সামর্থ্য ঘোষণার সেই রাত
পোস্টটি ৬৯৪২ বার পঠিত হয়েছেএক.
সুযোগ পেলেই লেখার চেষ্টা করি। লেখার মান ও ক্রিকেটজ্ঞান তা যতই শূণ্যের কোঠাতে থাকুক না কেন, লেখার ইচ্ছে তো তাতে থেমে থাকে না! লিখতাম তখনও, যখন ফেসবুক, ব্লগে ততটা সড়গড় হয়ে উঠিনি। পার্থক্য কেবল তখন ছিল ‘লেখক-ই পাঠক, পাঠক-ই লেখক’ অবস্থা, দ্বিতীয় কেউ সেই লেখার পাঠোদ্ধার করতেন না। আর লেখাগুলো ব্লগ বা ফেসবুকের বদলে জায়গা পেতো, পুরনো ফাইলের ক্লিপে।
সেই সময় এশিয়া কাপ যখন এলো, ফাইলবন্দী এক লেখায় সম্ভাবনার নিক্তিতে বাংলাদেশকে দিলাম শিরোপা জয়ের শতভাগ দাবীদারের তকমা। কিন্তু প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে খুব কাছে গিয়েও হেরে যেতে হলো। একটু ভয় হলেও, আত্মবিশ্বাস তখনও টইটম্বুর। বাংলাদেশই জিতবে এবারের এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।
দুই.
পরের ম্যাচ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন(তখনকার) ভারতের বিপক্ষে। গোটা বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়, কখন মাস্টার আরেকটি শৃঙ্গে পা রাখবেন। কখন তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করবে, একশতম একশ। তা নিয়ে আগ্রহ কম নেই আমাদেরও।
সাজানো মঞ্চ তাঁর জন্য খুব একটা কম ছিল না। সেই মোহালীতে পাক-ভারত সেমিফাইনালে গিয়েছিলেন খুব কাছে, তারপর মুম্বাইতে পেয়েছিলেন আরো বড় মঞ্চ। এরপর সারা বিশ্বে কত জায়গায় ঘুরলেন, হলো না। লর্ডসে, টেস্ট ক্রিকেটের ২০০০তম টেস্টে, গোটা দুই ইনিংসেও হয়নি। হয়নি অস্ট্রেলিয়া সফরেও। কতজন বললেন “ও সেঞ্চুরী আমাদের মাঠেই করবে। ঈশ্বরই ঠিক করে রেখেছে তা।” কিন্তু দিনশেষে তাঁরা ভুল প্রমাণ হয়েছেন, অপেক্ষা বেড়েছে আরো।
শচীন টেন্ডুলকার যখন এশিয়া কাপ খেলতে বাংলাদেশে এলেন, আলোচনাটা তখনও জিঁইয়ে রয়েছে। ৯৯তম সেঞ্চুরীর এক বছর পূর্তি হয়ে গেছে। শততমটা হবে কবে? প্রশ্ন শুনতে শুনতে যেন বিরক্ত, ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত তিনি।
মাশরাফি স্বভাব সুলভ রসিকতায় বলে দিলেন “ও যদি সেঞ্চুরী করে এবং আমরা জয় পাই। তাহলে কোনো সমস্যা নেই, সে সেঞ্চুরী করতে পারে।”
তখন কে জানত, মাশরাফির ‘ধরে দেবানি’র মতো এটাও সত্যি হতে যাচ্ছে?
মাস্টারের আরেকটি শৃঙ্গজয়ে প্রথম অভিনন্দনটা মাশরাফিই জানালেন।
তিন.
মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে টস জিতে ফিল্ডিং নিলেন মুশফিকুর রহীম। শুরুর দিকে গম্ভীর আউট হলেও, তারপর যেন আর উইকেটের নাম-গন্ধ নেই। বিরাট কোহলির ব্যাটে তখন মধুচন্দ্রিমা, তাঁকে থামায় সাধ্য কার? দেরীতে হলেও, তবু তাঁকে থামানো গেল। অপর প্রান্তের মানুষটা নির্বিকার। জীবনে যা কখনোই করেননি, অনেকটা দৃষ্টিকটুভাবে তা-ই করছেন। দলের বদলে স্বার্থপরের মতো খেলছেন নিজের জন্য, একটা সেঞ্চুরীর জন্য, একটা অতৃপ্তি ঘুচানোর জন্য।
৯৮ থেকে তিনটি ডটের পর ৯৯, তারপর আরো দুটি ডট, এরপর সাকিবের বলটাকে স্কয়ার লেগে ঠেলে দিয়ে পৌঁছে গেলেন এমন এক উচ্চতায়, যেখানে এর আগে কেউ পৌঁছতে পারেননি। অন্যরাও সেখানে পৌঁছার দুঃসাহসই কল্পনা করতে পারেন না এখনো।
ছুটে গেলেন মাশরাফি, গেলেন অন্যরাও, অভিবাদন জানালেন তাঁকে। সতীর্থরাও সীমানা দড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে জানালেন অভিবাদন। গ্যালারী তাঁকে একটানা করতালি আর হর্ষধ্বনিতে অভিনন্দিত করল।
হ্যালমেট খুলে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাবার কাছ থেকেই হয়তো প্রথম অভিনন্দনটা গ্রহন করলেন তিনি। শচীন টেন্ডুলকার রহস্য ঘুচিয়ে অবশেষে মালিক হলেন একশটা একশ’র!
চার.
সেঞ্চুরীর পর মাস্টার চেয়েছিলেন, তাঁর কারণে দলের যে ক্ষতি হয়েছে তা কিছুটা লাঘব করার। কিন্তু পারেননি। শেষদিকে রায়না ঝড় উঠল। ধোনীও চেষ্টা করলেন। সব মিলিয়ে ভারত পৌঁছে গেল, ২৮৯ রানের বিশাল উচ্চতায়।
বাংলাদেশ কি পারবে, অত উচ্চতায় উঠতে? একবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে উঠা গেছে বটে, তা বলে ভারতের বিপক্ষে? সম্ভব? আশা-নিরাশার দোলাচল যেন আমাদের সবার চোখেমুখে।
তখন কি আর জানতাম যে, শচীন-বন্দনায় মত্ত বিশ্বক্রিকেটের প্রচারের আলোটা নিজেদের দিকে টেনে নিতে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছেন, আমাদের ক্রিকেটাররা! এক-একটা তরুণ প্রাণ তখন কিছু করে দেখানোর মরিয়া চেষ্টায় লিপ্ত। গত কিছুদিন ধরে দল নিয়ে যাচ্ছেতাই কর্মকান্ডে দলের ঐক্য ও সংহতিও বুঝি বেড়ে গেছে বহুগুণ।
কাঁধে কাঁধ রেখে, এমন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাহার ডিঙানোর ইতিহাস যে, খুব কমই দেখেছে এদেশের ক্রিকেট।
দিনটাও ছিল ১৬ই মার্চ। পাঁচ বছর পূর্বে ঠিক এদিনেই তো, ক্রিকেটাররা হারিয়েছিলেন তাদের প্রিয় সতীর্থ, কারো বন্ধু, কারো বড় ভাই, মরহুম মানজারুল ইসলাম রানাকে। দিনটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যেমন বিশেষ একটা দিন, ক্রিকেটারদের জন্যেও বিশেষ অনুপ্রেরণার।
এমন একটা দিনে কিছুতেই হার মানা যায় না। কিছুতেই না। কঠিন এক দৃঢ় সংকল্প করেই হয়তো ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন আমাদের ব্যাটসম্যানরা।
পাঁচ.
শুরুতেই নাজিমুদ্দীনকে হারানোর ধাক্কা ভালোই সামলে নিলেন তামিম-জহুরুল। একপাশে তামিম নিজেকে প্রমাণে ব্যস্ত, অন্যপাশে জহুরুল সাবলীল গতিতে স্কোর বোর্ড সচল রাখছেন। দু’জনের জুটিতে বাংলাদেশের ইনিংস ফিরে পেলো কক্ষপথ। অর্ধশতকের পর জহুরুল আউট হলে, ইনফর্ম নাসিরকে পাঠানো হলো চারে। টানা দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরী করা তামিম ৭০ রানে আউট হয়ে গেলে, উইকেটে এলেন সাকিব আল হাসান।
বাংলাদেশের তখনো দরকার ১৩০-১৩৫ রান, ওভার বাকী মাত্র ১৬টি!
ছয়.
ম্যাচের গতিপথ তিনশ ষাট ডিগ্রী ঘুরে গেল এই এক জুটিতেই। সাকিব তখন বিশ্বজোড়া টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট আর কাউন্টি খেলে ভালোই পোক্ত হয়ে গেছেন। তিনি জানেন, এই সময় কিভাবে রানের গতি বাড়াতে হয়। সেই মন্ত্র তিনি আওড়ে দিলেন নাসিরকেও। দু’জনে মিলে আট ওভারে যোগ করলেন ৬৮ রান।
তৃতীয় আম্পায়ারের বিতর্কিত এক রায়ে সাকিব কাঁটা পড়লেন ৪৯-এ। দারুণ ছন্দে থাকা সাকিবকে হারিয়ে বাংলাদেশও যেন খেলো একটা ছোট ধাক্কা। তবে তা সময়ের সাথে মিলিয়ে গেল অচিরেই।
জয়টাকে দেখা গেলেও, পাড়ি দেয়ার বাকী ছিল আরো অনেকটা পথ। ম্যাচ এগোচ্ছিল ক্রিকেটের চিরন্তন অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য্যের দিকে। রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় পেন্ডুলামের মতো দুলছিল ম্যাচ।
টিভি সেটের সামনে বসে লোমখাড়া করা শিহরণ অনুভব করছিলাম আমরা।
সাত.
ছোট হাতের মুশফিক দেখিয়ে দিলেন তাঁর বাহুতে কত জোর! উইকেটে সে কী তাঁর প্রলয় নাচন। এই এদিকে যাচ্ছেন, সেই ওদিকে যাচ্ছেন। ডাউন দ্য উইকেটে এসে এক্সট্রা কাভার দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন তো, বলটাকে নিমেষে স্লগ সুইপে স্কয়ার লেগ বাউন্ডারীতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
ইরফান পাঠানের গুড লেংথের মিডল স্ট্যাম্পের ডেলিভারীটিকে কি সাবলীলভাবেই না আছড়ে ফেললেন সীমানা দড়ির ওপারে! মুশফিক কি মুশফিকই ছিলেন? নাকি দৈব কিছু ভর করেছিল তার উপর? রানা কি কোনভাবে...? প্রভীন কুমার, ইরফান পাঠানদের কি অমন পাড়ার বোলার পর্যায়ে চাইলেই নামিয়ে আনা যায়?
শেষদিকে নাসির আউট হলেও, জয় নিয়ে শংকা কেটে গেছে ততক্ষণে। মাহমুদুল্লাহর কাভার ড্রাইভে বল সীমানা দড়ির দিকে ছুটতেই হয়ে গেল ইতিহাস। মুশফিক ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাহমুদুল্লাহর কোলে, ক্রিকেটাররা দৌড়ে দৌড়ে আসতে লাগলেন মধ্য মাঠের দিকে। পুরো গ্যালারী জুড়ে এক উন্মাতাল উন্মাদনার ঢেউ।
আর টিভি সেটের সামনে বসে কাঁপতে থাকা আমাদের চোখে যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছে জলের ফোয়ার। অসীম আনন্দের যে এত অবারিত জল হয়, আমাদের তো আগে জানা ছিল না!
আহা, কি আনন্দ!
আট.
বাংলাদেশ অনেক ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে। অভুলনীয় ম্যাচের তালিকা করতে গেলে হয়তো ‘কাকে ছেড়ে কাকে রাখি’ অবস্থা হবে। কিন্তু এই জয়টাকে একটা দিক থেকে অনন্য মানতেই হয়। ২৯০ রানের পাহাড় টপকানো তো আর মুখের কথা নয়। চাই সাহস, বিশ্বাস আর পরিকল্পনা। এই ম্যাচে বাংলাদেশের সবকটিই ছিল। তিন ফিফটি আর দুই প্রায় ফিফটিতে সমন্বিত পরিকল্পনা কাকে বলে, যেন হাতে-কলমে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ইনিংস বিনির্মাণ, যেন একটা একটা ইট গাঁথা হয়েছে, অপরিসীম ধৈর্য্য আর বিশ্বাসে। পরের শ্রমিকটিও যেন জানেন তাঁকে ঠিক কোন জায়গায় কত ইঞ্চির ইটটি রাখতে হবে।
আধুনিক ক্রিকেটের অবিসংবাদিত গ্রেটের শততম সেঞ্চুরী, সেই সেঞ্চুরীকেই ম্লান করে দিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে জয়, শক্তিশালী বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে সক্ষমতার প্রমাণ দেয়া... সব মিলিয়ে এই ম্যাচটি অন্যরকম, অনন্য, অসাধারণ।
সত্যিকার অর্থে, এই ম্যাচটা দিয়েই যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সামর্থ্যের সাড়ম্বর ঘোষণা বিশ্বক্রিকেটের দরবার পর্যন্ত পৌঁছানো গিয়েছিল। রাখা হয়েছিল বড় দল হয়ে উঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও।
এই ম্যাচটা তাই ভুলি কি করে?
- 0 মন্তব্য