মুভি : এম এস ধোনীর না-বলা গল্প
পোস্টটি ৩০৮৫ বার পঠিত হয়েছেআমি সিনেমা-টিনেমা কম দেখি। তাই সিনেমার ভাল দিক, মন্দ দিক আলোচনা করতে যাবো না। আমি শুধু আমার মতামতটাই তুলে ধরার চেষ্টা করবো, কেমন লেগেছে সেটাই জানাবো। আমার ভাললাগার সাথে অনেকের ভাললাগা/মন্দলাগা নাও মিলতে পারে।
ঝাড়খন্ডের ঝাঁকড়া চুলের তরুণ। অভিষেকটা ঢাকায় হলেও, প্রথম আলো ছড়িয়েছেন অন্ধ্র প্রদেশে গিয়ে বিশাখাপত্তমে। প্রথমবারের মতো ঝাঁকড়া চুলের তরুণটিকে, সেবারই ভালভাবে লক্ষ করা। তারপর উত্তরোত্তর তাঁর আলো আরো ছড়ালো। ২০০৭ সালে প্রথম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে গিয়ে, লক্ষ ফ্লাইড লাইটের আলো ছড়ানোর মতো ছড়িয়ে দিলেন তাঁর আলো। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে শুরু হলো নতুন এক যুগের, নতুন এক অধ্যায়ের। সেই ধোনী-যুগ এর ব্যাপ্তি এখনো আছে, যদিও কিছুটা গুটিয়ে গেছে, কমে এসেছে তাঁর শুরুর সেই জ্যোতি, তবু ধোনী-যুগের পর্দা নামেনি এখনো। অবসানও ঘটেনি।
ঝাড়খন্ডের সেই মাহেন্দ্র সিং ধোনীই সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী হলেন, রুপালী পর্দায় উঠে এলেন। তাঁর উত্থান, তাঁর সাফল্য, তাঁর কীর্তি যে কোন বলিউডের সিনেমার গল্পকেই হার মানাতে পারে। অবিশ্বাস্য সব কৃতিত্বের রুপকার তিনি, তাই তাঁর জীবনী নিয়ে সিনেমা হয়েছে, তাতে আর আশ্চর্য্যের কি!
মধ্য কৈশোরে একটা ধোনী-মোহে আটকা পড়েছিলাম। তাঁর সবকিছুই ভাল লাগত। ফিল্ডিং চেঞ্জ, বোলার চেঞ্জ, জুয়া-ফাটকা, হঠাৎ ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে প্রমোশন দেয়া... সবই যেন অদ্ভুত এক ভাললাগা! ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের তখন পর্যন্ত সেরা দলনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলিকে বিদায়ী ম্যাচে ‘ক্যাপ্টেন্সি’ দিয়ে ফেয়ারওয়েল দেয়া, তাকে আমার কাছে করে তুলেছিল অনন্য, অসাধারণ। মোহ, ঘোর, বিভ্রম ব্যাপারগুলো একধরণের স্বপ্নের মতো, তাই একটা সময় কেটে যায়। আমারও তাই ধোনী-ভ্রম একটা সময় কেটে গিয়েছিল। আইপিএলে তাঁর কেলেংকারী-কীর্তি গুঞ্জন শুনে, আর মুস্তাফিজ-ধাক্কা, ভাললাগার বদলে তাঁর প্রতি তৈরী করেছে এক ধরণের বিতৃষ্ণা।
সে যাই হোক, ছবির কথাই আসি। ধোনীর প্রতি বিতৃষ্ণা থাকলেও ছবিটা দারুণ লেগেছে। মূল চরিত্র সুশান্ত সিং রাজপুত এক কথায় দুর্দান্ত। ধোনীর হাঁটা-চলা থেকে হাত ঘুরিয়ে ব্যাটিং-স্ট্যান্স নেয়া পর্যন্ত... সব হুবহু কপি করেছেন তিনি। ছবির শুর হয়েছে ওয়েংখেড়ে ফাইনাল দিয়ে, শেষও তা-ই দিয়ে। ছবির শুরুতে দেখা যায়, ধোনী হঠাৎ উঠে এসে কোচকে বলছেন, ‘গ্যারী, উইকেট পড়লে আমি নামব।’
‘যুবি প্যাড পড়ে তৈরী আছে তো!’
‘ওকে হোল্ড করতে বলো, আমিই নামবো।’
‘তুমি নিশ্চিত?’
‘হুম।’
ব্যস! এরপর কাহিনী চলে যায় প্রায় ত্রিশ বছর পেছনে। ১৯৮১ সালে। ধোনী জন্মগ্রহন করেন। তারপর তাঁর বেড়ে উঠা, ক্রিকেটার হওয়া এসব দেখানো হয়। মজা লেগেছে অনুর্ধ্ব-১৯ এর বিহার বনাম পাঞ্জাবের লড়াই দেখানো ম্যাচটা। ১৯ বছরের যুবরাজকে দেখানো হয় এখানে। যিনি থ্রীপল করেন। অ-১৯ বিশ্বকাপেও জায়গা পান, ধোনী পান না।
আশ্চর্য্য নির্লিপ্ত, অদ্ভুত নির্বিকার ধোনীর যে রুপ আমরা দেখি, তা-ই দেখানো হয়েছে এখানে। যিনি জাতীয় দলে ডাক না পেলেও, কোন বিকার দেখান না। ডাক পেলেও কেমন ভাবলেশহীন!
দারুণ একটা ব্যাপার আছে এখানে। জীবন এক জায়গায় থেমে গেছে, আর এগোচ্ছে না। স্থির-জীবনে ধোনী কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়েন। তখন তিনি যে শিক্ষাটা পান... অসাধারণ।
হতাশাগ্রস্থ ধোনীর সাথে এ কে গাঙ্গুলীর কথোপকোথনটা ছিল এরকম, এ কে গাঙ্গুলী বলছেন, ‘তুমি ফুলটস পেলে কি করো?’
ধোনী জবাব দেন, ‘হিট করি।’
জুসি হাফ ভলি পেলে?
ড্রাইভ করি।
ভাল আউট সুইংগারে?
ছেড়ে দিই।
ভাল ইন সুইংগারে?
ডিফেন্স করি।
আর যদি আনপ্লেয়েবল বাউন্সার পাও?
ডাক করি।
সেটাই। এখন তোমার জীবনে আনপ্লেয়েবল বাউন্সার আসছে। ছেড়ে দাও। জীবন মুভ করবে, স্কোর করে নিতে পারবে। এত টেনশনের কিছু নেই।
আমাদের নাসির-মুমিনুলদেরও বলতে ইচ্ছে হয়, হতাশ হয়ো না। আনপ্লেয়েবল বাউন্সার গুলো ছেড়ে দাও। অবশ্যই সময় আসবে তোমারও। একটু ধৈর্য্য ধরো, অপেক্ষা করো।
আরেকটি ব্যাপার দারুণ লেগেছে। ধোনী তখন ক্যাপ্টেন। অস্ট্রলিয়া (২০০৮ এর সিভি সিরিজ বোঝানো হয়েছে, সম্ভবত) থেকে টিম সিলেক্টরদের সাথে টেলি কনফারেন্সে তিনজন সিনিয়র প্লেয়ারকে বাদ দিতে বললেন। জানালেন এইজটা সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে ফিটনেস। একটা ব্যাটসম্যান এক ম্যাচ রান করবে, অন্য ম্যাচ হয়তো করবে না। একটা বোলার উইকেট পেলো বা পেলো না। কিন্তু একটা ফিল্ডার প্রতি ম্যাচেই আপনাকে রান সেইভ করে দেবে।
দ্যাটস এ গুড পয়েন্ট।
ক’দিন আগে আমাদের আল আমিন কে বাদ দেয়া হয়েছিল, বলা হলো, ফিল্ডিং সমস্যা। এটা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। ফিল্ডিংটা আসলেই একটা সমস্যা, এটাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। হ্যাঁ, আল আমিনের বদলে যাকে নেয়া হলো, তাঁর এমন কি আহামরি ফিল্ডিং, কিংবা বোলার আল আমিনের কি ক্যাপাবিলিটি আছে, এসব নিয়ে আমার কোন কথা নেই। আমার কথা হলো, আল আমিনের ফিল্ডিং সমস্যাটা আসলেই কাটিয়ে উঠা উচিৎ। একটা ম্যাচে ফিল্ডিং অনেকখানি এগিয়ে এবং পিছিয়ে দিতে পারে। ক্রিকেট ইতিহাসে, ব্যাটিং-বোলিংয়ে তেমন কোন অবদান ছাড়া শুধুমাত্র ফিল্ডিং দিয়ে ম্যাচসেরা হওয়ারও নজির আছে।
আচ্ছা, সেসব কথা থাক। সিনেমায় ফিরে আসি আবার।
নায়িকা চরিত্রে, দিশা পাটানি ও কিয়ারা আদভানি দুজনই ভাল করেছেন। স্বাক্ষীর আগে যে ‘প্রিয়াংকা’ নামে কেউ একজন ধোনীর জীবনে ছিলেন, সেটা জানা ছিল না। স্বাক্ষীর সঙ্গে পরিচয়ের ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। মনে হয় কোথাও পড়েছিলাম, ঠিক মনে নেই। তবে ভিজুয়ালাইজেশনে দেখে স্বাক্ষী-ধোনীর ‘প্রথম পরিচয়’ মজার লেগেছে বেশ।
দুজনের মধ্যে ব্যাক্তিগতভাবে আমার বেশী ভাল লেগেছে ‘প্রিয়াংকা’ চরিত্র করা দিশা পাটানিকে। সেটা তাঁর এ্যাকটিং ক্যাপাবিলিটির জন্য নাকি বিউটি, বলা কঠিন!
বেশ দীর্ঘ সময়ের সিনেমা, তিন ঘন্টারও বেশী ব্যাপ্তিকাল। হয়তো বায়োগ্রাফি বলে। প্রথম অংশে ক্রিকেটটা বেশী থাকলেও, দ্বিতীয় অংশে রোমান্সও বিশাল একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। ধোনীর না-বলা গল্প বলেই হয়তো ২০০৫-২০১১ পর্যন্ত ক্রিকেটটা অত বেশী ফোকাসে আসেনি। ব্যাক্তি জীবনের ধোনী, আরো বিশেষ করে বললে, প্রেমটাই বেশী জায়গা করে নিয়েছে।
মিউজিক তো দুর্দান্ত! বাবা চরিত্রের অনুপম খেরের কথা কিছু কি বলার দরকার আছে? মা, বড় বোন চরিত্রে ভূমিকা চাওলা, ধোনীর বন্ধুরা, স্পোর্টস টিচার... সবাই দারুণ ছিলেন। পরিচালক বেশ যত্ন নিয়ে কাজটি করেছেন, মনে হয়েছে। মেকাপ থেকে শুরু করে ছোট ছোট অনেক ব্যাপার দারুণভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।
সব মিলিয়ে বলবো চমৎকার একটি সিনেমা হয়েছে। ভাললাগার মতো একটা সিনেমা। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়।
এই সিনেমার আইএমডিবি রেটিংও অবশ্য বেশ ভালো, ৮.৬/১০।
শেষে আবারও বলছি, আমি সিনেমা কম দেখি। তাই এটা ঠিক রিভিউ কিংবা মুভি-সমালোচনা নয়।
বরং একজন ক্রিকেটারের আজকের পর্যায়ে উত্তোরণের পেছনের গল্প, কিছুটা হলেও জানার অভিজ্ঞতা।
- 0 মন্তব্য