ক্রিকেট-বন্ধুত্বে নৃবিজ্ঞান প্রিমিয়ার লীগ (এপিএল)
পোস্টটি ৪৬০২ বার পঠিত হয়েছেঘড়ির কাঁটা নয়ের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। শীত পেরিয়ে দুদিন আগেই দেখা পাওয়া বসন্তের মৃদু হাওয়াটাও গায়ে এসে লাগছে। ক্যাম্পাসের ভিসি চত্বর থেকে নীলক্ষেতমুখী সড়কে এলইডি বাতির আলোয় হন্টনরত কয়েকজন যুবকের পাশে আছি আমিও। আলোচনা হচ্ছে সদ্য সমাপ্ত অন্তঃবিভাগীয় ক্রিকেট লীগ - এপিএল নিয়ে। হঠাৎ একজন বলে, ''বন্ধু, আজকে ব্যাটিংকরে মজা পাইসি। রানও করসি। একটা সিগারেট খাওয়া।'' যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, সেই আমি আবার অগ্নি-সুধা বঞ্চিত দলের পথযাত্রী। সাথেসাথেই প্রত্যাখ্যান করলে প্রথম উল্লেখিত ব্যক্তি ফেরে আরেক বন্ধুর দিকে। সেই বন্ধুটি অবশ্য অভিব্যক্তিহীন কণ্ঠ্যে আবদার গ্রহণ করে। অগ্নি-সুধা ভোগকারী কিংবা বঞ্চিত, দুদলের মনেই একটা খুশি-খুশি ভাব। অনেকদিন পর আয়োজন করা হয়েছে নৃবিজ্ঞান প্রিমিয়ার লীগ। সফল সেই আয়োজনে কারো দল জিতেছে, হেরেছে বন্ধুর দল। কিন্তু দিনশেষে ক্রিকেট-বন্ধুত্বে সবার আনন্দ-হতাশা এসে মিশে গেছে নৃবিজ্ঞানের আবেগের মোহনায়।
বলছিলাম, নৃবিজ্ঞান প্রিমিয়ার লীগ (এপিএল) -এর সদ্য সমাপ্ত তৃতীয় আসর নিয়ে। ২০১৪ সালে বসেছিল দ্বিতীয় আসর। প্রায় ৩ বছর দেখা নেই ক্রিকেট উৎসবের। কয়েকজন তরুণ শিক্ষক আর সিনিয়র শিক্ষার্থীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আবার দেখা মেলে এপিএলের। অনেকদিন পর আয়োজিত হওয়ায় ক্রিকেট উৎসব নিয়ে এবার শুরু থেকেই ছিল ব্যাপক আগ্রহ-আলোচনা। অনেকেরই প্রথম টুর্নামেন্ট। ৪ দলের টুর্নামেন্ট। নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রের বিখ্যাত ৪ তাত্ত্বিক ফ্রানৎস বোয়াস, র্যাডক্লিফ ব্রাউন, এরিক উলফ ও লেভি-স্ট্রসের সম্মানে দলগুলোর নাম রাখা হয় বোয়াসিয়ান ফাইটার্স, র্যাডক্লিফ রেনিগেডস, উলফ রাইডার্স এবং লেভি টাইগার্স। প্রতি দলে ছিলেন একজন করে আইকন খেলোয়াড় আর কয়েকজন করে শিক্ষক। দলগঠন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক দলের বাজেট ছিল ১০ লক্ষ বায়বীয় টাকা। ঘটা করে অনুষ্ঠিত হওয়া খেলোয়াড় নিলামে সেই টাকার মধ্যেই দলের জন্য ১৪ জন করে খেলোয়াড় ক্রয় করেন আইকন খেলোয়াড়রা। সাথে প্রতি দলে বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের একজন করে দলভুক্ত হন।
এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুম, আড্ডা-আলোচনায় ৪ ভাগ হয়ে গিয়েছিল নৃবিজ্ঞান। বর্তমান শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাবেকরাও ছিলেন এই বিভাজনে, মদদ যুগিয়েছেন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকবৃন্দও। সমর্থক টানতে টেবিলের নিচের রাস্তাও গ্রহণ করতে ছাড়েনি দলগুলো। দুর্নীতি দমন কমিটি গঠন করা হলেও তার সভাপতি জাহিন হায়দারের সকল রিপোর্টকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে নির্বিচারে চলে দুর্নীতি। সমর্থক টানার এই প্রতিযোগিতায় শেষপর্যন্ত বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয় র্যাডক্লিফ রেনিগেডস। অধিকাংশ প্রমীলা ক্রিকেট অনুরাগী তাদের পতাকাতলে চলে আসায় অন্য দলগুলোর চক্ষুশূলে পরিণত হয় দলটি।
ফটোগ্রাফঃ মাঠের বাইরের চ্যাম্পিয়ন র্যাডক্লিফ রেনিগেডস
হুমকি-ধামকি, নিত্য-নতুন সব অফারের পর পহেলা ফাল্গুনের সকালে শুরু হয় তৃতীয় আসর। প্রথম ম্যাচেই তারকাখচিত দল উলফ রাইডার্সকে ১০ উইকেটে পরাজিত করে সবার আকর্ষণ কেড়ে নেয় বোয়াসিয়ান ফাইটার্স। তবে সব ম্যাচই এমন একপেশে ছিল না। টানটান উত্তেজনায় ভরা দ্বিতীয় ম্যাচে মাত্র ৭ রানে লেভি টাইগার্স হার মানে র্যাডক্লিফ রেনিগেডসের সাথে। পরের দিন অবশ্য রেনিগেডসের ভাগ্যদেবী সাথে ছিলেন না। তাদের ৮ উইকেটে হারিয়ে প্রথম জয়ের দেখা পায় উলফ রাইডার্স। তবে এদিনও জয় পাওয়া হয়নি টাইগারদের। আবারো ৭ রানে হেরে যায় বোয়াসিয়ানদের কাছে। টানা ২ ম্যাচ জিতে প্রথম দল হিসেবে ফাইনাল নিশ্চিত করে ফাইটার্স। তৃতীয় দিনের খেলায় বাকি তিন দলই নেমেছিল অনেক সমীকরণ মাথায় নিয়ে। দিনের প্রথম ম্যাচে টাইগারদের বড় ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালের পথ প্রায় নিশ্চিত করে রাইডার্স। অন্যদিকে টানা ৩ ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় লেভি টাইগার্স। পরের ম্যাচও জমেনি তেমন। রেনিগেডসকে মাত্র ৬৮ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৬ উইকেটের জয়ে অপরাজিত থেকেই ফাইনালে যায় ফাইটাররা।
একদিকে অপরাজিত বোয়াসিয়ান ফাইটার্স, অন্যদিকে প্রথম ম্যাচে বড় পরাজয়ের তেতো স্বাদ নিয়েও ঘুরে দাঁড়ানো উলফ রাইডার্স। ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মুখোমুখি হয় মাঠের সেরা দুই দল। ফাইনালে টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বোয়াসিয়ান ফাইটার্স কাপ্তান মাহফুজ। শুরুতেই ওপেনিং জুটি ভেঙ্গে দিয়ে দলপতির সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছিলেন বোলাররা। কিন্তু অপুর দুর্দান্ত ক্লাসিক্যাল ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনীতে চাপ সামলে ওঠে রাইডার্স। তবে অপু দলকে বড় সংগ্রহ দেবার চেয়ে প্রমীলা দর্শকদের হৃদয় হরণেই বেশি মনোযোগী ছিলেন পুরো ইনিংস জুড়েই। অপুর ৫৫ রানের ইনিংসের পাশাপাশি চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে কম যাননি নিলয় আর মেহেদীও। বেড়ধক পিটুনিতে বোলারদের নাকাল করে ছাড়েন রাইডাররা। ১৬ ওভারের ম্যাচে ১৭৮ রানের বিশাল টার্গেট দাঁড় করান ফাইটারদের সামনে।
ফটোগ্রাফঃ খেলার মাঠে চ্যাম্পিয়ন উলফ রাইডার্স
জবাবে শুরুটা ভালো করলেও বোয়াসিয়ানদের ব্যাটিং এর মূল স্থপতি নোমান আউট হয়ে যান দ্বিতীয় ওভারেই। এরপর ধীর গতিতে চলতে থাকে ফাইটারদের রানের চাকা। মারকুটে ব্যাটিংয়ের জন্য খ্যাত সনিও জ্বলে উঠতে পারেননি ফাইনালে। পিয়াস, সাকিব, মাহফুজ আর শেষের দিকে কাজল আর আরাফাতের ঝড়ো ইনিংসেও তাই শেষরক্ষা হয়নি ফাইটারদের। ১৬ ওভারে ১৫২ রানে থামে তারা। ২৫ রানে ম্যাচ জিতে এপিএলের তৃতীয় আসরের শিরোপা জিতে নেয় উলফ রাইডার্স।
রাইডার্স বোলার মমিনুল জেতেন ফাইনাল সেরা ও সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের তকমা। আসর জুড়ে বোয়াসিয়ান ফাইটার্সের হয়ে দারুণ অলরাউন্ড পারফর্ম করা ডিপার্টমেন্টের সাবেক শিক্ষার্থী নোমান নির্বাচিত হন টুর্নামেন্ট সেরা। সেরা সমর্থকের পুরস্কার জেতেন সবগুলো ম্যাচে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকা প্রমীলা ক্রিকেটার শারমিন সুলতানা।
এ তো গেলো পুরষ্কারের কথা। নৃবিজ্ঞান পরিবারের ছোট্ট ধরিত্রীতে ৪ দিন ব্যাপী ক্রিকেট উৎসবে সাবেকদের সাথে পুনর্মিলন, নতুনদের মাতামাতি, শিক্ষকদের উচ্ছ্বাস, কিংবা স্লেজিংয়ে জয়-পরাজয়ের আনন্দ-হতাশা উপচে সুবাস ছড়িয়েছে ক্রিকেট-বন্ধুত্ব। যেমনটা দেখা গিয়েছে, প্রতি ম্যাচে প্রচুর দর্শক উপস্থিতি, ফাইনালের নায়ক অপুর রেনিগেডস মালিকের প্রতি জয় উৎসর্গ করা কিংবা নিজের দল বাদ পড়ে যাবার পরও বন্ধুর দল সমর্থনের মধ্য দিয়ে। এমনই থাকুক না নৃবিজ্ঞান। ভালোবাসা আর আবেগে বন্দী হয়ে!
- 0 মন্তব্য