• ক্রিকেট

একটি রান চেজের গল্প,একটি ইতিহাস

পোস্টটি ৯৭৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০১২ এশিয়া কাপ,ঢাকা। ১৬ই মার্চ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল ভারতের সাথে। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে চেপে ধরেও জয় আসেনি , মানসিকভাবে একটু ব্যাকফুটেই ছিল টাইগাররা। তারওপর সদ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের সাথে খেলা।ক্রিকেটবোদ্ধারা এ ম্যাচে বাংলাদেশের কোন সম্ভাবনা দেখেননি বরং তাদের আগ্রহ ছিল এ ম্যাচে শচীনের শততম সেঞ্চুরীর সম্ভাবনা নিয়ে।কিন্তু ক্রিকেটে নিশ্চিত নয় কোন কিছুই।এটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। এ ম্যাচে টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেই জয়ের মালা উঠেছিল টাইগারদের গলাতেই !

শুরুতেই টসে জিতে ফিল্ডিং এ বাংলাদেশ। ভারতের ওপেনিং এ নামলেন গৌতম গম্ভীর ও শচীন টেন্ডুলকার।এই জুটি চেপে বসার আগেই প্রথম ধাক্কাটা দিলেন শফিউল ইসলাম।ষষ্ঠ ওভারে বোল্ড করে সাজঘরে পাঠালেন গম্ভীরকে।কিন্তু ভারতের রানের গতিতে বাধ দিতে পারছিলেন না মাশরাফিরা।দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে শচীন এবং বিরাট কোহলি পরবর্তী ৩০ ওভারে যোগ করেন ১৪৮ রান।৩৫ ওভা্রেই টিম ইন্ডিয়া তুলে ফেলে ১৭৩ রান এক উইকেটে।ব্যাটিং পাওয়ার প্লের প্রথম ওভার করতে এলেন আবদুর রাজ্জাক।পঞ্চম বলে এজ হয়ে বোল্ড কোহলি। নতুন ব্যাটসম্যান এলেন,কিন্তু রান হয়েই যাচ্ছিল।চারে নামা সুরেশ রায়না এবং টেন্ডুলকার রান তুলছিলেন ওভারপ্রতি আট করে।একপ্রান্তে ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি শচীন একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন শততম শতকের দিকে আর অন্যপ্রান্তে কব্জির জোরে ঝড় তুলছিলেন রায়না। ৪৩তম ওভারে টেন্ডুলকার পৌছে গেলেন এই অবিশ্বাস্য মাইলফলকে,তুলে নিলেন একশততম সেঞ্চুরী। মিরপুর স্টেডিয়াম সাক্ষী হল এই অতিমানবিক কীর্তির।

৪৭তম ওভারে শেষপর্যন্ত মাশরাফি ভাঙলেন এই জুটি।ফিফটির পর তুলে মারতে গিয়ে তামিমের হাতে জমা পড়লেন রায়না।পরের বলেই আবার মাশরাফির আঘাত।উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ব্যক্তিগত ১১৪ রানে ফিরলেন টেন্ডুলকার।ততক্ষণে ভারতের রান হয়ে গেছে ২৫৯। পরের দুই ওভারে তেমন রান এল না,আউট হলেন রোহিত শর্মা।কিন্তু শাহাদাতের করা ইনিংসের লাস্ট ওভার থেকে ধোনি বের করে নিলেন ১৭ রান। ৫০ ওভার শেষে ভারত ২৮৯ রানের পাহাড়ে।

ঘরের মাটিতে তখনো এখনকার মত অপরাজেয় রুপে দেখা দেয়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরার মত একজনও ছিল না,কিন্তু চিত্রনাট্য আস্তে আস্তে পাল্টাতে লাগল।

বাংলাদেশের ইনিংসের শুরু থেকেই হাঁসফাঁস করছিলেন তামিম ইকবালের সঙ্গী ওপেনার নাজিমউদ্দিন। ১৫ বলে ৫ রান করে নাজিমউদ্দিন ফিরলেন প্রাভিন কুমারের বল আকাশে তুলে দিয়ে।দলের রান তখন কেবল ১৫। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে দলকে পথ দেখালেন তামিম এবং জহুরুল ইসলাম। ১১৫ রানের জুটি গড়ে দলকে শক্ত ভিত্তি দিলেন দুই ব্যাটসম্যান। কিন্তু রানরেটটা বড্ড কমে গিয়েছিল।রানরেটের সাথে পাল্লা দিতে গিয়েই ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি করে ক্লান্ত এক শটে জহুরুল যখন ফিরলেন তখন বাংলাদেশের রান ২৮.৫ ওভারে ১২৮।

এই ভিত্তি কাজে লাগিয়ে দ্রুত রান তোলার জন্য চারে নামানো হলো নাসির হোসেনকে। ৩৪তম ওভারে ব্যাক টু ব্যাক ফিফটি করা তামিমও ফিরলেন ব্যক্তিগত ৭০ রানে।বাংলাদেশ তখন ১৫৬,রিকোয়ার্ড রানরেট সাড়ে আটের কাছাকাছি।জয়টাকে তখন দূরের বাতিঘরের মতই লাগছিল।কিন্তু পাঁচে নামা সাকিব আল হাসান অন্যরকম কিছুই ভেবেছিলেন।

ব্যাটিং পাওয়ারপ্লেতে ৩৭তম ওভার করতে এলেন অশোক দিন্দা।সাকিব ঝড়ের শুরুটা দিন্দার উপর দিয়েই গেল। দুটো চার এবং মিড উইকেট দিয়ে বিশাল এক ছক্কাসহ এই ওভার থেকে সাকিব নিলেন ১৭ রান।অশ্বিনের করা ৩৮ এবং ৪০তম ওভার থেকে সাকিব নিলেন ১৯ রান। ৪১তম ওভারে ইরফান পাঠানের ওভার থেকে এল আরো ১০ রান।সাকিব আল হাসান ২৭ বলে ৪৮ করে জয়ের আশা জাগিয়ে ক্রিজে আছেন ।

কিন্তু ঠিক পরের ওভারের পঞ্চম বলে স্টাম্পড হয়ে ফিরলেন সাকিব।যদিও থার্ড আম্পায়ারের রিপ্লে দেখে নট আউট বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু অতীতের অনেকবারের মতই ফিফটি ফিফটি ডিসিশন বাংলাদেশের বিপক্ষে গেল।

সাকিব যখন ২৯ বলে ৪৯ করে ফিরলেন তখনো জয় ৪৮ বলে ৬৫ রানের দূরত্বে।মাথা ঠান্ডা করে খেলে গেলেই পৌছানো সম্ভব। সেট ব্যাটসম্যান নাসির এবং মুশফিকুর রহিম ঠান্ডা মাথায়ই খেলছিলেন।ধীরে ধীরে তরী তীরের কাছে যাচ্ছিল। ৪৭তম ওভার শেষে বাংলাদেশের সামনে ১৮ বলে ৩৪ রানের সমীকরণ দাঁড়াল।খেলাটা স্নায়ুর জোরের ব্যাপারও হয়ে উঠেছিল।এই স্নায়ুচাপের কাছেই হার মানলেন ইরফান পাঠান,চাপ জয় করলেন মুশফিক।পাঠানের করা ৪৮তম ওভার থেকে দুটো ছক্কাসহ ১৭ রান বের করে নিলেন মুশফিক।আর চাই ১২ বলে ১৬।স্ট্রাইকে মুশফিক থাকলেন।

পরের ওভার করতে এলেন প্রাভিন কুমার।ইয়র্কার দিতে গিয়ে প্রথম দুটো বলই হলো ফুলটস,তবে মুশফিক ভুল করলেন না। ওভারের প্রথম দুই বলেই চার-ছয় মেরে দশ রান তুলে নিলেন । এই ওভারের পঞ্চম বলে নাসির যখন ফিফটি করে আউট হলেন তখন আর ৭ বলে ২ দরকার।জয় হাতের নাগালেই।লাস্ট ওভারের দ্বিতীয় বলেই চার মেরে বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে পৌছে দেন মাহমুদুল্লাহ।মহাকাব্যিক এক জয় পায় বাংলাদেশ। আর ম্যান অব দ্যা ম্যাচ বলুন তো কে?সাকিব আল হাসান ছাড়া কেই বা হবে!

এই এশিয়া কাপের ফাইনালেই টাইগারদের পুড়তে হয়েছিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়।তবে এই ম্যাচের ইতিহাস আমাদের ক্রিকেটে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ।ভিত্তিটা করে দিয়েছিলেন তামিম এবংজহুরুল।এরপর সাকিবের ঝড়ো ইনিংসের পাশাপাশি নাসিরের বলের সাথে পাল্লা দিয়ে করা ফিফটি এবং মুশফিকের ইস্পাত কঠিন স্নায়ুতে ভর করেই অবিশ্বাস্য এই রান চেজ করে টাইগাররা ।এই টুর্নামেন্টেই এশিয়ার নতুন শক্তি হিসেবে উঠে আসার জানান দিয়েছিল বাংলাদেশ।এই এশিয়া কাপ ভোলার মত নয়।