• ক্রিকেট

তালহা জুবায়েরঃ একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু

পোস্টটি ৩৩৩১৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আমাদের দেশে জেনুইন ফাস্ট বোলিং প্রতিভার আকাল একদম শুরু থেকেই। কালের পরিক্রমায় আমরা হয়ত মাশরাফি, মুস্তাফিজ, তাসকিন, রুবেল, আল-আমিনদের মত ট্যালেন্টেড ফাস্ট বোলার পেয়েছি, তবে এমন অনেক প্রতিভা আছে সময়ের স্রোতে যারা হারিয়ে গেছে কালের অতল গহবরে। সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ পেসারদের অনেককেই নাম লেখাতে হয়েছে অকালে ঝরে পড়াদের খাতায়। বিশেষ করে ২০০৪ সালের পূর্বের সময়টাতে ট্রেনিং সিস্টেম থেকে শুরু করে ইয়ুথ সিস্টেম ছিল এককথায় অকার্যকর। এই সিস্টেমের যাঁতাকলে পড়ে হারিয়ে গেছে অসংখ্য প্রতিভাবান প্লেয়ার। এরকমই এক ফাস্ট বোলিং সেনসেশন ছিলেন তালহা জুবায়ের। তার প্রতিভা নিয়ে বিন্দুমাত্র কারো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তার মত প্রতিভাবান পেসারকে যথাযথভাবে নার্চার করার মত আর্থিক অথবা টেকনিকাল সামর্থ্য ছিল না বাংলাদেশের। যার ফলে খুব দ্রুতই একসময় হারিয়ে যান তালহা জুবায়ের।

১৯৮৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলায় জন্ম তালহা জুবায়েরের। কিশোর বয়স থেকেই তালহাকে সবাই চিনত একজন জেনুইন ফাস্ট বোলার হিসেবে। প্রথম থেকেই মাশরাফির পাশাপাশি তালহাকেও মনে করা হত বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের ভবিষ্যত। মাশরাফির মত তালহারও শক্তির জায়গা ছিল গতির সাথে সুইং। অনেকের মতে সেই যুগে মাশরাফির চেয়েও জোরে বল করতে পারতেন তিনি। ফলশ্রুতিতে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই টেস্ট অভিষেক! সেটাও ইনজুরি আক্রান্ত মাশরাফির জায়গায় সুযোগ পেয়েই!

২০০২ সালের ২১ জুলাই শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথমবার খেলতে নেমেই বেশ হইচই ফেলে দেন তালহা জুবায়ের। ১৬ বছরের এক নবীন আনকোরা ফাস্ট বোলারের হাতে নতুন বল তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। ক্যাপ্টেনের আস্থার প্রতিদান দিতেও খুব একটা সময় নেন নি তালহা। প্রথম স্পেলেই এনে দিয়েছিলেন কাঙ্খিত ব্রেকথ্রু! কলম্বোর পি সারা ওভালের নিষ্প্রাণ উইকেটেও সেদিন গতির ঝড় তুলেছিলেন তালহা! যে গতির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন নি আতাপাত্তু-জয়াবর্ধনের মত ব্যাটসম্যানরাও। ১৪০ কিমি গতির দুর্দান্ত দুটি ইনসুইঙ্গারে উপড়ে দিয়েছিলেন মারভান আতাপাত্তু (২০) এবং মাহেলা জয়াবর্ধনের (০) মিডল স্টাম্প।

তালহা জুবায়েরের এই প্রতিভার কথা অবশ্য বাংলাদেশে কারো অজানা ছিল না। তবে ইমার্জিং ট্যালেন্ট হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেটে পরিচিতি পেতে তার এমন পারফরম্যান্সই দরকার ছিল। টেস্ট ক্যারিয়ারের শুভ সুচনা তাকে ডাক পাইয়ে দেয় ওয়ানডে দলেও। ২০০২ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার ওয়ানডে অভিষেকটাও হঠাৎ করেই। তবে অভিষেকটা মোটেও মনে রাখার মত ছিল না মাশরাফির ইঞ্জুরিতে সুযোগ পাওয়া তালহার! কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের ফ্ল্যাট ব্যাটিং উইকেটে কিউই ব্যাটসম্যানদের সামনে মোটেও সুবিধা করতে পারেন নি তিনি। সেদিন শুরু থেকেই তার উপর চড়াও হয়েছিলেন স্টিফেন ফ্লেমিং-ম্যাথু সিনক্লেয়াররা। তার প্রথম ৫ ওভারের স্পেলেই রান এসেছিল ৪৫! তাই পরে আর বোলিংই পান নি তিনি। সেদিন নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৪৬ রানের টার্গেটের সামনে মাত্র ৭৭ রানেই গুটিয়ে যাই আমরা।

039360

ওই বছরই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের দলেও সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডেতে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ৪ উইকেট নিয়ে আবারো নিজের প্রতিভার কথা জানান দেন তিনি। গ্রায়েম স্মিথকে (২৮) স্লিপে জাভেদ ওমরের ক্যাচ বানিয়ে শুরু। এরপর তালহার আঘাতে সেদিন একে একে প্যাভিলিয়নে ফেরত গিয়েছিলেন বোটা ডিপেনার (৪১), শন পোলক(২) আর ল্যান্স ক্লুজনারের(৯) মত ব্যাটসম্যান। অবশ্য গিবসের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে (১৫৩) দক্ষিণ আফ্রিকা পেয়েছিল ৩০১ রানের বিশাল পুঁজি। ৩০২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে বাংলাদেশ অলআউট হয় মাত্র ১৩৩ রানে।

সত্তর ও আশির দশকে খেলা কিংবদন্তী ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টস সে বছর ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলাদেশি পেসারদের নিয়ে কিছুদিন কাজ করেছিলেন তিনি। এদের মধ্যে দুইজন পেসারকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। চলে যাবার আগে দুজনকেই তিনি 'এক্সেপশনাল' বোলারের সার্টিফিকেট দিয়ে গেছিলেন। এদের একজন হলেন মাশরাফি, আরেকজন ছিলেন তালহা জুবায়ের! মাশরাফি, তালহাদের আবির্ভাবের পর সবার মধ্যে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মেছিল যে বাংলাদেশও জেনুইন ফাস্ট বোলার তৈরি করতে পারে।

তালহা জুবায়েরের মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০০৩ বিশ্বকাপে অবশ্য খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয় নি তার। মাত্র ২টি ম্যাচ খেলে ১ উইকেট পেয়েছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবগুলো ম্যাচ হেরে সেই বিশ্বকাপ ছিল বাংলাদেশের জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্ন! তালহা জুবায়ের এরপর তার প্রতিভা ও সামর্থের প্রমান দিতে থাকেন ঘরোয়া ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে। ঘরোয়া লীগে তার ১৪০-১৪৫ কিমি গতির গুড লেংথে পড়া ডেলিভারিগুলো ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য রীতিমত আতংকের নাম। ক্যারিয়ারের শেষদিকে ফিটনেস ও বাজে ফর্মের কারণে হারিয়ে গেলেও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তালহা জুবায়েরের ওভারঅল রেকর্ড ছিল এককথায় দুর্দান্ত! ৭৩টি ফার্স্টক্লাস ম্যাচ খেলে মাত্র ২৬.৮ গড়ে তিনি নিয়েছেন ২২২টি উইকেট! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন পেসার হিসেবে তার এই রেকর্ডকে অসাধারণ বললেও কম বলা হবে! ফার্স্টক্লাস ক্রিকেট খেলা সবচেয়ে সফল বাংলাদেশি বোলারদের তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকবেন তালহা জুবায়ের।

84806

একজন জেনুইন ফাস্ট বোলার হওয়ার জন্য যে ধরনের দৈহিক গড়ন, শারীরিক সক্ষমতা ও ফিটনেস লাগে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার কোনটাই ছিল না তালহার। বারবার ইঞ্জুরিতে পড়ায় ছন্দ হারাতে থাকেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য পেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুর ছন্দটা আর কখনোই সেভাবে ধরে রাখতে পারেন নি। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর থেকে তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি। বলের গতি ও ধার দুটোই কমে গিয়েছিল সময়ের সাথে। তার একটা বড় প্রভাব পড়েছিল পারফরম্যান্সেও। ক্যারিয়ারের সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেন চট্টগ্রামে ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ১৯ ওভার বোলিং করেও উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। আর ২০০৩ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে দলেও আর একবারের জন্যও দেখা যায় নি তাকে।

এরপরেও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করে জাতীয় দলে ফেরার আশা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আর কখনোই জাতীয় দলের জন্য বিবেচনায় আনা হয় নি তাকে। পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে তিনি ভাল করতেন না খারাপ করতেন; আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অবশ্য সেটা বলা কঠিন। তবে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিভা ও সামর্থ্য দুটোই তার মধ্যে ছিল।

৭ টেস্টে ১৪ আর ৬ ওয়ানডেতে ৭ উইকেটের থমকে যাওয়া ক্যারিয়ারটা শেষ পর্যন্ত একটা আক্ষেপের গল্প হয়েই থেকে গেছে। বিসিবির পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে যদি তালহা জুবায়েরের ফিটনেস ও স্কিল নিয়ে কাজ করা যেত, তাহলে হয়ত এভাবে হারিয়ে যেতেন না তিনি। আজ হয়ত তালহা জুবায়েরের নাম বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেও ছড়িয়ে পড়ত। হয়ত আমাদের অবহেলার কারণেই 'তালহা জুবায়ের' নামের এক সম্ভাবনাময় প্রতিভাকে হারিয়েছি আমরা। কে জানে আজকে হয়ত তিনি বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের নেতৃত্বও দিতে পারতেন, হতে পারতেন দলের জন্য এক বিরাট সম্পদ। হয়তবা সেটা নাও হতে পারত, তবে সেই উত্তরটা কিন্তু অজানাই থেকে গেছে।