• অন্যান্য

সীমানা পেরিয়েঃ পর্ব ২

পোস্টটি ২১৬৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

শারীরিক গড়নটা অ্যাথলেট হবার জন্য একেবারেই নিখুঁত। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করে ওলগা ফিকোতভা মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে বাস্কেটবল এবং হ্যান্ডবল, দুটোতেই খেলছিলেন জাতীয় দলের হয়ে। ইউরো বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপে দেশকে রানারআপও করেন একবার। পাশাপাশি মেধার স্বাক্ষর রেখে এমবিবিএস পড়ছিলেন প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু ২২ বছর বয়সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন ডিসকাস থ্রোতেই ক্যারিয়ার গড়বেন। তবে সাফল্য প্রথমেই হাতে ধরা দেয়নি। পোল্যান্ডে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ইভেন্টে ২৮ জনের মধ্যে ২৮তম হয়েই শেষ করেন। তবে ঘুরে দাঁড়ান খুব দ্রুত। চেকোস্লোভাকিয়ার জাতীয় শিরোপা জেতেন টানা দুবার। মাত্র ২ বছর পরেই অংশ নেন অলিম্পিকে। তেমন কোন উচ্চাশা ছিল না চেক তরুণীর, কেবল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গেমস থেকে দেশে ফিরে মেডিকেলের পড়াশোনা শেষ করতে হবে –এই তাড়নাই বরং ছিল বেশি।

গেমসের প্রথম দিনেই তাঁর ইভেন্ট। কোয়ালিফায়িং রাউন্ড থেকে কোনমতে উঠলেন ফাইনালে। সেখানেই করলেন বাজিমাত। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই ফেবারিট ইরিনা বেগ্লিয়াকোভা এবং নিনা পোনোমারিওভাকে পেছনে ফেলে ডিসকাস নিক্ষেপে ৫৩.৬৯ মিটার পেরিয়ে (নতুন অলিম্পিক রেকর্ড) জিতলেন স্বর্ণ। সেবার, গেমসে দেশের হয়ে একমাত্র স্বর্ণপদক ছিল ওলগারই।

মাত্র দু বছরে এই উত্থান চমক জাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তখন কে জানতো, ঐ অলিম্পিকেই অন্য এক গল্প রচনা করে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেবেন এই লাস্যময়ী চেক কন্যা।

গল্পের শুরুটা গেমস শুরুর আগের দিন, অনুশীলন শেষে ওলগা ফিরছিলেন ট্র্যাক থেকে। হঠাৎ মাটিতে পড়ে থাকা এক যন্ত্রের উপর পা হড়কে যায় তাঁর, হোঁচট খেয়ে পড়েই যান সামনে থাকা এক অ্যাথলেটের উপর। ঐ অ্যাথলেট শ্যামাঙ্গিনী সুন্দরীকে ধরে ফেলেন শক্তিশালী হাতে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। কিছুটা অপ্রস্তুত ওলগা যখন ওপর দিকে তাকালেন, দেখলেন টিশার্টে লেখা ‘ইউএসএ’। ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচিত হলেন একে অপরের সাথে। ঐ অ্যাথলেটের নাম হ্যারল্ড কনোলি, আমেরিকান হ্যামার থ্রোয়ার।

হ্যারল্ড ভিনসেন্ট ‘হ্যাল’ কনোলির জন্ম ১৯৩১ সালে, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে। মারাত্নক স্নায়ু বৈকল্যের শিকার হওয়ায় জন্মের সময়ই জীবনটা বদলে গিয়েছিল তাঁর। জন্ম থেকেই পুরোপুরি বিকশিত হতে না পারা বাম হাত শৈশবেও কয়েকবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাই শেষপর্যন্ত বাম বাহুটা আর ঠিকমত বেড়ে উঠেনি। ডান বাহুর চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ ইঞ্চি খাটো হয়েই থাকে, বাম হাতটা ছিল ডান হাতের দুই-তৃতীয়াংশের সমান। শৈশবটা হাসপাতালে বিকলাঙ্গ শিশুদের সাথে কাটানো হ্যারল্ড চেয়েছিলেন মুক্ত সমাজে স্বাভাবিক সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার। সেই প্রতিজ্ঞা থেকেই শুরু অ্যাথলেটিক্স ক্যারিয়ারের। কনোলি বাহুর দুর্বলতা মিটিয়েছিলেন প্রচণ্ড গতি এবং পায়ের পেশীশক্তি দিয়ে।

পরিচয়টা পেলেন, এবার আবার গল্পে ফিরে আসি! গেমসের প্রথম দিন নিজের ইভেন্টে তো চমক দেখালেন ওলগা। হ্যারল্ডের কি হল? 

ওলগার স্বর্ণ জেতার পরেরদিনই নামেন নিজের ইভেন্ট – গোলক নিক্ষেপে। পদক্ষেপ ঠিক রাখার জন্য ব্যালে জুতা পরে নেমেছিলেন ট্র্যাকে! পরে ওলগার মত তিনিও স্বর্ণ জেতেন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে। আলোকচিত্রীরা তাকে বিজয়োল্লাস অকরার জন্য দুহাত উপরে তুলতে বললেও কেবল ডান হাতটাই উঠিয়েছিলেন উপরে। নিজের স্বর্ণ জয়ে এতোটাই হতভম্ব ছিলেন যে, জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার পরও পতাকার দিকে না মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোজা হয়েই, পরে রৌপ্য পদকজয়ী রুশ অ্যাথলেট তাকে মৃদু নির্দেশে সোজা হতে সাহায্য করেন।

যে সময়টার কথা বলছি, সেটা ১৯৫৬, ঘটনাস্থল মেলবোর্ন অলিম্পিক। সেই অলিম্পিক শুরুর আগে থেকেই হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতির এক জ্বলন্ত কড়াই! সুয়েজ খাল সংকটের কারণে মিশর, ইরাক এবং লেবানন অংশ নিতে অপারগতা জানায়; হল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড গেমস বয়কট করে হাঙ্গেরি বিপ্লব চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোয়; তাইওয়ান খেলছে বলে আসতে রাজি হয়নি চীন। হাঙ্গেরি দল অলিম্পিক মার্চের সময় পতাকা থেকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট প্রতীক ছিঁড়ে ফেলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং হাঙ্গেরির হ্যান্ডবল সেমিফাইনাল ম্যাচ এতোটাই রক্তাক্ত ছিল যে, পরে তা পরিচিত হয় ব্লাড ইন দ্যা ওয়াটার ম্যাচ নামে। তাঁর উপর সময়টা স্নায়ুযুদ্ধের। সোভিয়েত ইউনিয়নের বানানো কমিউনিস্ট ব্লক – লৌহ সাম্রাজ্য এবং আমেরিকার গণতন্ত্রের বিরোধে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে যে কোন দিন এমন অবস্থা!

ঐ সময়ে কোন আমেরিকানের সাথে কমিউনিস্ট দেশের কোন নাগরিক কথা বলা তো দূরে থাক, হাত মেলানোই নিষিদ্ধ কাজের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু সব নিষেধের বেড়া ডিঙ্গানোর পণ করেছেন যেন দুজন। নিজেদের ইভেন্ট শেষ হবার পর, তেমন কাজ নেই আর। প্রতিদিনই শহর ঘুরে দেখা শুরু করলেন ওলগা-হ্যাল। যোগাযোগ করতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল তাঁদের, ওলগা ইংরেজি খুব ভালো জানেন না। হ্যাল জানেন না চেক ভাষা। তাই ভাঙ্গা ইংরেজি আর ভাঙ্গা জার্মানেই আড্ডা হচ্ছিল। কথা বলার জন্য মুখের ভাষা দরকার হয় না সবসময়, প্রয়োজন হয় হাসি, হাত মেলানো আর নিজেদের বুঝতে পারার হৃদয়।

একজন চেকোস্লোভাকিয়ার, আরেকজন আমেরিকার। স্নায়ুযুদ্ধের সময় বৈরি এবং বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক শাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেও তাঁরা বুঝতে পারছিলেন নৈতিকতা বোধ, আগ্রহের বিষয়, জীবন সম্পর্কে কৌতূহল প্রায় একই রকমের। বিভিন্ন দর্শন, চিন্তা নিয়ে কথা বলতে বলতে আরও কাছে আসতে লাগলেন দুই বিদ্রোহী তরুণ-তরুণী। বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে একটা সময় প্রেমের অনুভূতি তৈরি হল দুপক্ষ থেকেই। 

অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী জুটি যাদের ভালোবাসার শক্তি লৌহ সাম্রাজ্যকে ধ্বসিয়ে দিচ্ছিল, গেমসের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হওয়া সে প্রেমের সম্পর্ক চেকোস্লোভাকিয়া দলের কেউই হৃষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেনি। এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চেক কর্মকর্তাদের সাথে হ্যালের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরও হাত মেলানো তো দূরে থাক, কথা না বলে সরে যান তাঁরা। সেই তাচ্ছিল্য আর সমস্যাগুলোই আরও কাছে নিয়ে আসে দুজনকে।

একমাত্র স্বর্ণপদকজয়ী হিসেবে দেশে ফিরে একই সাথে প্রশংসা এবং তিরস্কারের মুখোমুখি হন ওলগা। বলা হয়, মেলবোর্ন থেকে ৫০% সম্মান এবং ৫০% লজ্জা নিয়ে এসেছেন তিনি, কারণ, এক আমেরিকান স্বৈরাচারীর সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সেখানে। অবশ্য নিজ দেশে সেরকম প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হয়নি হ্যালকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন ফস্টার ডুলিস ‘আমরা ভালোবাসায় বিশ্বাস করি’ বলে সমর্থন দেন এই সম্পর্ককে।  

অলিম্পিকের পর বারবার চিঠি আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে প্রেম এগিয়ে যাচ্ছিল তড়তড় করে। এক বছর গড়াতে না গড়াতেই আর তর সইল না হ্যালের। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে এসেছিলেন ইউরোপ সফরে, সেটা শেষ করে ওলগার সাথে দেখা করতে চলে এলেন প্রাগের বাড়িতে। এসেই দিলেন বিয়ের প্রস্তাব। ওলগাও রাজি হলেন সানন্দে।

রাজি হলেও বিদেশী নাগরিককে বিয়ে করার কাজি ডাকতে লাগে সরকারের বিশেষ অনুমতি। সেই উদ্দেশ্যে আবেদন করলেন ওলগা। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিলেও অনুমতি মিলছিল না। সেখানকার লোকজন তাকে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়। কিন্তু তারুণ্যের উত্তেজনায় বিদ্রোহী ওলগা কোন কিছুকেই বাঁধা মানলেন না।

হ্যালের পরামর্শে দুজনই আলাদা করে চিঠি লিখলেন প্রেসিডেন্ট অ্যান্তন যাপোতকির কাছে। সেই চিঠির জবাবও আসছিলো না। তখন সাহায্যে এগিয়ে আসেন বিখ্যাত অলিম্পিয়ান এবং চেকোস্লোভাকিয়ার জীবন্ত কিংবদন্তী এমিল জাতোপেক। প্রেসিডেন্টকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেন অনুমতি প্রদানে সাহায্য করার জন্য। তিনি শর্ত দেন, যদি ওলগা বিয়ের পরও চেকোস্লোভাকিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিজ্ঞা করে, তবে কথা বলে দেখবেন তিনি। দেশ আর ভালোবাসার টানে সবকিছু করতে রাজি ওলগা সেই প্রস্তাবে সায় দিলে আশীর্বাদ করে চিঠি লেখেন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে। কয়েকদিন পরই আশ্চর্যজনকভাবে বিয়ের অনুমতিপত্র মেলে। তবে কোন ধরণের আড়ম্বর না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

 

পর্ব ২ (2)

ফটোগ্রাফঃ বিয়ের অনুষ্ঠানে ওলগা-কনোলি (বামে), বেস্ট ম্যান এমিল জাতোপেক এবং ডানা জাতোপকোভা দম্পতি (ডানে উপরে) বড় ছেলে মার্ককে কোলে নিয়ে তাঁরা (ডানে নীচে)  

 

বিয়ে গোপন রাখতেই কোন ছুটির দিনে না রেখে বেছে নিয়েছিলেন বুধবার, জানতেন কেবল পরিবার আর হাতেগোনা কিছু মানুষ। কিন্তু খুব ছোট পরিসরের এই আয়োজন গণমাধ্যম জেনে যায়, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ভিড় করে সেই বিয়ে দেখতে। বর-কনের গাড়িটাই প্রাগ স্কয়ারে ঢুকতে পারছিল না মানুষের চাপে। রীতিমত উৎসবে পরিণত হয় দুই অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের এই বিয়ে। সেই বিয়েতে বেস্ট ম্যান এবং ব্রাইডমেটের ভূমিকায় ছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার স্বপ্নের অলিম্পিক জুটি এমিল জাতোপেক এবং ডানা জাতোপকোভা।

বিয়ের পর ওলগাকে নিয়ে হ্যারল্ড ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সময় প্রায় কর্পদকশূন্য অবস্থা নবদম্পতির, নিউইয়র্কে যাবার জাহাজ ভাড়া মেটাতে পুরষ্কার পাওয়া দামী এক গোলক বেঁচে দিতে হয় হ্যালকে। নিউইয়র্ক পোঁছানোর সময় দুজনের কাছে সর্বসাকুল্যে ছিল মাত্র ৩৫ সেন্ট। ইতিহাসের প্রাক্তন শিক্ষক হ্যাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগ দেন আর সংসার খরচ কুলাতে ওলগা বিখ্যাত বোস্টন গ্লোব পত্রিকার অফিসে ৪০০ ডলার পারিশ্রমিকে শুরু করেন পরিষ্কারকর্মীর কাজ!

তবে খুব দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হয়, মিডিয়া সেলিব্রিটিতে পরিণত হন দুজন। এড সুলিভান শো-তে ওলগাকে উদ্দেশ্য করে রোম্যান্টিক গান উৎসর্গ করেন বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী লুইস আর্মস্ট্রং। পরের বছর জুনে বিখ্যাত টেলিভিশন গেম শো To Tell the Truth –এ অংশ নেন দুজন। সেখানে, প্রত্যেকের পাশে ছিলেন দুজন করে নকল। এক বিচারক প্যানেলের কাজ ছিল, আসল জনকে খুঁজে বের করা। 

 

ক্যাপশনঃ টু টেল দি ট্রুথ অনুষ্ঠানের সেই এপিসোড! 

 

অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী দম্পতি কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন রোম অলিম্পিকের জন্য। ওলগা চেক অলিম্পিক কমিটির কাছে চিঠি পাঠান, জাতীয় আসর এবং অলিম্পিকে অংশ নেবার জন্য কি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাকে। ফিরতি চিঠিতে তাকে জানানো হয়, তিনি এখন আর চেকোস্লোভাকিয়ার নাগরিক হিসেবে বিবেচিত নন, যদি দেশে ফিরে এসে অনুশীলন, অংশগ্রহণ না করেন, তবে যেতে পারবেন না অলিম্পিকে।

অথচ দেশত্যাগের সময় কোন পাসপোর্টই দেওয়া হয়নি তাকে, কেবল একটি অনুমতিপত্র ইস্যু করা হয়। পরে ওয়াশিংটনের চেক এমব্যাসিতে যোগাযোগ করলে পাসপোর্ট বা ভিসা কোনটাই দেওয়া হয়নি তাকে। তাই ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়া থেকে হন বঞ্চিত।

স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত ওলগা শেষপর্যন্ত আবেদন করেন মার্কিন নাগরিকত্বের, সেটা মেলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হয়েই অংশ নেন রোমে। সেখানে, স্বদেশী কোন অ্যাথলেটই ক্ষোভের চোটে কথা বলেনি তাঁর সাথে, এমনকি একজন থুতুও ছুঁড়ে মারেন তাঁর দিকে। তবে এই ঘটনার পর আরও ৩ অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ওলগা সত্যটা জানতে পারেন মেক্সিকো অলিম্পিকে এসে। সেখানে, চেকোস্লোভাকিয়া দলের বেশ কজন অ্যাথলেট তাকে জানায়, অলিম্পিক কমিটি ওলগাকে দেশের হয়ে খেলার জন্য প্রস্তাব দিলেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি! অথচ উল্টোটাই ছিল সত্যি। পরে তিনি নিজের ঘটনা খুলে বলেন তাদের। দেশ ছাড়ার পর ৫০ বছরে আর ডাকা হয়নি ওলগাকে। পরে ২০০৬ সালে চেক অলিম্পিক কমিটি তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফেয়ার প্লে এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে।

১৯৬৮ সালে হ্যারল্ড কনোলির সাথে সাড়াজাগানো সম্পর্ক নিয়ে ওলগা লেখেন বেস্টসেলার বই - The Rings of Destiny

 

পর্ব ২ (3)

ফটোগ্রাফঃ মিউনিখ অলিম্পিক মার্চপাস্টে ওলগা (বামে), রোম অলিম্পিকে বায়স্কোপ দেখছেন ওলগা-হ্যারল্ড দম্পতি (ডানে উপরে) টোকিও অলিম্পিকে হ্যারল্ডের গোলক নিয়ে পোজ দিয়েছেন দুজন (ডানে নীচে)  

 

ওলগা কনোলি নাম নিয়ে মেলবোর্নের পর আরও ৪ অলিম্পিকে অংশ নিলেও কোনবারই পদক তালিকায় মেলেনি স্থান, তবে আমেরিকার জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে শিরোপা জেতেন ৫ বার। ১৯৬৮ সালে অবসর নিলেও ১৯৭২ সালে ৩৯ বছর বয়সে প্রত্যাবর্তন করেই ভাঙ্গেন এক যুগেরও বেশি পুরনো জাতীয় রেকর্ড। ক্যারিয়ার সেরা ৫৭.৬১ মিটারের রেকর্ডটা টিকেছিল আরও ১৭ বছর। অলিম্পিকে আমেরিকার পতাকা বহন করেন মিউনিখ ’৭২ অলিম্পিকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ব্যাপক সমালোচনা করায় অলিম্পিক কমিটির অনেক সদস্যই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু সতীর্থদের সমর্থনে প্রথম নারী হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেন ওলগা। পরে কাজ করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিক্স দলের ফিটনেস কোচ হিসেবে। পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করে যাচ্ছেন এখনো।

কনোলিও ছিলেন দারুণ সফল। পরে ১৯৬০, ৬৪, ৬৮ তিন অলিম্পিকেই অংশ নেওয়া হ্যাল ১৯৫৬-৬৫ সালে নিজের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙ্গেন ৭ বার। টানা ১০ বছর বিশ্বরেকর্ড দখলে ছিল তাঁর। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ৯ বার আউটডোর এবং ৩ বার ইনডোর শিরোপা জেতেন তিনি। সাথে ১৯৫৯ প্যান আমেরিকান গেমসের রৌপ্য পদক। দায়িত্ব পালন করেন সান্তা মনিকা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে, মার্কিন জুনিয়র দলের কোচও ছিলেন বেশ কিছুদিন, পরে টানা ১১ বছর স্পেশাল অলিম্পিকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে আমেরিকার ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড হল অফ ফেমে জায়গা পান কনোলি।

১৭ বছর সংসার করার পর ১৯৭৫ সালে বিচ্ছেদ হয়ে যায় ৪ সন্তানের জন্ম দেওয়া এই দম্পতির। হ্যাল-ওলগা জুটির বড় ছেলে মার্ক বাস্কেটবল, বক্সিং দুটোই খেলছেন সমানতালে। ছোট ছেলে জিম জাতীয় ডেকাথলেট দলে এবং বড় মেয়ে মেরেজা জাতীয় ভলিবল দলের হয়ে খেলেছেন। খেলাধুলার সাথে জড়িত না থাকা একমাত্র সন্তান নিনা শিল্পী হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। নিনার নাম রাখা হয় ওলগাকে ডিসকাস স্পেশালিষ্ট হতে সাহায্য করা সোভিয়েত প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বন্ধু নিনা পোনোমারিওভার নামানুসারে।

১৯৭৬ সালে স্বদেশী অলিম্পিয়ান প্যাট উইন্সল’কে বিয়ে করেন হ্যারল্ড, তবে আর ঘর বাঁধেননি ওলগা। ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট মেরিল্যান্ডের বাড়িতে জিম করার সময় হঠাৎ দম হারিয়ে মেঝেতে মাথা ঠুকে যায় হ্যারল্ডের। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় তাঁর।

কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসার পথ কখনোই মসৃণ হয় না, কণ্টকময় পথেই চলে। ওলগা আর হ্যারল্ডের জন্য তা ছিল আরও জটিল। কিন্তু তাঁরা অলিম্পিকে কোন রাজনৈতিক শাসনের প্রতিনিধি হিসেবে আসেননি, এসেছিলেন মানবতার প্রতীক হয়ে! সেটাই ১৭ বছর ধরে প্রমাণ করে গেছেন ট্র্যাকে, কখনো ভিনদেশে, কখনো বা গল্পের মত মনে হওয়া বাস্তব জীবনের প্রতিটি পাতায়!