• ক্রিকেট

যাত্রীরা হুঁশিয়ার!

পোস্টটি ১৩৩১৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি,বিশ্বের সেরা আটটি দলের টুর্নামেন্ট।একদিক দিয়ে দেখলে বিশ্বকাপের চেয়েও এই টুর্নামেন্টের মর্যাদা বেশি।টানা এগার বছর কোয়ালিফাই করতে না পারার পর নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করেই বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে স্থান করে নিয়েছে।তারওপর বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল অস্ট্রেলিয়া,ইংল্যান্ড,নিউজিল্যান্ডের মতো জায়ান্ট টিম,এই গ্রুপকে বলা হচ্ছিল গ্রুপ অব ডেথ।অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে টপকে যোগ্যতর দল হিসেবেই সেমিফাইনালে উঠেছিল টাইগাররা।হয়ত ভারতের কাছে হেরে সেমি থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে কিন্তু সেরা আট দলের মাঝে শেষ চারে জায়গা করে নেয়ার অর্জন তাতে মুছে যাচ্ছে না।বুক ফুলিয়ে বলতে পারি সেরা চার দলের একটি আমাদের বাংলাদেশ!যাত্রা চলছে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত বড়দল হবার দিকে।এই যাত্রাকে শেষ স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য এবারের টুর্নামেন্টে যা কমতি ছিল পরের বার তা পূরণ করে নেয়াটা জরুরি।

অর্জন

এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের পাওয়ার পাল্লাটা যথেষ্ট ভারি।প্রথম ম্যাচেই হট ফেবারিট ইংল্যান্ডের সাথে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন তামিম,রানে ফিরেছিলেন মুশফিক।পরের ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের গতি এবং সাপের মতো সুইং এর কাছে একের পর এক বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান অসহায় আত্নসমর্পণ করছিলেন তখন একমাত্র বাঁধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তামিমই। ৯৫ রানে কাটা পড়ে অল্পের জন্য টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি মিস করেন তিনি।এরপর মাশরাফির বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাপ্টেন্সিতে এবং বৃষ্টির সহায়তায় এক পয়েন্ট ঘরে তোলে বাংলাদেশ।তৃতীয় ম্যাচ তো এক মহাকাব্য।নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফর্মে ফিরে আসেন টাইগার বোলাররা,বিশেষ করে ডেথ ওভারের বোলিং ছিল অসাধারণ।বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতে মাত্র তেত্রিশ রানে চার উইকেট পড়ে যাবার পর দুইশ চব্বিশ রানের মহাকাব্যিক এক জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌছে দেন সাকিব এবং মাহমুদুল্লাহ।এরপর সেমিফাইনালেও আগের ফর্ম ধরে রেখে শুরুর ব্যাটিং বিপর্যয় সামাল দেন তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিম।সেমিফাইনালে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হবার পর ২৯০ রান করে টুর্নামেন্টেরই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন টাইগার ওপেনার তামিমই।সব মিলিয়ে অসাধারন অনেক প্রাপ্তি এবং ভবিষ্যতের আত্নবিশ্বাসের জ্বালানি পেয়েছে বাংলাদেশ।

কমতি ছিল যেখানে

পুরো টুর্ণামেন্টেই ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বর পজিশন নিয়ে ভুগেছে টাইগাররা।প্রথম ম্যাচ বাদে সব ম্যাচে তিনে খেলেছেন সাব্বির রহমান।তিন নম্বর পজিশন হচ্ছে ব্যাটিং অর্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন।দলের রানের চাকা সচল রেখে একপ্রান্ত ধরে রাখাই হচ্ছে তিন নম্বর ব্যাটসম্যানের কাজ।শুরুতে উইকেট পড়লে দলকে পথ দেখানোই তাঁর কর্তব্য।সাধারণত দলের সেরা ব্যাটসম্যানই এই পজিশনে খেলেন।কিন্তু সাব্বিরের ব্যাটিং এপ্রোচ দেখে কোনোবারই মনে হয়নি তিনি পুরো ম্যাচ শেষ করে আসার চিন্তা করছেন।সিংগেল বের না করে বারবার বাউন্ডারিতে রান বাড়াবার চেষ্টা করেছেন প্রতিটি ম্যাচেই।ফলশ্রুতিতে কয়েকটা ডট বলের পর মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন।এই চিত্র সেমিফাইনালেও ছিল।সেমিতে সাব্বিরের ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে ড্রেসিংরুম থেকে ঠিক করেই নেমেছিলেন যে আজ বলের বাছ-বিচার করবেন না,সব বল গ্যালারিতে পাঠাবেন।সাব্বিরের কাছে চেয়েছিলাম কেন উইলিয়ামসন বা জো রুট বা বিরাট কোহলির মতো ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ শেষ করে দেয়া সেনসিবল ব্যাটিং কিন্তু পেয়েছি শহীদ আফ্রিদির মতো প্রতিপক্ষ বোলারকে উইকেট গিফট দেয়ার অভ্যাস।

প্রথম পাওয়ার প্লেতে সিংগেল না নিয়ে রান করার জন্য বাউন্ডারি নির্ভরতা আমাদের ভুগিয়েছে।কুইক সিংগেল নেয়ার জন্য বা সিংগেলকে ডাবলে পরিণত করার জন্য রানিং বিটুইন দ্যা উইকেট আরো ইম্প্রুভ করতে হবে।তামিম প্রতিটা ম্যাচেই শুরুতে প্রচুর ডট বল দিয়েছেন,এতে দল শুরুতেই প্রেশারে পড়ে গিয়েছে।পরে তামিম চার-ছক্কা দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে এই প্রেশারের জন্য অপরপ্রান্তে উইকেট কয়েকটা পড়েই গেছে।

সৌম্য রান পাননি।তবে একজন হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিশনের ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে এমনই হবে।যেদিন রান পাবেন সেদিন রান করাটাকে বিশ্বের সবচেয়ে সহজ কাজ মনে হবে,পিটিয়ে বলের সুতা খুলে দেবেন।আর যখন ছন্দে থাকবেন না তখন বিশ্রি ভাবে আউট হবেন।অনেকে বলবেন সৌম্যর ফুটওয়ার্ক নেই।তাদের বলতে চাই বীরেন্দর শেবাগেরও পা নড়ত না।হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশন দিয়েই তিনি লিজেন্ড হয়েছেন।সৌম্যও সেই প্রজাতির ব্যাটসম্যান।একটু ধৈর্য্য ধরুন।

ব্যাটিং এর আরেকটা জায়গায় আমরা প্রচুর ভুগেছি।সেটা হলো স্লগ ওভারে দ্রুত রান তোলার ক্ষেত্রে।চল্লিশ ওভারের আগে দুইশ করার পরও শেষ দশ ওভারে ঝড় তুলতে পারেননি টাইগার ব্যাটসম্যানরা।এই ঝড় তোলার কাজটা যিনি সবচেয়ে ভালো পারতেন সেই সাব্বির তো খেলেছেন তিনে,শেষে একটা টর্নেডো ইনিংস খেলার মত আর তো কেউ ছিলেনই না!

বোলিং এর ক্ষেত্রে মাশরাফি ছাড়া কেউই নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।পাওয়ার প্লেতে মাশরাফি ছিলেন অসাধারণ।এখনো যে বাংলাদেশের পেস এটাক মাশরাফি ছাড়া অসহায় তা আমরা দেখতেই পেয়েছি। প্রথম পাওয়ার প্লেতে লাইন-লেন্থ ছিল বাকি সবারই এলোমেলো।বিশেষ করে মুস্তাফিজ তো নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন।তাসকিন নিউজিল্যান্ডের সাথে কিছুটা ঝলক দেখিয়েছেন বটে কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।রুবেল বেশ ভালো বল করেছেন।প্রথম পাওয়ার প্লেতে মুস্তাফিজের বদলে রুবেল যদি মাশরাফির সাথে বোলিং ওপেন করতেন তাহলে হয়ত আরো বেটার কিছু হতে পারত,বিশেষ করে মুস্তাফিজ যখন স্বরুপে নেই।সম্ভবত বল পুরোনো হবার পর মুস্তাফিজ বেশি কার্যকরী হতেন।তবে ডেথ ওভারে টাইগার বোলাররা ছিলেন অসাধারণ।

তাসকিনের ব্যাপারে কিছু কথা আলাদা করে বলতেই হচ্ছে।সোশাল নেটওয়ার্কে কেউ কেউ তাসকিনকে স্পিডস্টার উপাধি দিয়ে শেন বন্ড,ব্রেট লি,শোয়েব আখতারের সাথে তুলনা করে লিখেছেন যে স্পিডস্টাররা কখনো গতির সাথে আপোষ করেন না।স্পিডস্টারদের কাজই হচ্ছে গতির তোড়ে ব্যাটসম্যানকে কাঁপিয়ে দিয়ে উইকেট তোলা,রান আটকানো তাদের কাজ নয়।উপরে যেসব বোলারদের সাথে বিজ্ঞ ব্যাক্তিগণ তাসকিনের তুলনা করেছেন তাদের বলের গড় গতি ছিল প্রতি ঘন্টায় ১৪৬/১৪৭ এর আশেপাশে।এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে শুধু নিউজিল্যান্ডের সাথে প্রথম স্পেলের প্রথম ২/৩ ওভারের কয়েকটা বলে তাসকিনের গতি ১৪২ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে দেখেছি,বাকি সবসময় গতি ১৩৮ এর আশেপাশেই ছিল।স্মরণকালের মধ্যে ২০১৬ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের সাথে ম্যাচে তাসকিন কয়েকটা বল ১৪৮/১৪৭ কিলোমিটারে করেছিলেন।এর আগেপরে কখনোই তাসকিনের বলে এত গতি দেখিনি।সেমিতেও দেখা গেল তাসকিন ডিপ মিডউইকেট বা ডিপ স্কয়ার লেগে কোনো ফিল্ডার না থাকা সত্ত্বেও ওভার দ্যা উইকেট থেকে একের পর এক শর্ট বল করছেন।এটা তাঁর মাথা না খাটানোরই প্রমাণ।তাসকিন বয়সে তরুণ।আরো অনেক বছর তিনি খেলবেন।প্লিজ এখনই তাসকিনকে প্রতিষ্ঠিত লিজেন্ডদের সাথে তুলনা দেবেন না,তাঁকে শেখার সময় দিন।নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম একজন স্ট্রাইক বোলার হয়ে উঠবেন।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে বডি ল্যাংগুয়েজ।প্রতিপক্ষ যখন ভালো অবস্থানে চলে যায় তখনই কেন জানি বাংলাদেশি প্লেয়ারদের মধ্যে হতাশ একটা ভাব চলে আসে।তখন হাফ-চান্সগুলোও কাজে লাগানো সম্ভব হয় না।সেমিতেই ভারত এক উইকেটে একশ বাহাত্তর তুলে ফেলার পর ফিল্ডারদের মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব চলে এসেছিল।এটা মোটেও প্রফেশনালিজম না।প্রফেশনালিজম হলো হারার আগেই না হারা,কঠিন পরিস্থিতিতেও সুযোগ তৈরী করা।

প্রত্যাশা

তিনে একজন নিঁখুত টেকনিকের ব্যাটসম্যান এবং লোয়ার মিডল অর্ডারে একজন হার্ডহিটার জরুরী প্রয়োজন।এছাড়া বড় রান চেজ বা সম্ভাবনা শুরুর পর রান পাহাড়ে ওঠা সম্ভব নয়।ভিন্ন কন্ডিশন এবং ভিন্ন ভিন্ন পিচের সাথে বোলারদের দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়াটা হলো দ্বিতীয় প্রত্যাশা।কিছুদিন আগে মিচেল স্টার্ক এক সাক্ষাতকারে বলেছেন “ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে বোলিং করাটা সহজ ছিল,কিন্তু কিছুদিন পর যখন ব্যাটসম্যানরা এনালাইসিস পেয়ে যায় তখন কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।ভিন্ন কিছু করতে না পারলে এখন টিকে থাকাটা সম্ভব নয়”।সুতরাং টাইগার বোলারদের একথা মাথায় রাখা উচিত।

স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত বড় দল হতে একটা আইসিসি টুর্ণামেন্টের শিরোপা জেতা খুব দরকার।বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফ উপরের দিকেই। ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল,এবার সেমি ফাইনাল কে জানে পরের বার হয়ত শেষ ধাপটা পেরিয়েই যাব!এই যাত্রাপথের যাত্রী প্লেয়ারদের নেতা মাশরাফি বিন মুর্তজা।মাশরাফির জন্য হলেও একটা শিরোপা চাই।কোন বড় ট্রফি ছাড়া অবসরে যাওয়া যে তাঁকে মানায় না!অতএব যাত্রীরা হুশিয়ার!মাশরাফিকে এই সম্মান দেয়ার দায়িত্ব আপনাদের কাঁধেই।