• ক্রিকেট

সে ছিল শুধু তাঁরই দিন...

পোস্টটি ২১১৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
ক্রিকেট অমৃতের সন্ধান দিয়েছিলেন আব্বু। ছেলেবেলায় আব্বুর সাথে ক্রিকেট দেখার সময়, আব্বু মেলে ধরতেন ক্রিকেট ইতিহাসের এক-একটি পাতা। কোন ম্যাচে কে কি করেছিল, না-করেছিল সেসব বলতেন। আরেকজন ছিলেন দিদার ভাইয়া। যখন বাসায় আসতেন, আব্বু আর দিদার ভাইয়ার সাথে ক্রিকেট দেখার মধ্যে কি যে আনন্দ ছিল, তা বলার মতো নয়! দিদার ভাইয়া ক্রিকেট দেখার সময় বিশ্লেষণ করতেন, ক্রিকেটের খুঁটিনাটিও। বল স্পিন করছে, সুইং হচ্ছে, কেন হচ্ছে সেসব বলতেন।
সেই দিদার ভাইয়াকে দেখেছি, প্রায় আব্বুর সাথে লারার একটা ইনিংস নিয়ে গল্প করতেন। ওয়ালশকে সাথে নিয়ে নাকি লারা একাই ম্যাচ বের করে ফেলেছিলেন। আমি শুনতাম, কিছু বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না।
 
 
230007
                                
 
পরিণত বয়সে লারার সেই ইনিংস সম্পর্কে আরো জেনেছি, লারার সম্পর্কেও আরো জেনেছি। তবুও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন যেন বহুদিন সেই ইনিংস দেখা হয়নি! পরে ইউটিউবের কল্যাণে তাও দেখা হয়েছে। ব্রায়ান লারার সেই ইনিংস, যে ইনিংস কি না, অনেকের মতেই তাঁর সেরা ইনিংস! যে টেস্টকে স্টীভ ওয়াহ বলেছিলেন, তাঁর জীবনের সেরা টেস্ট ম্যাচ। বার্বাডোজের প্রথম সারির পত্রিকা 'ডেইলি নেশন' যে ম্যাচের পরদিন শিরোনাম দিয়েছিল, 'শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ম্যাচ'। রিপোর্টার হেইডন গিল রিপোর্টে লিখেছিলেন, 'ইতিহাসের পাতায় এই ম্যাচ লেখা থাকবে গৌরবোজ্জ্বল প্রত্যাবর্তনের প্রতীক হিসেবে।'
কি ছিলো সেই ম্যাচে? কি হয়েছিল সেদিন? কি করেছিলেন লারা?
চলুন তাহলে একটু ঘুরে আসা যাক, '৯৯ এর ৩০শে মার্চের বার্বাডোজের সেই বিকেলবেলা থেকে...।
 
 
টস জয়ের ফায়দাটা পুরোপুরি তুলে নিয়ে স্টীভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া প্রায় পৌনে দুইদিন ব্যাট করে, স্কোর বোর্ডে জমা করেছিল ৪৯০ রান। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের আক্ষেপ বলতে একটাই, অধিনায়ক স্টীভ ওয়াহ পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে কাঁটা পড়েছিলেন ১৯৯তে। স্টীভ ওয়াহর এক রানের আক্ষেপটা ম্যাচ শেষে যে এক উইকেটের আক্ষেপে গিয়ে ঠেকবে কে তখন ভেবেছিল?
দ্বিতীয় দিনশেষে অবশ্য স্টীভ ওয়াহর আক্ষেপ-ক্লেদ যা ছিল, তা অনেকটাই মুছে গিয়েছিল। কারণ শেষ বিকেলে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮০ রানেই হারিয়ে বসেছে চার উইকেট। অধিনায়ক লারাও দলকে আরো কোনঠাসা করে দিয়ে, ফিরে গেছেন দিনের খেলা শেষের ওভার তিনেক আগে। তখন কে জানতো, দিন তিনেক পরে সেই লারাই জন্ম দেবেন অবিশ্বাস্য এক রুপকথার!
 
 
৯৮ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ফলোঅন আশংকায় কাঁপতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফলোঅন এড়াতে পেরেছিল, লোয়ার অর্ডারের ব্যাটে ভর দিয়ে। রিডলি জ্যাকবস আর শেরউইন ক্যাম্পবেলের ইনিংসে ঠেস দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছে গেলেও, অস্ট্রেলিয়া পেয়ে গিয়েছিল ১৬১ রানের বিশাল লিড।
ক্যারিবীয়ন সাগর পাড়ের হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝড়ের মতো, এক ঝড় এসে যেন লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় পালার ব্যাটিং। ওয়ালশ সাবাড় করেছিলেন অর্ধেক, বাকীটা এ্যামব্রোস-কলিন্স।
 
 
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে তখন ৩০৮ রানের টার্গেট। ইতিহাস বলে, এর চেয়ে বেশী রান চেজ করে জয়ের ইতিহাস আছে মাত্র তেরোটি। যার তিনটিতেই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেটাকে অনুপ্রেরণা মেনে, প্রায় দেড়দিন হাতে নিয়ে, চেজ করতে নামা ওয়েস্ট ইন্ডিজ শুরুটা ভালো করলেও, খেই হারিয়ে ফেলেছিল, সেই গোধূলী বেলার ম্লান সূর্যের আলোয়। লারার বদলে নাইট ওয়াচম্যান পেড্রো কলিন্সও আউট হয়ে গেলে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দিন শেষ করে ৮৫/৩ অবস্থায়। গ্রিফিথের সাথে অপরাজিত ছিলেন ব্রায়ান লারা।
 
 
পঞ্চম দিনের সূচনায় লারাকে ছেড়ে গেলেন গ্রিফিথ, তার একটু পর গেলেন কার্ল হুপারও। ১০৫ রানে নেই পাঁচ উইকেট। জয় কি সম্ভব? জিমি এ্যাডামসকে সাথে নিয়ে লারা যেন জানিয়ে দিলেন, কেন নয়?
হুপার আউট হওয়ার আগেই ম্যাকগ্রাকে চোখ ধাঁধানো এক কাভার ড্রাইভে চার মেরে বুঝি জানিয়ে রেখেছিলেন, 'এ শুধু তাঁরই দিন, এ লগনও তাঁর জয়মাল্য গাঁথার।' জিমি-লারা ম্যাচ জেতানো জুটিতে যোগ করেছিলেন ১৩৩ রান। ম্যাকগিলের এক ওভার থেকে ১৪ রান নিয়ে অসম্ভবের পথে হাঁটার ইচ্ছেটাও প্রবলভাবে জানিয়ে দিলেন।
 
192515.7
                  একজন আরেকজনকে যেন বলছেন, 'দেখে নেবো।'
 
 
ম্যাকগ্রার বাউন্সার আঘাত হেনেছিল লারার হ্যালমেটে, চোখাচোখি হলো দুজনার। কথা কাটাকাটিও হলো। রাগে টগবগ করে ফুটতে থাকা ম্যাকগ্রা আবার দিলেন শর্ট বল, লারা সেটাকে পুল শটে পথ দেখালেন সীমানা দড়ির ওপারে। ওয়ার্নের অফ স্ট্যাম্পের অনেকটা বাইরে পড়ে মিডল স্ট্যাম্পের দিকে আসা বলটাকে লারা আছড়ে ফেললেন কেনসিংটন ওভালের গ্যালারীর ছাদে। ওয়ার্নের বলকেই লং অনের উপর দিয়ে বাউন্ডারী ছাড়া করে, তিন অংকে পৌঁছেছিলেন তিনি।
 
লারার সেঞ্চুরীর পরপর বিদায় নিলেন জিমি এ্যাডামস। এ্যাডামস যাওয়ার আগে ৩৮ রানের চেয়েও বেশী যেটা গুরুত্বপূর্ণ, লারাকে সঙ্গ দিয়ে গড়ে দিয়েছিলেন জয়ের ভিত্তিপ্রস্তর। ঠিক যেমন করেছিলেন আগের ম্যাচে, জ্যামাইকা টেস্টে ৩২২ রানের(সে ম্যাচেও লারা জন্ম দিয়েছিলেন আরেক ক্ল্যাসিক টেস্ট ইনিংস ২১৩, এ্যাডামস করেছিলেন ৯৪) জুটি গড়ে।
 
 
টেস্ট ক্রিকেটের অত্যাশ্চার্য্য সৌন্দর্য্যের যেন মাত্রই শুরু হয়েছিলো। ওভার চারেক পর ম্যাকগ্রা আঘাত হানলেন আবার। পরপর দুই বলে ফেরালেন জ্যাকবস-পেরিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় তখনও বহু দূরের বাতিঘর। আরো ষাট রান করতে হবে, উইকেট মাত্র দুটি। এ্যামব্রোস আর ওয়ালশ। এ্যামব্রোস যোগ্য সঙ্গই দিলেন অধিনায়ককে। জয় থেকে মাত্র ছয় রান দূরে থাকতে এ্যামব্রোসকে ফেরালেন গিলেস্পি।
প্রায় ঘন্টা খানেক সঙ্গ দেয়া, সহযোগীর উপর আস্থা রেখে ব্রায়ান লারা চার-চারটি বল খেলতে দিয়েছিলেন এ্যামব্রোসকে। প্রথম বলেই স্লিপে ক্যাচ দিলেন এ্যামব্রোস। হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলো গোটা ব্রিজটাউন তো বটেই, পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজও! এ্যামব্রোসের পা যেন বলছে, প্যাভিলিয়ন সে কতদূরের পথ! মাদকাসক্তের মতো টলতে টলতে মাঠ ছাড়লেন এ্যামব্রোস।
 
ওয়ালশকে ঠেকাতে হবে আরো তিন বল। ওয়ালশের ব্যাটিং সামর্থ্যের সংশয়ে নার্ভাস ছিলেন, ওয়ালশ নিজেই। অস্ট্রেলিয়ানরা তখন রক্তের স্বাদ পাওয়া নেকড়ের মতো, নিরীহ ওয়ালশের উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। গিলেস্পি অতি উত্তেজনার বশেই কি না, প্রথম বলটি করে বসলেন নো বল! পরের বলটি কোনমতে ঠেকালেন ওয়ালশ। পঞ্চম বলটি ছিল ইয়র্কার, পড়িমরি করে ঠেকালেন কোর্টনি। শেষ বলটিও ছিল স্ট্যাম্পে, সমর্থকদের আটকে রাখা শ্বাসটুকু ছাড়ার সুযোগ দিয়ে সে বলটিও ঠেকিয়ে দিলেন ওয়ালশ।
 
তখনও দরকার পাঁচ রান। ম্যাকগ্রার বল লারার ব্যাট ছুঁয়ে, চলে গিয়েছিল স্লিপে দাঁড়ানো ওয়ার্নের দিকে। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়েও তালুবন্দী করা যায়নি সেটা। বরং দুই রান নিয়ে জয়ের আরো একটু কাছে চলে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ফাস্ট বোলার হয়েও সেদিনের তিনভাগের প্রায় একভাগ বল করেছিলেন ম্যাকগ্রাই। সেই ক্লান্তি থেকেই হয়তো অফ সাইডে ওয়াইড দিয়ে বসলেন তিনি। মাত্র দুই রান দরকার আর। ম্যাকগ্রার বাউন্সারেই লারা শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন সমস্ত উত্তেজনা। কিন্তু ফাইন লেগ থেকে বল ফেরত আসার আগে নেয়া গেল কেবলমাত্র একরান। ম্যাচ টাই।
স্ট্রাইকে ওয়ালশ। বোলিংয়ে ম্যাকগ্রা। সেই ‘স্যার ফ্র্যাংক ওরেল’ ট্রফি। সেই অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আরো একটি টাইয়ের খুব কাছে টেস্ট ক্রিকেট। কিন্তু হলো না।
ম্যাকগ্রা যে তাঁর সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন আগেই। তাই অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলটি ছেড়ে দিতে কোনো সমস্যাই হলো না ওয়ালশের। ৪৪ ওভারের অদম্য লড়াই সত্ত্বেও ম্যাকগ্রাকে সেদিন থাকতে হয়েছিল পরাজিতের দলে। ম্যাচে ৭৭ ওভারের সংগ্রাম আর নয় উইকেট প্রাপ্তির পরও তাঁর লড়াই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ক্রিকেট-বরপুত্রের মহাকাব্যিক ইনিংসটির চাদরে।
 
ম্যাচ শেষ করতে মাত্র আর একটি বলই সময় নিয়েছিলেন, ব্রায়ান লারা। গিলেস্পির অফ স্ট্যাম্পের বাইরে গুড লেংথের বলটিকে কাভার ড্রাইভে সীমানা ছাড়া করে লারা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এ শুধু তাঁরই দিন, এ লগনও তাঁর জয়মাল্য গাঁথার।’
 
image_20130330101922 
          উদ্বেলিত ক্রিকেট সমর্থকদের ভালোবাসায় সিক্ত...
 
বার্বাডোজের সোনালী সূর্য সেদিন বিদায় নেয়ার আগে, আরো একবার দেখিয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য্য কত রঙিন, কত রোমাঞ্চকর ও কতটা উপভোগ্য হতে পারে! আর যেন মনে করিয়ে দিয়েছিল সেই চিরন্তন কথাটাই, কোনমতেই হাল ছেড়ো না বন্ধু বিশ্বাস রেখো মনে! দিনশেষে বিজিত নয় বিজয়ী তুমিই হবে।