• ক্রিকেট

অবিশ্বাস্য সুন্দর বাংলাদেশ!

পোস্টটি ৯৬৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

   চেজ করতে নেমে বাংলাদেশের মাত্র ৩৩ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর যারা টিভি অফ করেছিলেন এই ভেবে আজ আর হবে না,তারা এটা ভুলে গিয়েছিলেন ক্রিকেটকে বলা হয় দ্যা গ্রেট গেম অব আনসার্টেনিটি!

বাংলাদেশ শুরুতে অমন ভগ্নস্তুপ থেকে যেভাবে কামব্যাক করল তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই।এইরকম কামব্যাকের ইতিহাসও ক্রিকেটে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য।

অবিশ্বাস্য,মহাকাব্যিক,অতুলনীয়,অভূতপূর্ব কোনো বিশেষণ দিয়েই এই জয়কে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না।বাইশ গজের উইকেটে ব্যাট হাতে চিরজীবী এক কীর্তি গড়েছেন আমাদের ক্রিকেটের সুপারম্যান সাকিব আল হাসান এবং দ্যা ডার্ক নাইট মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।শিল্পীর তুলির আচঁড়ে পরতের পর পরত রং যেমন একটি কালজয়ী চিত্রকর্মের সৃষ্টি করে তেমনি ওভারের পর ওভার ইস্পাতদৃঢ় স্নায়ু নিয়ে ব্যাট করে বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে নিয়ে পৌছে দিয়েছেন এই দুইজন।সময়ের প্রয়োজনে তাদের ব্যাট হয়েছিল চীনের প্রাচীর আবার কখনো চমকেছে খাপখোলা তলোয়ারের মতো!সাকিব এবং রিয়াদ জিইয়ে রেখেছেন টাইগারদের সেমি ফাইনালের আশা।

নিউজিল্যান্ড এখন বাংলাদেশের প্রিয় প্রতিপক্ষই।গত ১৩ ম্যাচে ৮টিতেই জয়ী টাইগাররা।সুতরাং আশা তো  ছিলই। ম্যাচ শুরুর আগে ভাবছিলাম এই ম্যাচ না জিতলে হয়ত চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মূলপর্বে কোন ম্যাচ না জেতার অতৃপ্তি নিয়েই অবসরে যেতে হবে মাশরাফিকে।এই ম্যাচ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ মাথার ওপর চাপ নিয়ে।সেমি ফাইনাল স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে জয়ের কোনো বিকল্পই ছিল না এ ম্যাচে।বিরুপ কন্ডিশন,হতশ্রী বোলিং নিয়ে নিউজিল্যান্ডের সাথে জয়টা একটু কষ্টকল্পনাই ছিল।কিন্ত দিনশেষে জয়ের হাসি টাইগারদের মুখে,মাশরাফির মুখে!

দুই অধিনায়কই টসে জিতে ব্যাট করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু টসে হারায় ফিল্ডিং এ টাইগাররা।কিউইদের ওপেনিং জুটি ৪৬ রান তুলে যখন জমে ক্ষীর হতে যাচ্ছে তখন আঘাত হানলেন তাসকিন,রনকিকে পাঠালেন সাজঘরে।এরপর রুবেলের বলে ফিরলেন ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকা গাপটিলও।নিউজিল্যান্ডকে পথ দেখাল টেলর -উইলিয়ামসনের জুটি।৩০তম ওভারে দুর্দান্ত জিমন্যাস্টিকসের খেল দেখিয়ে উইলিয়ামসনকে রান আউট করলেন সাকিব আল হাসান।নিউজিল্যান্ড যখন হুমকি দিচ্ছে বড় রান তুলে বাংলাদেশকে চাপার দেবার তখন ৪৩তম ওভার করতে এলেন মোসাদ্দেক।ডেথ ওভারে এই নবাগত তরুণ স্পিন দিয়ে কি করতে পারবেন তা নিয়ে সংশয়ই ছিল।কিন্তু এই সংশয় কাটাতে তিনি একদমই সময় নিলেন না।পরপর তিন ওভারে তিন উইকেট তুলে কিউইদের বড় স্কোরের সম্ভাবনা ওখানেই মাটিচাপা দিয়ে দিলেন।মোসাদ্দেকে যোগ্য দিয়ে গেছেন রুবেল এবং মুস্তাফিজ।একের পর এক পিন পয়েন্ট ইয়র্কারে বেধে রেখেছেন কিউই ব্যাটসম্যানদের।লাস্ট দশ ওভারে অসাধারণ বোলিং করেছে বাংলাদেশ,মাত্র ৬২ রান নিতে পেরেছে নিউজিল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামনে টার্গেট দাঁড়ালো ২৬৬।

২৬৬ এখনকার ওয়ানডে যুগে এমন কিছু বড় স্কোর নয়।কিন্তু শুরুতেই টিম সাউদির গতি এর সুইং এর তোপে তাসের ঘরের মত ভেংগে পড়ল টাইগারদের টপ অর্ডার।চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল  নিউজিল্যান্ড,জেতাটা অর্জন করে নাও!টাইগারদের তখন ম্যাচ জেতার চিন্তা দূর অস্ত, মান বাচানোই তখন দায়!

সাকিব যখন ব্যাটিং এ নামছেন তখন দলের স্কোরকার্ড করুণ।সাড়ে চার ওভারের মাঝেই তিন টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান ফিরে গেছেন।কিছুক্ষনের মধ্যে মুশফিকও ফিরে গেলেন।স্কোরবোর্ড দাঁড়াল ৩৩ রানে ৪ উইকেট।ক্রিজে এলেন মাহমুদুল্লাহ।তখন সাকিব আর মাহমুদুল্লাহ কি ভাবছিলেন কে জানে কিন্তু বাংলাদেশি সমর্থকরা আশা হারিয়েই ফেলেছিলেন।দুই ব্যাটসম্যানের উপর অকল্পনীয় চাপ,আর একটা উইকেট পড়লেই সব শেষ!কিন্তু ক্রিকেট হচ্ছে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।খেলা যত গড়াতে লাগল গল্পটা ততই পাল্টাতে লাগল।

সাকিব আল হাসানের ব্যাড প্যাচ চলছিল।একটা বড় ইনিংস দরকার ছিল খুব।প্রথম দিকে টাইমিং করতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু অপর প্রান্তে মাহমুদুল্লাহ স্ট্রাইক রোটেট করে চাপটা চেপে বসতে দিচ্ছিলেন না।

তখনো আশা করার তেমন কিছুই ছিল না।তবুও খেলাটা দেখছিলাম।রান আসছিল আস্তে আস্তে।দেখতে দেখতে উইকেটে জমে গেলেন সাকিব আর রিয়াদ।উইকেটে তাদের মনে কি চলছিল জানি না তবে আমরা যারা খেলা দেখছিলাম তাদের বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছিল।এই জুটি কি শেষপর্যন্ত থাকবে?নাকি আবার পুড়তে হবে আশাভঙ্গের যন্ত্রণায়?

দুইজনই এমনভাবে ব্যাট করছিলেন যেন চাপ বলতেই কিছু নেই।সিংগেল নিয়ে ধীরেসুস্থে খেলছিলেন,স্কোরবোর্ড সচল রাখছিলেন। টার্গেট ধীরে ধীরে কাছে আসছিল আর আমাদের স্নায়ুচাপ বাড়ছিল।মন একবার বলে এতরান হবার নয় আবার ভাবি সব কিছুইতেই ত প্রথম বলে একটা কথা আছে!হয়ে যেতে কতক্ষণ!

এই দোলাচলের মাঝেই ফিফটি তুলে নিলেন প্রথমে রিয়াদ তারপর সাকিব।দুজনের রান কাছাকাছিই থাকছিল।একবার রিয়াদ সাকিবকে ছাড়িয়ে যান তো পরের ওভাবেই সাকিব রিয়াদকে ক্রস করেন। ৩২তম ওভার করতে কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন নিজেই এলেন।লং অনে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়েই একটা ছক্কা মারলেন রিয়াদ।বাংলাদেশ দেড়শ পার হলো। ৩৫তম ওভার শেষে বাংলাদেশের রান দাঁড়াল ১৬৯।বুক তখন কাঁপছে। জয় ১০০ রানেরও কম দূরত্বে!এই অবস্থা থেকে একসময় আমরা কত ম্যাচ হেরেছি! দেখতাম অন্যদলের ব্যাটসম্যানরা অভিজ্ঞতা দিয়েই এ পরিস্থিতে ম্যাচ বের করে নেন!বাংলাদেশের অন্যতম অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান ক্রিজে,এঁরা কি পারবেন?

রিয়াদ আর সাকিব নিজেদের সমস্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই খেলছিলেন।কিউই বোলাররা চেষ্টা কম করেন নি কিন্তু এই জুটির দুর্গে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারেন নি। ৪১তম ওভারে টাইগারদের রান ২০০ পার হলো।সাকিব এবং রিয়াদ দুজনই তখন আশি পার করেছেন।পরের ওভারেই যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটিও হয়ে গেল।টেনশন বাড়ছিল,বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে ঢাক বাজছিল,তবে আমরা এই অসম্ভব ম্যাচটা জিততে চলেছি?

৪৫তম ওভার শেষে ২৪০ হলো।আর মাত্র ২৬ রান বাকি।সাকিবের রান ৯৮ এবং আশ্চর্যজনকভাবে রিয়াদও ৯৮ রানে দাঁড়িয়ে!পঞ্চম বলে সাকিব স্ট্রাইকে।বোলার মিলনে বুকসমান উচ্চতায় বাউন্সার দিলেন।সাকিব কি অবলীলায় নিপুণ দক্ষতায় ফাইন লেগের উপর দিয়ে বল গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন!নার্ভাস নাইনটিজের কোন লক্ষণই নেই! ৪৭তম ওভারের শুরুতে টাইগারদের দরকার ছিল ২৪ বলে ১৭ রান।রিয়াদ তখনো ৯৮ রানে দাঁড়িয়ে।ট্রেন্ট বোল্ট এলেন।প্রথম দুই বলেই দুটো চার সাকিবের।তৃতীয় বলটা মারতে গিয়ে লাইন মিস করলেন কিন্তু বল স্টাম্প মিস করল না।সাকিব যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছেন তখন তাঁর নামে ১১৪টি রান লেখা হয়ে গেছে,রিয়াদের সাথে গড়েছেন যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে রেকর্ড ২২৪ রানের জুটি।একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নের মতই বড় মঞ্চে দলের নিদারুণ সংকটে ফর্মে ফিরলেন সাকিব আল হাসান!

এই ওভারের শেষ বলেই আরেকটি বাউন্ডারিতে সেঞ্চুরী হয়ে গেল  মাহমুদুল্লাহ রিয়াদেরও।আরো একবার দলের প্রয়োজনে বুক চিতিয়ে মান বাঁচালেন সাইলেন্ট গার্ডিয়ান রিয়াদ। জয় তখন হাতছোঁয়া দুরত্বে।আর মাত্র দুই রান দরকার!উত্তেজনায় শ্বাস আটকে যাচ্ছিলো!অবশেষে এই ম্যাচটা আমরা জিততে যাচ্ছি!তরুণ মোসাদ্দেকের ব্যাট থেকেই এল জয়ের বাউন্ডারি।নতুনের হাতে জয় যেন বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি!আর আমি তখন বাকরুদ্ধ।আনন্দে,উত্তেজনায় আমার মুখের ভাষাই আটকে গিয়েছে!

এই ম্যাচ ছিল কিছু পাওয়ার ম্যাচ।এই ম্যাচ ছিল সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখার ম্যাচ।আমরা পেয়েছি অনেক।সাইলেন্ট গার্ডিয়ান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের আরো একটি ম্যাচ বাচাঁনো ইনিংস,সুপারম্যান সাকিবের ফর্মে ফেরার ইনিংস এবং কিভাবে বড় দলের মত ম্যাচ জেতাতে হয় তার একটি পারফেক্ট   ডেমনেস্ট্রেট!সত্যিকারের বড়দল হবার পথে এই ম্যাচটা একটা ঘোষণা।হে ক্রিকেট বিশ্ব,বাঘের গর্জন কি শুনতে পাচ্ছ!  চলো বাংলাদেশ!