বিদায় ট্রফির যাদুকর!
পোস্টটি ৪৬৬৬ বার পঠিত হয়েছে১
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ড্যানিয়েল পাসারেলা, দিনো জফ, দিয়েগো মারাদোনা, লোথার ম্যাথাউস, দুঙ্গা, দিদিয়ের দেশমে, কাফু, ফ্যাবিও ক্যানাভারো, ইকের ক্যাসিয়াস, ফিলিম লাম......ফুটবল ইতিহাসের কিংবদন্তীতুল্য সব নাম। আচ্ছা, বলুন তো এদের মধ্যে মিলটা কি?
হ্যাঁ, একটু ভাবলেই যেই উত্তরটা মাথায় আসবে – সবাই বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। এবার, আরেকটা প্রশ্ন করি। প্রত্যেকেই বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ দারুণ গর্বে যে ট্রফিটা মাথার উপর তুলে ধরেছেন, সেই ট্রফিটা কার বানানো বলুন তো?
মনে পড়ছে কি? পাঠককে বিরক্ত না করে উত্তরটা বলে দিই বরং। মানুষটার নাম সিলভিও গাজ্জানিগা; সারাজীবন ইতালির মিলান শহরে কাঁটিয়ে দেওয়া ভদ্রলোকের জন্ম ১৯২১ সালে রোজনেরি আর নেরাজ্জুরি ডাকনামে পরিচিত দুই ইতিহাস বিখ্যাত ফুটবল ক্লাবের শহরেই।
লোম্বারডি রাজ্যের রাজধানী মিলানের বিভিন্ন আর্ট স্কুলে শিখতে শিখতে ভাস্কর হয়ে ওঠা। প্রথম পদক নকশা কৈশোরেই, পরের ৩ দশক কাটে অলংকার এবং স্কি ট্রফি নকশা করার মধ্য দিয়ে। একটা সময় মিলানের বিখ্যাত ট্রফি নির্মাতা কোম্পানি বার্তোনির সৃজনশীল পরিচালক পদে আসীন হন।
ফটোগ্রাফঃ নকশার সাথে রেপ্লিকা ট্রফি হাতে গাজ্জানিগা
২
১৯৭০ সালের জুলে রিমে কাপ। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ঘোষণা করা হয়েছে, নতুন এক নিয়ম। যেসব দল দুবার করে শিরোপা জিতেছে, তাদের কেউ যদি তৃতীয়বার জিততে পারে, চিরকালের জন্য সেই দেশের অধিকারে চলে যাবে জুলে রিমে ট্রফি। সেই সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করতেই যেন ফাইনালে উঠল ১৯৩৪ ও ’৩৮ আসরের বিজেতা ইতালি এবং ১৯৫৮, ’৬২ আসরের শিরোপা জয়ী ব্রাজিল। একদিকে ফ্যাচেত্তি, রিভেরা, ম্যাজোল্লার ইতালি, আরেকদিকে পেলে, জোয়ারজিনহো, কার্লোস আলবার্তোর ব্রাজিল। ক্লাসিক ফাইনালে দারুণ শৈল্পিক ফুটবল খেলা ব্রাজিল ৩য় শিরোপা জিতল ৪-১ গোলে। কার্লোস আলবার্তো শেষ অধিনায়ক হিসেবে ফরাসী ভাস্কর আবেল লাফ্লিওরের নকশা করা ট্রফিখানা যখন মাথার উপরে তুলে ধরলেন, তখন থেকেই চিন্তায় পড়লেন ফিফা কর্মকর্তারা। ৪ বছর পরের বিশ্ব আসরের জন্য তো নতুন ট্রফি লাগবে। কিভাবে মিলবে সেটা?
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল জুরিখে ফিফা প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যানলি রিউসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করা হয় নতুন ট্রফির জন্য নকশা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে। সেই কমিটি আহ্ববান করে নকশা প্রতিযোগিতার। খবর পেয়েই গাজ্জানিগা শুরু করলেন কাজ। টানা কয়েকদিন নির্ঘুম কাজ করার পর যে নকশাটা দাঁড়ালো, তা দারুণ সুন্দর হলেও জুরি কমিটির কাছে এটাকে বিশ্লেষণ করা অসম্ভব হয়ে যাবে বুঝতে পারলেন তিনি। তাই জমা দেওয়ার সময় প্লাস্টার মডেল সহই পেশ করলেন কমিটির কাছে। ২৫ দেশ থেকে সর্বমোট ৫৩টি নকশা জমা পড়লেও দর্শন, প্রতীকী সৌন্দর্য আর ফটোজেনিক হওয়ায় ফিফা কমিটি গাজ্জানিগার নকশাটাই সেরা হিসেবে বিবেচনা করে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে গাজ্জানিগা ঐ মডেল অনুযায়ী নতুন করে স্বর্ণ দিয়ে ঢালাই করে ট্রফি বানিয়ে দিলে ফিফা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে।
ফটোগ্রাফঃ ইউয়েফা কাপ, বেসবল বিশ্বকাপ, ফিফা বিশ্বকাপ, ইউয়েফা সুপার কাপের সাথে গাজ্জানিগা
৩
ট্রফিটা কেমন?
সেরা পার্সা (হারানো মোম) নামের কৌশল দিয়ে কাপটা ঢালাই করা হয়, এই কৌশলেই কয়েক হাজার বছর আগে প্রাচীন কিছু বিখ্যাত ধাতব স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়। ১৪.৫ ইঞ্চি লম্বা এই ট্রফি ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি হলেও ওজন মাত্র সাড়ে ৬ কেজি। কারণ, এর ভেতরটা ফাঁপা।
ইউরোপের বিভিন্ন সেরা ফুটবল প্রতিযোগিতার রূপার তৈরি মসৃণ শিরোপার তুলনায় দারুণ সজ্জিত, আনন্দের দুর্নিবার বহিঃপ্রকাশ আছে যেন সেই ট্রফিতে। চ্যাম্পিয়নের হাত দুটি যেন বাকি সব প্রতিযোগীর হাত দ্বারা আবৃত, সূর্যের আলো পৃথিবীর বক্রতায় যেন প্রতিফলিত হচ্ছে ধিকিধিকি আগুনের মত।
ট্রফিতে দুইটি ভিন্ন রেখা ধীরে ধীরে দুজন মানুষের আকার ধারণ করেছে – মানুষ দুজন দুই নায়কের প্রতীক; কারণ, ফুটবল খেলা হয় দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে। জয়ের অভিলাষে দুইটি ভিন্ন ইচ্ছাশক্তি একসাথে কাজ করে, শক্তি, বেগ, সামর্থ্য, গতিশীলতা, দ্রুততা, গতি, সাফল্য, বিজয় – সবকিছু মানুষকে ছাপিয়ে বিশ্বকে জয় করার দিকে আলিঙ্গন করে।
৪
মজার বিষয় হল, ফিফার নকশা প্রতিযোগিতার নিয়মাবলীতে উল্লেখ ছিল, বিজয়ী নকশার উপর নকশাকারের কোন অধিকার থাকবে না, তাই গাজ্জানিগা কখনোই নিজের বানানো ট্রফির ইমেজস্বত্ব থেকে কোন আয় করতে পারেননি। কিন্তু এই ইতিহাস বিখ্যাত সৃষ্টিকর্মের আন্তর্জাতিক সাফল্যের ভেলায় চড়ে এই শিল্পী গুরুত্বপূর্ণ সব ক্রীড়া আসরের ট্রফি নকশা করার দায়িত্ব পান। ১৯৭২ সালে করেন ইউয়েফা কাপের নকশা, পরের বছর ইউয়েফা সুপার কাপও নির্মিত হয় তাঁর করা নকশাতে। বেসবল, ববস্লেড এবং ভলিবল বিশ্বকাপের ট্রফিও তাঁর হাতে গড়া। অর্জনের তালিকায় আছে - বাস্কেটবল, সাঁতার এবং স্কি বিশ্বকাপের মেডেলের নকশাও!
এসব করতে করতে ডাকনামই হয়ে যায় ‘মিঃ কাপ’। কিন্তু কোনটাই ঘূর্ণায়মান স্বর্ণনির্মিত বিশ্বকাপের চেয়ে আইকনিক হতে পারেনি, কর্দমাক্ত শরীরে ঘর্মাক্ত হাতে যত ফুটবলারই এটা তুলে ধরুক না কেন, এটা অনন্য সুন্দর হয়ে থাকে।
ইতালি প্রজাতন্ত্রের একত্রীকরণের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ ট্রফিও নকশা করার সম্মান পান তিনি। মিলান শহরের বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সম্মান আমব্রোজিনো ডি’অরো পদক পান ২০০৩ সালে। ২০১১ সালে ভূষিত হন আন্তর্জাতিক মুদ্রা এবং পদক নকশাকার সংগঠনের আজীবন সম্মাননায়। ২০১২ সালে পান ইতালির সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক অর্ডার অফ মেরিট অফ ইতালি। ৬০ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন জীবনের প্রেম এলসাকে, জর্জিও এবং গ্যাব্রিয়েলা নামের দু’সন্তান আছে এই দম্পতির পরিবারে।
গাজ্জানিগার দেশ ইতালি ১৯৩৪ এবং ১৯৩৮ সালে পরপর দুবার বিশ্বকাপ জিতলেও তেমন কোন স্মৃতি ছিল না দারিদ্র্য সমস্যায় নিমজ্জিত থাকা তরুণ ভাস্করের। তবে ১৯৮২ এবং ২০০৬ সালে স্টেডিয়ামে বসেই স্বদেশীদের হাতে উঠতে দেখেছেন নিজের গড়া ট্রফি।
চিরবিনয়ী মানুষটাও নিজের সেরা সৃষ্টি নিয়ে উচ্ছ্বাস ঢেকে রাখতে পারেননি ২০১১ সালে বিবিসিকে দেওয়া ইন্টারভ্যুতে।
“খেলোয়াড়রা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পারে, জিততে পারে একবার, খুব ভাগ্যবান হলে দুবার। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি সবসময়ই আমার হয়ে থাকবে, আমি সত্যিকারের বিজয়ী।”
গত ৩১ অক্টোবর ঘুমন্ত অবস্থায় ছুটি নিয়েছেন মর্ত্যলোক থেকে। তবে হ্যাঁ, সত্যিকারের বিজয়ী হিসেবেই বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে, অনিন্দ্য সব সুন্দরের স্বাক্ষর রেখে!
- 0 মন্তব্য