• ক্রিকেট

বড় দল তো যায় না হওয়া সহজে

পোস্টটি ৭০৪৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বাংলাদেশকে বড় দল হতে বল যে

বড় দল তো যায় না হওয়া সহজে

***

প্লেয়াররা ‘ননসেন্স’ শট খেলে আউট হবেন, তার দায়ভার কেন বোর্ডের উপর বর্তাবে? প্লেয়াররা পারফর্ম করতে পারবেন না, তাতে কেন ম্যানেজমেন্টকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে? দল খারাপ খেললে তাতে ম্যানেজমেন্ট বা বোর্ডের কি করার আছে? কেন প্লেয়ারদের বাজে খেলার সাথে ‘ক্রিকেট-কাঠামো’ টেনে আনা হবে? প্লেয়ারদের খামখেয়ালীপনার সাথে বোর্ড বা ম্যানেজমেন্টের যোগসূত্র কোথায়? ক্রিকেট অবকাঠামো ঠিক করার সাথে উইকেট দিয়ে আসার সম্পর্কটাই বা কোথায়?

যত দোষ বোর্ড-ঘোষ, হয়ে গেল নাকি?

***

একটা দেশের ক্রিকেট-সংস্কৃতি গড়ে উঠার জন্য, ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়া যতটা না জরুরী, তার চেয়েও বেশী জরুরী একটা শক্ত-সামর্থ্য, ক্রিকেট-অবকাঠামো। পর্যাপ্ত ক্রিকেট মাঠ, যথেষ্ট পরিমাণ ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম, ক্রিকেটার, ক্রিকেট-সমর্থক কেবল এসব নিয়ে কিন্তু ক্রিকেট অবকাঠামো নয়। ক্রিকেট অবকাঠামোর জন্য, একটা নির্দিষ্ট ক্রিকেট ক্যালেন্ডার দরকার, দরকার সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্ধিতার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাগুলোর স্বায়ত্বশাসনের দাবী অবশ্য অনেক পুরনো। স্কুল ক্রিকেট থেকে নিয়ে, সর্বনিম্ম পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত একটা সিস্টেম দাঁড় করানোর নামই হচ্ছে ক্রিকেট অবকাঠামো।

আমাদের ক্রিকেটে কি এসবের কিছু আছে?

একটা প্লেয়ার ম্যাচ-সিচুয়েশনের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেবেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে। আমাদের প্লেয়াররা যে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়েন, তাঁরা কি শেখার সুযোগ পেয়েছেন, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হয়?

এখানেই আসে বোর্ডের দায়বদ্ধতা। গত ষোল বছর ধরে তাঁরা একই বুলি আওড়ে আসছেন, ঘরোয়া ক্রিকেট ঢেলে সাজানো হবে। একটা ক্রিকেট ক্যালেন্ডার মেইনটেইন করা হবে। সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্ধিতাময় করা হবে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট।

তা তাঁরা কতটা কি করেছেন, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না, নিশ্চয়?

আচ্ছা, সেসব বাদ দিই। দেশের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কগুলোর ঠিকঠাক ব্যবহার কি করা যেত না? আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাসুদ, মোহাম্মদ রফিক... অবিশ্বাস্য সব প্রতিভা। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে খালেদ মাসুদ রাজশাহী বিভাগের ক্রিকেট বদলে দিয়েছিলেন। তাঁর মাথাটার ব্যবহার ঠিকঠাক মতো হয়েছে কি? রফিককেই বা কতটা ব্যবহার করতে পেরেছি? আমিনুলকে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ক্রিকেট মস্তিষ্কের অধিকারী। তা এই শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট-মাথার কতটা ব্যবহার হয়েছে আমাদের ক্রিকেটে?

ক্রিকেট অবকাঠামো বা সংস্কৃতির অন্যতম একটি ধারা হলো, ক্রিকেট-জ্ঞান সম্পন্ন মানুষদের ক্রিকেটের নানা শাখায় সংযুক্ত করা।

এক্ষেত্রে বলতে হয়, ক্রিকেট-জ্ঞান মানে কিন্তু কেবল রান-উইকেট বোঝা ক্রিকেট-জ্ঞান নয়, সত্যিকারের ক্রিকেট-বোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়া চাই। ওই যে সি আর এল জেমস বলেছিলেন না, ‘যারা ক্রিকেট বোঝে, তাঁরা ক্রিকেটের কী বোঝে!”

***

অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড পর্যন্ত না যাই। পাশের দেশ ভারতের কথাই বলি। বলা হয় ক্রিকেটটাকে ওরা শেষ করে দিচ্ছে। তা হতে পারে। কিন্তু ওরা ওদের প্রথম শ্রেণির ‘মান’ ঠিকই ধরে রেখেছে। আইপিএলের জন্য একটা ‘উইন্ডো’ রেখেছে ঠিকই, তাই বলে আমাদের মতো ‘বিপিএল-ই সব’ নীতিতে মেতে উঠেনি।

ওদের দেশের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট সন্তানদের ঠিকঠাক ব্যবহার করছে ওরা। রবী শাস্ত্রীর পর অনিল কুম্বলে হয়েছেন ‘হেড’ কোচ। রাহুল দ্রাবিড, সৌরভ গাঙ্গুলী, ভিভিএস লক্ষণদের মতো তীক্ষ ক্রিকেট-মস্তিষ্কগুলোর ব্যবহারে পূর্ণ সজাগ ওদের ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রকেরা।

একটা ঘটনা বলি। সপ্তাহ দেড়েক আগে, ভারত-ইংল্যান্ড পঞ্চম টেস্ট খেলছিল চেন্নাইতে। তৃতীয় দিনের খেলা সবে চলছে। ইংল্যান্ডের ৪৭৭ এর জবাবে, ভারতের স্কোর বিনা উইকেটে ১২৫ মতো। সেই সময় রবী শাস্ত্রী কমেন্ট্রীতে বলে উঠলেন, “এই টেস্ট হয় ভারত জিতবে, নয়তো ড্র হবে। ভারতের হারের কোন সম্ভাবনাই নেই।” শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা তো জানেনই। পাশ থেকে মাইক আথারটন মিনমিনে গলায় বলার চেষ্টা করেছিলেন “খেলার এখনও অনেকটা বাকী।”

শাস্ত্রীর এই যে আত্নবিশ্বাস এটা হাওয়ায় উড়ে আসেনি। নিজেদের ক্রিকেটাররাই সেটা দিয়েছেন তাকে। আর সেইসব ক্রিকেটাররা এই পর্যায়ে খেলার আগে, তৈরী হয়েই এসেছেন। তাই ‘স্পিন ট্র্যাক’ নীতি থেকে সরে এসে স্পোর্টিং উইকেটে খেলার সাহস তাঁরা দেখাতে পেরেছেন।

বিরাট কোহলি ৪-০ তে জেতার পরও তাই অকপটে বলছেন, “সবে তো শুরু। আমাদের আরো অনেকটা পথ যেতে হবে।”

এখানেই আসে বোর্ড, আসে অবকাঠামো।

অবকাঠামো বা সিস্টেম কিছু ‘ওয়েল ট্রেইনড’ প্লেয়ার দেয়। আপনার যদি সিস্টেম ঠিক থাকে, তবে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কম।

নিউজিল্যান্ডকেই দেখুন না, তেমন কোন বড় প্রতিভা ছাড়াই কেমন চালিয়ে নিচ্ছে ওরা, ওই সিস্টেম বা ‘ওয়েল ট্রেইনড’ ক্রিকেটার দিয়ে।

আমাদের এই পর্যন্ত যারা এসেছেন, তাঁরা কেউই সিস্টেম থেকে আসেননি। তাঁরা ছিলেন সিম্পলি এক্সট্রা অর্ডিনারী। এই ধরণের ক্রিকেটাররা অবকাঠামো দাঁড়াতে বা তৈরী হতে ভিতের মতো কাজ করতে পারেন, কিন্তু অবকাঠামো তৈরী করতে পারেন না। সাকিব-মাশরাফিরাও তাই অবকাঠামো তৈরী করতে পারবেন না। সেটা বোর্ডকেই করতে হবে।

***

শ্রীলংকা ক্রিকেটকে পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পেতে রানাতুঙ্গা-মহানামা-ডি সিলভারা সাহায্য করেছেন। তারপর মাহেলা-সাঙ্গারা এসেছেন অবকাঠামো থেকেই। একসাথে কয়েকজন সিনিয়র প্লেয়ার বিদায় নিলেও, শ্রীলংকা ক্রিকেট একদম ভেঙ্গে পড়েনি ওই সিস্টেমে ভর দিয়েই।

দুনিয়ার সেরা ক্রিকেট-কাঠামো আছে অস্ট্রেলিয়ায়। একটা প্রজন্মকে হারিয়ে দিশেহীন অস্ট্রেলিয়াকে, জনসন-ক্লার্কও যখন ছেড়ে গেলেন, তখনও সেদিনের ছোকরা স্মিথ-ওয়ার্নাররা ঠিকই সামলে নিচ্ছেন। ওদের ভেঙ্গে পড়তে দিবে না, ওদের সিস্টেম, ওদের অবকাঠামো।

আমাদের সব থাকলেও, অবকাঠামো না থাকার দরুণ, সমস্যায় পড়ি আমরা। আর এই অবকাঠামো যতদিন না ঠিক হবে ততদিন আমাদের বড় দল হয়ে উঠার আশাতেও গুড়ে বালি। অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান একটা প্রজন্ম পেলেই বড় দল হওয়া যায় না, আরো কিছু জিনিস লাগে। আমাদের সুবিধে হলো, দুর্দান্ত একটা প্রজন্ম পেয়ে গেছি। দরকার এবার, বোর্ডের যথাযোগ্য পদক্ষেপ। যাতে একটা ক্রিকেট-সিস্টেম বা ক্রিকেট কালচার এদেশে গড়ে উঠে।

জাতিগতভাবে আমাদের মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। প্রচন্ড ঠান্ডার দেশ বলুন কিংবা উত্তপ্ত মরুভূমি, আমরা ঠিকই মানিয়ে নিই। আমাদের ক্রিকেটাররাও তাই নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড-দক্ষিন আফ্রিকাতেও দারুণভাবে মানিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সিস্টেম-অনভিজ্ঞতা, আমাদের ডুবিয়ে দেয় বরাবরই।

প্লেয়ারদের দোষারোপের আগে সেজন্যেই আসে বোর্ডের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন!

***

বাংলাদেশ দলে ম্যাচ উইনারের অভাব নেই, অভাব ম্যাচ ফিনিশারের। বলে-কয়ে এসব সৃষ্টি করা যায় না। ম্যাচ ফিনিশার সৃষ্টি হয়, ম্যাচ পরিস্থিতি থেকেই। আর সেসব আপনাকে দিবে ঘরোয়া ক্রিকেট। সেজন্যেই ঘরোয়া ক্রিকেটের একটা শক্ত-পোক্ত অবকাঠামো এতটা জরুরী।

আমাদের ম্যাচ উইনারের মতো অভাব নেই নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানেরও। তবে প্রশ্ন আছে তাদের নির্ভর-যোগ্যতা নিয়ে। দিনের শেষ ওভারে হঠাৎ বিগ শট খেলতে চাওয়া, জয়ের প্রান্তে গিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়া, ঘন ঘন ব্যাটিং কলাপ্স, ক্রিকেটারদের অধৈর্য্য... সব কিছুর সমাধান কিন্তু ওই অবকাঠামোতেই। ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা, ম্যাচ পরিস্থিতি বোঝার সক্ষমতা, বড় জুটি গড়ে তোলার প্রাজ্ঞতা সব আসবে অবকাঠামো থেকে, সিস্টেম থেকে। ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে।

তাই তো শক্ত-পোক্ত একটা ক্রিকেট-কাঠামো দরকার।

আর এই কাঠামো তৈরী করতে পারবেন বোর্ড কর্তারাই, ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রকেরাই। সেজন্যেই প্লেয়ারদের ‘সেন্স’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে, আমি বলি বোর্ড কর্তাদের সেন্স নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। ক্রিকেটের অভিভাবকেরা আগে ঠিক হোন, বাকী সব আপনাতেই ঠিক হয়ে আসবে।

এক-দুইটা সিরিজ জয় বা টুর্নামেন্ট জয় দিয়ে বড় দল হওয়া যায় না। একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, একজন অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক, একজন অকুতোভয় ওপেনার, একজন ক্ল্যাসি-ব্যাটসম্যান বা একজন ম্যাজিশিয়ান টাইপ বোলার... কোনভাবেই বড় দল হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

বড় দল হওয়ার জন্য চাই, একটা স্ট্যান্ডার্ড ক্রিকেট-অবকাঠামো। যা আপনাকে হয়তো এখনই সাফল্য দিবে না, তবে আখেরে বড় দল হিসেবেই গড়ে তুলবে।