• ক্রিকেট

ভারতে বিরাট যুগের সূচনা?

পোস্টটি ১২০০৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 ১

২০০৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে এক ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে তাঁর। শুনতে পান বাবা আর নেই। মুহূর্তেই কি পুরো দুনিয়া দুলে উঠেছিল? মিছে মনে হয়েছিল সব? হয়তো, হয়েছিল। হওয়ারই তো কথা।

তিনি তখন দলের সাথে। রঞ্জী ট্রফিতে খেলছেন দিল্লীর হয়ে, কর্নাটকের বিপক্ষে। ৪৪৬রানের জবাব দিতে নেমে দল ৫৯রানেই হারিয়ে বসেছে পাঁচ উইকেট! দ্বিতীয় দিন শেষ করেছেন ৪০ রানে অপরাজিত থেকে।

একদিকে বাবার শেষকৃত্য অন্যদিকে দলের তাকে দরকার। কি করবেন তিনি? পোড় খাওয়া অনেকেই যেখানে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন, সেখানে তাঁর তো মাত্র আঠারো বছর বয়স! দল ও পরিবার তাঁর উপর ছেড়ে দিল ভার, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁর। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, খেলবেন। পরদিন পাথরচাপা বুকে প্রায় পাঁচঘন্টা ধরে ২৩৮ বল খেলে, ৯০ রানের ইনিংসটি দিয়ে নিশ্চিত করলেন দলের নিরাপদ অবস্থান।

ম্যাচ শেষ করে তবেই যোগ দিলেন, প্রিয় বাবার শেষকৃত্যে।

দলের যে কোন কঠিন সময়ে, কঠোর হাতে বুক চিতিয়ে যে তিনি লড়াই করেন, হয়তো সে শিক্ষা এখান থেকেই পাওয়া। যিনি পিতার মৃত্যুর শোক-চাপ সামলে এমন ইনিংস বিনির্মাণ করতে পারেন, তাঁর কাছে তো অন্যসব চাপ নস্যি হওয়ার কথা!

এই ঘটনা থেকে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, বিরাট কোহলির হার না মানা মানসিকতা কোন পর্যায়ের! দলের প্রতি নিবেদন, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা কোন মাত্রার!

 

২০০৮ সালের ২রা মার্চ, কুয়ালালামপুর। যুব বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে ভারত-দক্ষিন আফ্রিকা। বিরাট কোহলী, ভারতীয় যুব দলটির দলনায়ক।

দক্ষিন আফ্রিকার দরকার ২ বলে ১৩ রান। সেই ওভারের পঞ্চম বলটিতে রান হলো না, তাতেই যুবদলটির সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। সাথে সাথেই দলনায়ক ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে শান্ত ও চুপ থাকার নির্দেশ দিলেন। আর শেষ বলটি হতেই উদ্দাম উল্লাসে ফেটে পড়লেন সবাই। বলাই বাহুল্য, সেই উল্লাসে নেতৃত্ব দিলেন হাতে আঙ্গুল রেখে চুপ থাকার নির্দেশ দেয়া বিরাট কোহলিই।

87871

২০০৬ থেকে ২০০৮, আঠারো থেকে সাড়ে উনিশেও বিরাট কোহলির পরিণত বোধ, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, দলের প্রতি নিবেদন, ক্রিকেটের জন্য সর্বস্ব উজার করে দেওয়া, খেলাটার প্রতি ভালোবাসা... উত্তরোত্তর বেড়েছে শুধু। সময় যত গড়িয়েছে, বয়স যত বেড়েছে, এসবের সাথে সাফল্যের ক্ষুধাও তাঁর বেড়ে গেছে।

তাই তাকে আগামীর নেতা হিসেবে ভাবতে ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকদের কোন সমস্যায় হয়নি।

 

৯ই ডিসেম্বর ২০১৪, এডিলেইড ওভাল, অস্ট্রেলিয়া। নিয়মিত অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনীর পরিবর্তে দলের নেতৃত্বভার তাঁর কাঁধে। বোর্ডার-গাভাস্কার সিরিজের প্রথম ম্যাচে শুরুটা ভালো হলো না, টস হারলেন। চাপা পড়লেন স্বাগতিকদের বিশাল রানের নীচে। কিন্তু একটুও চাপ অনুভব করলেন না তিনি, নেতৃত্বের অভিষেক ইনিংসেই খেললেন ১১৫ রানের ঝকঝকে ইনিংস। রান পাহাড়ের জবাবটাও ভালোই দিলেন।

প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও অস্ট্রলিয়াকে অল আউট করতে পারল না তাঁর বোলাররা। পঞ্চম দিনের শুরুতে ৩৬৪ রানের টার্গেট পেলেন। হয় সারাদিন কাটিয়ে দাও, নয় তাড়া করো অসম্ভব সে লক্ষ্য। শেষ দিনের উইকেটে ওভারপ্রতি সাড়ে তিনেরও বেশী রান, অসম্ভব নয়তো কি?

‘অসম্ভবরে আমি বেসেছি ভালো’ বলে বিরাট কোহলি ছুটলেন সেই অসম্ভবের পেছনেই। কিন্তু পারলেন না, হেরে গেলেন। তবে ‘অসম্ভব’রে ভালোবেসে, বীরত্বপূর্ণ ১৭৫ বলে ১৪১ রানে যে শ্রদ্ধা ও বাহবা পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর হার কে হার বলার জো ছিল না, কোনমতেই। বরং সে-ও এক জয়, সাহসের জয়। ক্রিকেটের জয়। টেস্টের জয়।

200729

সেই সিরিজের তৃতীয় টেস্ট শেষে সাদা পোষাককে বিদায় বলে দিয়েছিলেন এমএস ধোনী। তারপর দলের পরিপূর্ণ দায়িত্বভার উঠল তাঁরই কাঁধে। ড্রেসিংরুম থেকে মাঠ পর্যন্ত একচ্ছত্র যেন তাঁরই নেতৃত্ব।

সিরিজের চতুর্থ ও শেষ টেস্টে, সিডনীতেও সেঞ্চুরী পেয়েছিলেন। সেবার আর হারেননি। ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন।

 

অধিনায়কত্বের প্রথম তিন ইনিংসে তিনটি সেঞ্চুরী দিয়ে তাঁর যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা চলছে এখনো। অধিনায়ক হয়ে কুড়িটি টেস্ট খেলে ‘ষাট’ গড়ে করেছেন ১৮৬১ রান। চারটি ফিফটি, সেঞ্চুরী সাতটি। দ্বিশতকও আছে দুটি। অথচ ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৮.২৮। নেতৃত্ব পাওয়ার আগে যা ছিল চল্লিশের দোরগোড়ায়। সেখান থেকে তাঁর এমন অবিশ্বাস্য উত্তরণ কি ইংগিত দেয়? তিনি নেতৃত্ব, চাপ এসব উপভোগ করেন?

মাত্র কুড়ি টেস্টেই বারোটি জয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠ অধিনায়কদের ছোট্ট তালিকায় ঢুকে গেছেন ইতিমধ্যেই।

 

 

নাম

টেস্ট সংখ্যা

জয়

পরাজয়

ড্র

এমএস ধোনী

৬০

২৭

১৮

১৫

সৌরভ গাঙ্গুলী

৪৯

২১

১৩

১৫

মোঃ আজহারউদ্দীন

৪৭

১৪

১৪

১৯

বিরাট কোহলি

২০

১২

০২

০৬

মনসুর আলী খান পতৌদি

৪০

০৯

১৯

১২

সুনীল গাভাস্কার

৪৭

০৯

০৮

৩০

রাহুল দ্রাবিড

২৫

০৮

০৬

১১

বিষেন সিং বেদী

২২

০৬

১১

০৫

শচীন টেন্ডুলকার

২৫

০৪

০৯

১২

কপিল দেব

৩৪

০৪

০৭

২৩

       *ন্যুনতম কুড়ি টেস্টে যারা অধিনায়কত্ব করেছেন

 

বিদেশের মাটিতে ভারতের সেরা অধিনায়ক বিবেচিত হওয়া সৌরভ গাঙ্গুলীকেও ছুঁতে হয়তো তাঁর বেশী সময় লাগবে না। কিংবা হয়তো দেশের বাইরে ভালো করতে তাকে পোড়াতে হবে আরো অনেক কাঠখড়। কে জানে!

দেশের বাইরে বিরাট অধিনায়কত্ব করেছেন দশটি টেস্টে। খেলেছেন চারটি সিরিজ। দুটি সিরিজ জিতেছেন, চারটি টেস্ট জিতেছেন, ড্র করেছেন চারটি, আর পরাজয় দুটিতে।

যেখানে সৌরভ ২৮টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১১টি জয় পেয়েছেন, ১০টিতে হেরেছেন ও ৭টিতে ড্র করেছেন।

 

সিকে নাইডুকে দিয়ে শুরু। তারপর হাতবদল হয়ে কতজনই তো ভারতের টেস্ট অধিনায়কত্ব পেলেন! সেভাবে মোটাদাগে আঁচড় কি সবাই কাটতে পেরেছেন? নিশ্চয় না। মনসুর আলী খান পতৌদি, অজিত ওয়াদেকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, মাহেন্দ্র সিং ধোনী... বড়সড় প্রভাব যদি কিছু রেখে থাকেন, তবে এই ক’জনের নামই তো উঠে আসবে।

বিরাট কোহলিও দাগকাটার মতো কোন প্রভাব ভারতের ক্রিকেটে রাখতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটুক নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ভারতে বিরাট কোহলির যুগ শুরু হয়ে গেছে।

সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’, ধোনীর ‘মহাভারত’ বিরাটের হাতে পড়ে কি হয় তা এখনই বলার সময় হয়তো আসেনি। যদিও অনেকেই বলছেন বিরাটের ‘ইয়াং ইন্ডিয়া’!

কোহলি যদি সত্যি সত্যিই ভারতের ক্রিকেটে বিরাট কোন প্রভাব রাখতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহেই বলা যায়, ভারত ‘বিরাট’ শক্তি হয়েই দেখা দিবে। নয় কি?