• ক্রিকেট

মেলবোর্নের রোমাঞ্চ --- ১

পোস্টটি ৬৭১৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

    টস সম্পর্কে ডব্লিউ জি গ্রেসের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। ‘টসে জিতলে ব্যাটিং করো। যদি তোমার সন্দেহ থাকে তবে একটু চিন্তা করো, তারপরে ব্যাটিং করো। যদি খুব বেশী সন্দেহ থাকে তবে তোমার সতীর্থের সাথে আলোচনা করো, তারপরে ব্যাটিং করো।’

    গ্রেগ চ্যাপেলের নানা ভিক রিচার্ডসনেরও টস সম্পর্কে এক দারুণ উক্তি আছে। ভদ্রলোক নিজেও ক্রিকেট খেলতেন; অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন উনিশ টেস্ট। তাঁর উক্তিটা ছিল এরকমঃ ‘দশবার টসে জিতলে নয়বার ব্যাটিং করো। দশমবার অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চিন্তা করো, তারপরে ব্যাটিং করো।’

    নানার এতো ‘অসাধারণ’ উপদেশের পরেও গ্রেগ চ্যাপেল টসে জিতে বোলিঙের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৮২ সালের অ্যাশেজের ৪র্থ টেস্টের কথা বলছি। গ্রেগের দোষ দিয়েও লাভ নেই অবশ্য। পিচ ছিল একেবারে ভেজা, যাকে বলা যায় ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি। সেই সিরিজে গ্রেগ চ্যাপেল ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন, অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেনগুলা এমনিতেই অ্যাগ্রেসিভ হয় আর অস্ট্রেলিয়া তখন সিরিজে এগিয়ে আছে ২-০’তে। হাতে আছে আর মাত্র দুই টেস্ট, সেই দুই টেস্টের এক টেস্টে অন্তত ড্র করতে পারলেই সিরিজ নিশ্চিত। এই অবস্থায় পিচের কন্ডিশন দেখে কেউ যদি সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তাকে খুব বেশী দায় দেয়া যায় না।

২.

    যাই হোক। টসে জিতে ফিল্ডিং নিল অস্ট্রেলিয়া। ক্রিস ট্যাভারে আর অ্যালান ল্যাম্বের দুটো ৮০+ ইনিংসে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ হলো ২৮৪, এরমধ্যে ট্যাভারে আর ল্যাম্বের যুগলবন্দীতে ৪র্থ উইকেট জুটিতে এল ১৬১। ব্যাটিঙে নেমে ৮৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেললেও কিম হিউজ আর ডেভিড হুকস মিলে গড়লেন ৯১ রানের জুটি; দলকে নিয়ে গেলেন ১৮০ পর্যন্ত। এরপরে হুকস আউট হয়ে গেলেও ক্রিজে এলেন রডনি মার্শ, হিউজ আর তিনি মিলে স্কোর করলেন ২৬১/৫। অস্ট্রেলিয়ার একটা বড় লিড যখন মাত্র সময়ের ব্যাপার তখনই আঘাত হানলেন বব উইলিস, কিছুক্ষণের ব্যবধানে তুলে নিলেন হিউজ আর মার্শকে। স্কোর তখন ২৭৬/৭। এরপর রীতিমতো ভয়ংকর হয়ে উঠলেন জিওফ মিলার; অস্ট্রেলিয়ার বাকি তিন উইকেট পকেটে পুরে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করলেন ২৮৭’তে। ‘বড় লিড’এর পরিমাণ দাঁড়াল মাত্র ৩ রানে।

    ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস যদি হয়ে থাকে ‘টু ম্যান শো’ তাহলে দ্বিতীয় ইনিংসকে বলতে হবে ‘দশে মিলে করি কাজ’। ট্যাভারে এবার গেলেন ০’তে; ওপেনার গ্রায়েম ফাউলারের ৬৫, বোথামের ৪৬, প্রিঙ্গলের ৪২ আর বব টেলরের ৩৭’র সাথে যুক্ত হলো ল্যাম্ব আর কুকের দুটো ২৬। সবকিছু মিলিয়ে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়াল ২৯৪; প্রথম ইনিংসে ৩ রানের লিডের কারণে অস্ট্রেলিয়ার সামনে টার্গেট ২৯২।

৩.

    সেই ১৯২৮ সালে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের দেয়া ৩৩২ রান তাড়া করে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। এছাড়াও এই মাঠে ২৯৭ এবং ২৯৫ তাড়া করে জেতার রেকর্ডও আছে। তাই অস্ট্রেলিয়ার সামনে অসম্ভব কোনও লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু লক্ষ্যটা অসম্ভব বানিয়ে দিলেন নরমান কাওয়ান্স; ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করার জন্য এই টেস্টকেই বেছে নিলেন তিনি। শুরুটা করলেন কেপলার ওয়েসেলসকে দিয়ে; এরপরে তুলে নিলেন গ্রেগ চ্যাপেলকেও। ৭১ রানে জন ডাইসন আউট হওয়ার পরে হিউজ আর হুকস ১০০ রানের জুটি গড়ে ম্যাচ যখন বের করে নিয়ে যাচ্ছেন প্রায়, তখনই হিউজ আউট হলেন মিলারের বলে; প্রায় সাথে সাথেই জোড়া আঘাত হানলেন কাওয়ান্স। ডেভিড হুকসকে আউট করলেন; কিছুসময়ের ব্যবধানে ফেরালেন মার্শকেও; কাওয়ান্সের বলে স্কোরের সাথে এক রানও যোগ না করে সাজঘরে ফিরলেন ব্রুস ইয়ার্ডলি। ১৭১/৩ থেকে স্কোর হয়ে গেল ১৯০/৭। জয়ের সূর্য অস্তাচলে প্রায়।

    প্রায় বলছি এ কারণে যে ক্রিজে তখনও এবি আছেন। এবি মানে ডি ভিলিয়ারস না, আইয়ুব বাচ্চুও না। এবি মানে অ্যালান বোর্ডার। কিন্তু ২১৮ রানে নবম উইকেট পড়ার পরে ম্যাচ বোর্ডারেরও হাত থেকে বের হয়ে গেল, কারণ দরকার তখনও ৭৪ রান। ক্রিজে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আসলেন জেফ থমসন। বোর্ডারের সাথে যোগ করলেন ৩৭ রান; দরকার আরও ৩৭; স্কোর দাঁড়াল ২৫৫/৯।

    স্টাম্পস। ডে ফোর।

৪.

    পরের দিন সকালে এক ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হতে মাঠে এল প্রায় আঠারো হাজার দর্শক। নতুন বল নেয়া হলো, কিন্তু বোর্ডার একমনে খেলতে লাগলেন, আগের দিনের আত্মবিশ্বাস সঙ্গে নিয়ে তাঁর সাথে যোগ দিলেন থমসনও। বিন্দু বিন্দু বালুকণার মতো সিঙ্গেলস, ডাবলস, বাউন্ডারিতে ২৫৫/৯ থেকে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল ২৮৮/৯ এ।

    জয়ের জন্য আর দরকার মাত্র ৪ রান।

    এই সময়ে বোলিঙে আসলেন বোথাম। প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিলার; দ্বিতীয় স্লিপে ট্যাভারে। পিচের অবস্থা খেয়াল করে কিছুটা সামনে এগিয়ে এলেন তারা। কিন্তু বোথামের করা বলটি তাদের অনুমানের চাইতে বেশী লাফালো। বলটা কোনও জেনুইন ব্যাটসম্যানের কাছে আসলে বাউন্ডারি হওয়া ছাড়া আর কোনও গতি ছিল না, নিদেনপক্ষে সিঙ্গেল তো হতোই। কিন্তু থমসন যেহেতু জেনুইন ব্যাটসম্যান না, তাই তিনি দ্বিধায় ভুগলেন। খেলব কি খেলব না এই চিন্তা করতে করতেই বল ব্যাটের কানা ছুঁয়ে চলে গেল ফার্স্ট স্লিপে মিলারের কাছে।

    মিস করলেন মিলার!!!!

    মিলারের মিস করা বলটি লুফে নিলেন সেকেন্ড স্লিপের ট্যাভারে। অস্ট্রেলিয়া ২৮৮/১০। ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতল মাত্র ৩ রানে।

    এই প্রসঙ্গে পরে থমসন বলেছিলেন, ট্যাভারের ক্যাচ নেয়ার মোমেন্টটা তার জীবনের সবচেয়ে ওর্স্ট মোমেন্টগুলোর একটা।

    অস্ট্রেলিয়ার অবশ্য সিরিজ জিততে কোনও সমস্যা হয়নি। পঞ্চম টেস্টে ড্র করে ২-১’এ সিরিজ জেতে তারা।

    এই ম্যাচ যদি বোর্ডার এবং থমসন জেতাতে পারতেন তবে তা হতো ব্রায়ান লারার বার্বাডোজের বীরত্বের মতোই রোমাঞ্চকর।

    কিন্তু বাস্তবে সবসময় হ্যাপি এন্ডিং হয় না।

    তাই বার্বাডোজের পাশে বসতে গিয়েও শেষপর্যন্ত মেলবোর্নের স্থান হয় এজবাস্টনের পাশে।