ইংলিশ ক্রিকেটের নব রত্ন
পোস্টটি ৯২০০ বার পঠিত হয়েছেধমনি জুড়ে তারুণ্যের আবাহন অদ্ভুত এক শিহরণ জাগায়। আশ্চর্য্য এক জীবনীশক্তি যোগায়। যেন মনে হয় পুরো পৃথিবী মুঠোয় পুরে ফেলা কোন ব্যাপারই নয়। নতুন করে গড়তে ইচ্ছে হয় সব। ভেঙে চূরমার করে দিতে ইচ্ছে হয়, এতদিনকার যত নিয়ম, কানুন, শৃংখল। নিয়ম ভঙের তৃপ্ত সুখে মেতে উঠার শখ জাগে, তারুণ্যের অবারিত, উদ্বেলিত উচ্ছ্বাসে। নিজেকে বেঁধে রাখার ন্যুনতম প্রবৃত্তিও সায় দেয় না, তরুণ মন।
কিন্তু এক্ষেত্রে আশ্চর্য্য ব্যতিক্রম একজন তরুণ। নিজেকে বেঁধে রাখার সব কলা কৌশল আয়ত্ত্বে এনে, নিজেকে তিনি আরো পরিশীলিত করার অভিপ্রায়ে নিমগ্ন। নিজের মেধা ও প্রতিভার সাথে একাগ্রতা, অনুশীলন, পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের সমন্বয়ে, কিছুটা ভিন্ন পথে বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে তিনি নিজেকে গড়ে তুলছেন একটু একটু করে।
কঠিন পরিশ্রমে ক্লান্তি নেই একটুও
এই তড়িৎ পৃথিবীর রঙিন ক্রিকেটের যুগে, চার-ছয়ের ফুলঝুরির পরিবর্তে তিনি বেছে নিয়েছেন ‘বল ছেড়ে দেয়া’ পদ্ধতি, ব্লক পদ্ধতি। তাঁর ডাকনামও তাই হয়ে গেছে বোল্টন ব্লকার। তিনি পড়ালেখার পাঠ বোল্টন স্কুল থেকে চুকিয়েছেন যে!
তাকে অবশ্য ডাকা হয় ‘বেবী বয়কট’ নামেও। ইসমাঈল হামিদ ছিলেন একাধারে তাঁর বাবা, কোচ ও পরামর্শক। সেই বাবার পছন্দের ব্যাটসম্যান ছিলেন কিংবদন্তী ইংলিশ ব্যাটসম্যান জিওফ্রে বয়কট। তাই তিনি ছেলে হাসিব হামিদকেও গড়ে তুলেছেন বয়কটের মতো করে, বিশুদ্ধ ব্যাটিং-টেকনিক দিয়ে।
বাবার পছন্দ বয়কট হলেও, তাঁর পছন্দ ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। আর এখন সতীর্থ জো রুট ও বিরাট কোহলির ব্যাটিংয়ের মুগ্ধ দর্শক তিনি। তাই ভারত সফরে গেলে দশ মিনিটের জন্য হলেও কোহলির সাথে কথা বলার জন্য কি আকুতি তাঁর!
ব্যাটিং-হিরোর সাথে কথোপকথনে মুগ্ধ শ্রোতা হাসিব হামিদ
কথা বলতে গিয়ে কোহলিকে আবিস্কার করেন নতুন করে। “লোকে উনাকে অহংকারী মনে করে, আক্রমণাত্নক ভাবে। মাঠের ভেতর হয়তো খেলাটার প্রতি নিবেদন ও আন্তরিকতার কারণে এটা হয়ে যায়। আসলে তিনি মাঠের বাইরে একজন সৎ, উদার ও বিনয়ী ব্যক্তি।” কোহলি সম্পর্কে বলেছিলেন হামিদ।
আর কোহলি কি বলেছিলেন তাঁর সম্পর্কে?
“সে অবশ্যই ইংলিশ ক্রিকেটের সম্পদ। নিঃসন্দেহে ক্রিকেটের সব আঙিনাতেই তারকা হওয়ার যোগ্যতা তাঁর রয়েছে। সে তাঁর সক্ষমতা, পরিপক্কতা ও দক্ষতা দেখিয়ে দিয়েছে। সে এমন একজন, যার সম্পর্কে আপনাকে উচ্ছ্বসিত হতেই হবে।”
শুধু কি কোহলিকে মুগ্ধ করেছেন তিনি? কোহলির অনেক আগেই তাঁর কাউন্টি দল ল্যাঙ্কাশায়ার-কোচ এ্যাশলি জাইলশ যে মুগ্ধ হয়েছিলেন হামিদে। “তাঁর মধ্যে টেম্পারমেন্টটা কেমন যেন প্রকৃতিগতভাবেই দেয়া আছে। এটা হয়তো তাঁর বাবার কারণে হয়েছে। অথবা সে জন্মগতভাবেই এমন।”
এ্যাশলে জাইলশ তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কুড়ি ম্যাচে চার সেঞ্চুরীর সাথে নয়টি ফিফটি, প্রায় পঞ্চাশ গড়ে করেছেন প্রায় দেড় হাজার রান। এক টেস্টে গড়েছেন আবার উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরীর রেকর্ড, তাও আবার ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে। ল্যাঙ্কাশায়ার-ইয়র্কশায়ারের ‘রোজেস’ ম্যাচে যে কীর্তি ছিল না আর কারও।
শুধু কি তাই? গত মৌসুমে খেলেছেন রেকর্ড ২৮৫৮ বল। যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১৭৪ বল, তাঁর চেয়ে ১১৪ ওভার কম! ইংল্যান্ড যুব দলের হয়ে পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেছিলেন ২৫৬ বলে অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংস, তাও আবার দ্বিতীয় ইনিংসে, দল যখন ৩০০ রানে পিছিয়ে! শেষ দিন বৃষ্টিতে ভেসে না গেলে হয়তো ইনিংসটা আরো বড় করতে পারতেন।
তিনি নিজের উইকেটের মূল্য বোঝেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে রান করতে চান, খেলাটাকে হৃদয়ঙ্গম করে। অনুধাবন ও কঠিন অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। তিনি জানেন এই যুগে দ্রুতলয়ের ক্রিকেটও দ্রুততার সাথে আত্নস্থ করে নিতে হয়। তাই তিনি ‘জিম’ করেন, পেশিশক্তির জোর বাড়াতে। তাকে সব ধরণের ক্রিকেটেই মানিয়ে নিতে হবে না!
তাঁর বিশ্বজয়ের হাতিয়ার তো ওই ব্যাটটাই
অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি, তাতে একটুও আক্ষেপ নেই তাঁর। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ‘অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে যাও, কেবল পরের বলটি নিয়েই ভাবো’ এমন এক মন্ত্রে আউড়ে যান তিনি। সেই আট বছর বয়স থেকেই তিনি ভাবতেন, উইকেট দেয়া যাবে না। আউট হওয়া যাবে না। কিছুতেই না।
রাজকোটে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল তাঁর, ব্যাটিং-হিরো জো রুটের উইকেট-সঙ্গী ছিলেন ওভার দশেক। তিনটি ক্যাচ নিয়েছেন, দ্বিতীয় ইনিংসে পেয়েছেন প্রথম টেস্ট ফিফটিও। তবুও আশ্চর্য্য নির্লিপ্ত তিনি।
আট বছর বয়স থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল, একদিন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলবেন। তিনি খেলেছেন।
স্বপ্ন ছিল, এ্যাশেজ জিতবেন, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন। সেসবও হয়তো একদিন ঠিক পূরণ করবেন। তিনি যে কেবল ব্যাটিংয়ে নয়, মানসিকভাবেও পরিণত। “ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে সেঞ্চুরীর পর, আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন এতেই এত উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। আত্নতুষ্টিতে ভোগারও কিছু নেই।” বাবা তাঁর গুরু, তাঁর কোচ। বাবার কথা তিনি মেনে চলেন অক্ষরে অক্ষরে।
সতীর্থ ও ব্যাটিং-হিরো জো রুটও তাকে শুনিয়ে দিয়েছেন সেই একই মন্ত্র। মোহালীতে আট নম্বরে নেমে, আঙ্গুলের ইঞ্জুরী ভুলে গিয়ে, দলের সম্মান বাঁচাতে লড়াই করেছিলেন। ‘ব্লকার বোল্টন’ দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়োজনের সময় তিনিও কেমন নির্দয় হয়ে উঠতে পারেন, বোলারদের পিটিয়ে ছাতু বানাতে পারেন। তবুও রুট সতর্ক করে বলেছিলেন, “নিঃসন্দেহে সে দুর্দান্ত খেলেছে। এই বয়সে এমন ব্যাটিং সত্যিই দারুণ। তবে এতেই তৃপ্ত হওয়া চলবে না। তাকে পাড়ি দিতে হবে আরো অনেকটা পথ।”
হামিদ তা ভালো করেই জানেন। “আমি জানি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট অনেক কঠিন জায়গা। সত্যিকার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনই আমাকে হতে হবে। তবে আমি সবসময়ই চেয়েছি, আমার প্রতিপক্ষ যেন যথাসম্ভব কঠিন দল হয়। তাহলে তাঁরা আমাকে আউট করার জন্য বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা করবে।” কুড়ি না হতেই এমন যার পরিণতবোধ, তিনি কি কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে না ফোটে পারেন?
ওই যে বলে না, প্রভাত দিনের পূর্বাভাষ দেয়। হাসিব হামিদ শুরুতেই দিয়েছেন উজ্জ্বল আলোকের পূর্বাভাষ। নিশ্চয় এ্যালেস্টার কুক, জো রুটের পর আরো একটি রত্নের আবির্ভাব ঘটেছে ইংলিশ ক্রিকেটে।
হাসিব হামিদ কি পারবেন তাঁর মতো করে বিশ্বজয় করতে? পারবেন একদিন এ্যাশেজ জয়ী হতে? পারবেন একদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে?
হয়তো পারবেন, হয়তো পারবেন না। তবে এই বয়সেই এমন সংযম যিনি করায়ত্ব করতে পারেন, এত সংযত যিনি হতে পারেন, তিনি নিশ্চয় একদিন ঠিক তাঁর স্বপ্নগুলোও হয়তো সত্যি করতে পারবেন। কি, পারবেন না?
উত্তরটা না-হয় সময়ের হাতেই তোলা থাক... ।
আপনাকে কুড়িতম জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা, হাসিব হামিদ।
- 0 মন্তব্য