখে চায়ের দোকানে যে মারামারি দেখেছি, মেসির হঠাৎ অবসরের পরে সবার মনে যে শুন্যতা দেখেছি, বারবার হারার পরেও বাঙালি আর্সেনাল সমর্থকদের যেমন আশায় বুক বাধতে দেখেছি, লিভারপুলের হারানো ঐতিহ্য ফেরার যে আশা এদেশের সমর্থকদের চোখে দেখেছি, এল ক্লাসিকোতে একের পর এক লজ্জাজনক হারের পরেও বাঙালিকে যেমন রাত জেগে বসে থাকতে দেখেছি টিভিসেটের সামনে, নতুন করে ফার্গিকে খোজার যে আশা আশেপাশের রেডদের চোখে আমি দেখেছি, দেখেছি যেমন ব্রাজিল আর্জেন্টিনা আবার প্রত্যাবর্তন করবে এই আশা তা প্রমাণ করে এ আবেগ মিথ্যা না। ফুটবলের প্রতি আমাদের আবেগটা বরাবরই ছিল, আছে এবং থাকবে। বাইরের দেশের কাউকে বিশ্বকাপের সময় এদেশে এনে ছেড়ে দিন ভাববে যেন এদেশেই এবারের আয়োজনটা! আবেগটা অনেক গাঢ় কিন্তু সেই আবেগের ছোঁয়াটা আমাদের নিজেদের দেশের ফুটবল পায় না, পায় না আমাদের ফুটবলাররা।
যে তারকারা সবার লক্ষ্য হয় তাদের তৈরি করে দর্শকরা। আর দর্শকদের মাঠে আনে মিডিয়া। খেলোয়াড় নিজে থেকেই কখনো তারকা হয় না। আমরা আমাদের দেশীয় তারকা তৈরি করি না, তাদের খবর রাখি না কিন্তু তাদের হারের জন্য জন্য দোষ দেই ঠিকই আবার তাদের ভালো করার জন্য গর্ববোধটাও বুকে ধারণ করি। সুদূর স্পেনের মাঠে দর্শক না থাকলে এল ক্লাসিকোটা আজ এই জায়গায় আসতো না। আমাদের দর্শকদের দোষ যে শুধু ব্যাপারটা তা নয়। আমাদের জানানোর কেউ নেই যে আমাদের কোন একটা টুর্নামেন্ট চলছে। পাশের দেশ ভারতেও যে লীগ চলছে তা আমরা জানি তাদের প্রচারণার মাধ্যমে। না জানলে মানুষ যাবে বা কেমনে মাঠে! ব্যর্থতা এক পক্ষের না আসলে অনেকের। অথচ এই ফুটবল দেখার জন্যই নাকি কোন এককালে বাংলাদেশে কত জমজমাট আসর জমে উঠত বলে শোনা যায়। উর্ধ্বস্থন কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা সাথে ক্রিকেটের হু হু করে উপরে উঠা নামিয়ে দিল ফুটবলের জনপ্রিয়তা। ফলে দেশের ফুটবল আজকের প্রজন্মের কাছে রূপকথার মতই শোনায়।
হ্যাঁ, আমাদের সেরকম মাঠ নেই, তেমন স্টেডিয়াম নেই, খেলার মানও তো অত ভালো না কিন্তু আমরা যদি চাহিদাটাই না দেখাই তাইলে কি আর সেই জায়গা থেকে আমাদের খেলার মান উঠবে কখনো? কোন কিছুই একদিনে তৈরি হয় না। সবাই মিলে আজ সময় দিয়ে আমরা নিজেদের আবেগের প্রয়োগ সঠিক দিকে করলেই পরবর্তী প্রজন্ম হয়তবা আবাহনী-মোহামেডানের খেলা দেখার অপেক্ষায় থাকবে, হয়তবা চায়ের কাপে ঝড় উঠবে বাংলাদেশের কোন নতুন প্লেয়ার এবার ইউরোপের মাঠে আগুন ঝরাবে? চলুন মাঠে যাই নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে নিজেরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাই। অনেক তো হল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ইউনাইটেড-আর্সেনালের স্বপ্ন পূরণ বা স্বপ্ন ভাঙা নিয়ে লাফালাফি। এগুলোর পাশাপাশি এবার না হয় নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাই!
- 0 মন্তব্য