পিএসজি ৪-০ বার্সেলোনাঃ অঘটন নাকি পরিকল্পিত?
পোস্টটি ১৩৯৯৭ বার পঠিত হয়েছে
২০০৭ সালের পর এই প্রথম চ্যাম্পিয়ন্সলীগে শেষ ১৬ থেকে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে বার্সেলোনা। হারজিতের খেলা ফুটবল। একদল জিতবে আর একদল হারবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বার্সার হারার পর সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে যা নিয়ে তা হল তাদের হারের ধরণ। পোস্ট ম্যাচ অ্যানালাইসিসের সিংহভাগ জুড়েই থাকছে পিএসজির ভাল খেলার পাশাপাশি, বার্সার প্রতিপক্ষকে হালকা করে নেওয়া এবং কোচ ও খেলোয়াড়দের জঘন্যতম পার্ফরমেন্সের নমুনা।
পুরো ম্যাচের স্ট্যাটে একবার চোখ বুলালেই বোঝা যাবে কতটা বাজে সময় পার করেছে মাঠে টীম বার্সেলোনা। ফ্রেঞ্চ দলটির ১০ শটের বিপরীতে বার্সার শট ছিল সবে ১ টা। বার্সা পুরো মাঠে অতিক্রম করেছে ১০৪ কিমি যেখানে পিএসজি করেছে ১১২.১ কিমি। আর পিএসজির ৪৬ বার বল উদ্ধারের বিপরীতে বার্সার ছিল ৩৬ বার মাত্র। এমনকি দলের পাওয়ারহাউজ আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসির উপস্থিতি এইদিন মাঠে একেবারেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। চলুন খুঁজে দেখার চেষ্টা করি কি এমন হয়েছিল দলটার বা তাদের ভুলটাই বা কোথায় হয়েছিল, কেনই বা এত জঘন্য পারফর্মেন্স ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়নদের।
বার্সাকে পেছনে ফেলতে হলে এমএসএনত্রয়ীদের আলাদাভাবে তাদের সর্বোচ্চ পারফর্মেন্স থেকে দূরে রাখতে হবে। পিএসজি নির্ভীকভাবে এই কাজটাই করে দেখিয়েছে। নেইমার মাঝেসাঝে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করে দেখাতে পারলেও সুয়ারেজ আর বার্সেলোনার আক্রমণের প্রাণভোমরা মেসি ছিল নিজেদের সেরা থেকে যোজন যোজন দূরে। মেসিকে প্রেস করতে করতে এতটাই গভীরে নিয়ে গিয়েছিল পিএসজি যে এতে করে পুরো পেনাল্টি এরিয়াতে মেসির কোন টাচ ছিল না!
মেসির টাচম্যাপ
সুয়ারেজকেও মোটামুটি একইভাবে অকেজো করে রেখেছিল পিএসজি। পুরো মাঠ দৌড়েও কোন সুবিধা করতে না পারা সুয়ারেজ পুরো ম্যাচে বলে টাচ করেছে মাত্র ৩০টি যার মাঝে আবার ৫টিই কিক অফের সময়। যে ২২জন খেলোয়াড় শুরু করেছিল তাদের মাঝে তার টাচ সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন!!
সুয়ারেজের হীটম্যাপ
যেখানে পুরো ম্যাচে বার্সার আক্রমণভাগ খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর সেখানে ফ্রেঞ্চদলটির আক্রমণত্রয়ী অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, হুলিয়ার ড্র্যাক্সলার এবং এডিনসন কাভানি ছিলেন উজ্জ্বল। স্যামুয়েল উমতিতি এবং জেরার্ড পিকেকে হতভম্ভ করে স্কোরশিটে তিনজনই নিজের নাম তুলে ফেলেন। ডি মারিয়ার অসাধারণ জোড়া গোল যেমন ইউনাইটেড সমর্থকদের মনের দুঃখ বাড়িয়েছে তেমনি ড্র্যাক্সলারের বার্সা দুর্গে ১১ টাচ, তিন অসাধারণ ড্রিবল আর এক চোখ ধাঁধানো গোল আর্সেন ওয়েঙ্গারকে একটু হলেও নিজের ভুল বুঝতে সাহায্য করেছে। কাভানিও এদিন নিজেকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। আত্মবিশ্বাস থাকলে তার অসাধারণ অবস্থান পরিবর্তন/নড়াচড়া সাথে কিপারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আগেভাগে শট নেওয়ার ক্ষমতা যেন আরো পূর্ণতা পায়।
বিগত ৩০ বছর যাবত বার্সেলোনা ইয়োহান ক্রুইফ ও পেপ গার্দিওলার মতাদর্শে অক্লান্ত প্রেসিং আর নিজের অর্ধ থেকে অসাধারণ বিল্ডাপের খেলা খেলে অভ্যস্ত। ২০১২-১৪ এই সময়ে বড় দলের ট্যাক্টিকাল ম্যানেজাররা নিজেদের অর্ধে ডিফেন্সিভভাবে বসে থেকে কাউন্টার অ্যাটাকে গোল এনে পরাস্ত করা শুরু করল বার্সাকে। লুই এনরিকে তাই এসে ফল পেতে বার্সাকে আরো সরাসরি খেলতে অভ্যস্ত করে তুললেন। এমএসএনের মাধ্যমে তিনি মধ্যমাঠকে বাইপাস করে এক হেভি পজেশনভিত্তিক না হলেও মোটামুটি পজেশনভিত্তিক ফুটবল শুরু করলেন। মাঝমাঠে জাভির উপস্থিতি (যখনই মাঝমাঠে নিয়ন্ত্রণ দরকার) আর সামনের তিনজনের অসাধারণ বোঝাপড়া সাথে একক নৈপুণ্য মিলে এগোতে থাকল বার্সা। কিন্তু জাভি যাওয়ার পরে ট্যাকটিকালি দক্ষ ম্যানেজারদের চোখে পড়ে গেল নিজেদের অর্ধে প্রেস করলে বার্সা আর নিজেদের মত খেলতে পারে না। প্রথম মিনিট থেকেই মঙ্গলবার রাতে পিএসজি এটাই করে দেখিয়েছে। পিএসজির প্রেসারে দিশেহারা হয়ে বার্সা পুরো মাঠে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ শুরু থেকেই হারিয়ে ফেলে। শারীরিক বা মানসিকভাবে কোনদিক থেকেই এদিন এগোতে পারেনি বার্সা র্যাবিওট, মাতুইদি আর ভেরাত্তির মিলিত শক্তির বিপরীতে।
র্যাবিওটের টাচম্যাপ (বক্স টু বক্স পারফর্মেন্স)
বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে পিএসজি একদম নিচে নিজেদের অর্ধ থেকে নিজেদের আক্রমণ চালনা করেছে। তৃতীয় গোলটি তারই প্রমাণ। র্যাবিওট তার গোলকিপারের কাছে থেকে একটা ছোট পাস নিয়ে নিজের অর্ধে গতিতে মেসিকে কাটিয়ে ড্র্যাক্সলারকে পাস দিয়ে আক্রমণের সূচনা করে যার ইতি টানেন ডি মারিয়া অসাধারণ এক গোলের মাধ্যমে।
ভিডিও এর ৯ঃ০৮ থেকে শুরু তৃতীয় গোলের বিল্ড আপ
এই গোলটি শুধুমাত্র একটা নমুনা যে নিজেদের অর্ধ থেকে বিপক্ষ আক্রমণ তৈরি করে এগোলে কতটা ভঙ্গুর হতে পারে বার্সার রক্ষণ!
মাতুইদি, র্যাবিওট আর ভেরাত্তি মিলে তাদের প্রেসিং এর মাধ্যমে একবিন্দুও শান্তিতে থাকতে দেয় নাই আন্দ্রেস গোমেস, সার্জিও বুস্কেটস এবং আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে। তবুও আলাদা করে এদিন ফ্রান্সে আলো ছড়িয়েছেন র্যাবিওট আর ভেরাত্তি। এ দুজনে ড্র্যাক্সলারের গোলও বানিয়ে দিয়েছেন আবার পুরো মাঠেই নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে গেছেন। পুরো ম্যাচের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহুর্ত কিন্তু র্যাবিওটের। দ্বিতীয়ার্ধে মেসির পায়ের ফাঁক দিয়ে আনা সেই ফ্লিকড নাটমেগটি! বার্সার মধ্যমাঠত্রয়ী এদিন দাড়াতেই পারেনাই নিজেদের শেষ চারের সামনে কোন দেয়াল হয়ে। বরং দ্বিতীয় গোলের পজেশন পরিবর্তন ও ভেরাত্তির মোটামোটি বাধাবিহীনভাবে মাঝমাঠ পেরোনো পরে তৃতীয় ও চতুর্থ গোলে ডি মারিয়া আর ম্যুনিয়ারের গোলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিপরীতের বাঁধাকে স্কুলের বাচ্চাদের মত ডিফেন্ডিংই বলা চলে।
থমাস ম্যুনিয়ারের মাঝমাঠ চিড়ে বিনা বাধায় এগিয়ে যাওয়া
পুরো ম্যাচে ১০ শটের মুখে পড়া বার্সা ডিফেন্স নিয়ে কথা বলতে গেলে আরো একটা প্রশ্নের উদ্রেগ ঘটে কেন গোমেজকে দিয়ে শুরু করে এনরিকে রাকিটিচকে রেখে! মধ্যমাঠে শুরু করে ৫৮ মিনিটে সাব হওয়ার আগে পর্যন্ত ভয়াবহ বাজে পারফর্মেন্স ছিল এ ২৩ বছর বয়সীর। পিএসজির টানা আঘাতে ৭ বার বল হারিয়ে, শতকরা মাত্র ২৯ ভাগ ডুয়েল জিতে এবং কোন ট্যাকেল না জিতে এক জঘন্যতম পারফর্মেন্সের উদাহরণ হিসেবে রইলেন গোমেজ। সেই সাথে প্রথমার্ধে একটা ওয়ান ওন ওয়ান পজিশনে গোল করতে ব্যর্থ হয় যা দলকে ১-১ করে ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ এনে দিলেও হয়তবা দিতে পারত! দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই তার বল হারিয়ে বাজে ফাউলটিই বুঝিয়ে দেয় কতটা হতাশাব্যঞ্জক পারফর্মেন্স ছিল।
আরেকটি বেশ বড়সড় দুশ্চিন্তার নাম বার্সার জন্য রাইট ব্যাক পজিশন। আল্ভেসের যাওয়ার পরে রবার্তো কোনভাবেই তাকে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারে নাই। বরং ডিফেন্সিভ মানসিকতা আর উপরে আক্রমণে নিজেকে টানতে না পারা তাকে নন বার্সা টাইপ একজন রাইট ব্যাক করে তুলেছে। এতটাই ভুগতে হচ্ছে বার্সাকে যে ‘আলভেসের পরের দিনগুলো’ নামক একটা বই হয়তবা রচনা করে ফেলতে পারে তারা।
এদিনের রেফারির পারফর্মেন্সও ছিল চোখে পড়ার মত। কোন দলের প্লেয়ারদের দ্বারাই সে প্ররোচিত হয়নাই বরং শেষ পর্যন্ত নিজের দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন সঠিক সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে।
মঙ্গলবার রাতে বার্সা সুযোগই পায়নাই তেমন নিজেদের মেলে ধরার তারপরও দুটো নিশ্চিত সুযোগ তারা হাতছাড়া করে। গোমেজের পরে উমতিতির হেড বারে লেগে ফিরে আসে। এগুলোর কোন একটাও জালে জড়ালে এওয়ে গোলের অমুল্য সুবিধা নিয়ে এগোতে পারত বার্সা।
বিগত ২৩ বারের দেখায় বার্সার বিপক্ষে মাত্র এক জয় পাওয়া উনাই এমেরি ম্যাচ শুরু পূর্বে বেশ ব্যাকফুটেই ছিল বলা যায়। কিন্তু ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ ছিল পুরোই আলাদা। নিজের অসাধারণ চিন্তার মাঠে সঠিক বাস্তবায়ন করে তার খেলোয়াড়েরা। ফল পেতেও সময় লাগে না। বার্সার মিডফিল্ড, গোমেজ আর রবার্তোর প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখানোর যে নির্দেশনা পেয়েছিল পিএসজি তার সঠিক বাস্তবায়নেরই ফল এই ৪-০।
অন্যদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে খেলা পুরো ম্যাচে এটা কার্যত স্পষ্টই ছিল যে এনরিকে ও বার্সা পিএসজিকে বেশ সহজ ভাবেই নিয়েছিল। তাদের না ছিল কোন পরিকল্পনা, না ছিল কোন প্রস্তুতি। বার্সেলোনার মত সফল ও সাফল্যপিপাসু একটা দলের এমন ভয়াবহ পারফর্মেন্স সমর্থক বা ক্লাব কর্মকর্তা কেউই ভালোভাবে নিবে না এটা বোঝাই যায়। পরিবর্তনের আর খুব বেশি দেরি বলে মনেও হয় না। দেখা যাক দ্বিতীয় লেগে আহামরি কিছু করে চমকের তৈরি করতে পারে কিনা লুচো ও তার দল যার সম্ভাবনা আপাতত নেই বললেই চলে!
- 0 মন্তব্য