• ক্রিকেট

আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭ ও বাংলাদেশের ক্রিকেট

পোস্টটি ১৪৮৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

খেলার মাঠে সেরা দলটিই আজকে জিতেছে। ভারতকে অভিনন্দন। বাংলাদেশ যথেষ্ট খারাপ খেলেছে সত্য তবে এখানেই আমাদের ক্রিকেটের সমাপ্তি নয়। আমরা কেবল বড় মঞ্চে ভাল খেলা শিখছি। আমাদের আরও সময় লাগবে। আজকের হতাশাজনক পারফর্মেন্সের পরও এই ম্যাচ থেকে আমাদের প্রাপ্ত অসীম। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আজকের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী টিম হয়ে উঠতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমাদের ব্যাটিং ইউনিট যথেষ্ট ভাল, ধারাবাহিকও বটে তবে এখানে আরও উন্নতি করতে হবে। বর্তমানে যে ব্রান্ডের ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, যে উইকেটে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে এই অবস্থায় ক্রিকেটের সুপ্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলো সাথে পাল্লা দিতে হলে অবশ্যই ব্যাটিংয়ে অন্যমাত্রা যোগ করা জরুরি। মনে রাখা ভাল আমাদের দলে কোন বিরাট, ডি ভিলিয়ার্স কিংবা স্মিথ নেই কিন্তু এর মানে এই নয় যে তাদের মানের ব্যাটসম্যান আমরা কখনো পাব না ! যদি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারি, ঘরোয়া লিগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারি, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে পারি তবে অবশ্যই বাংলাদেশও এই মানের খেলোয়াড় পাবে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ট্যালেন্টের অভাব নেই। শুধু প্রয়োজন তাদেরকে উন্নতির সুযোগ করে দেওয়া।

বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং অর্ডারে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখন আমাদের ব্যাটসম্যানদের গড় ৩২-৩৫ এর মধ্যে। মাত্র দশ বছর আগেও যেটি ২৫ এর আশেপাশে ঘোরা ফেরা করত। গত শতাব্দির শেষ ও এই শতাব্দির প্রথম দশকেও ওডিআই ক্রিকেটে ৪০ গড়কে খুব ভাল বলে মনে করা হত। শচীন-লারা-পন্টিং-ভিভ প্রায় ৪৫ গড়ে রান করে তাদের সময়ে একদিনের ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠতম ব্যাটসম্যান ছিল। অথচ এখন এই স্ট্যান্ডার্ড ৫০ এর কোটা পার করে ফেলেছে। বিরাট-আমলা-ডি ভিলিয়ার্স-স্মিথ-উইলিয়ামসন-রুট ৫০ এর ঘরে গড় রেখে রান করে চলেছে। আধুনিক রান প্রসবা ক্রিকেটে এই পরিসংখ্যান তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে। বাস্তবতা হল বাংলাদেশ দলে এখনো এই মাপের কেউ নেই। যদি ২০১৫ বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়কে বিবেচনায় নেওয়া হয় তবে অবশ্য তামিম-মুশফিকুরকে আমরা পাব। একই সাথে এটাও মনে রাখা উচিত যে ভারত-অষ্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউ জিল্যান্ড-ইংল্যান্ড দলে প্রায় ৫০ গড়ে রান করা এক বা একাধিক ব্যাটসম্যানের পাশে আরও ২/৩ জন্য ব্যাটসম্যান আছেন যারা ৪০ এর কোটায় গড় রান সংগ্রহ করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই স্ট্যান্ডার্ড এখনো ৩০-৩২ এর কাছাকাছি রয়ে গিয়েছে। সক্ষমতার এই পার্থক্যই দিন শেষে ম্যাচে জয়-পরাজয়ের কারণকে ইংগিত করে।

ব্যাটিং অর্ডারের ৩ নম্বর প্লেসে এখনো নির্ভরযোগ্য কাউকে আমরা পাইনি। পরিসংখ্যান বলছে ৩ এ সাব্বিরই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কিন্তু প্রশ্ন যখন ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ডের তখন আমরা পিছিয়ে পড়ছি। ওপেনিংয়ে তামিমের পাশাপাশি স্ট্যাবল কাউকে এখনো আমরা পাইনি। লোয়ার মিডল অর্ডারে হার্ড হিটার কেউ নেই। এগুলো আমাদের বড় দুর্বলতা। পাশাপাশি খুব ভাল খেলতে খেলতে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার বাজে অভ্যাস তো আছে। এসব সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের আরও সময় প্রয়োজন। খেলোয়াড়দের ছোট থেকে আরও পরিচর্যা করা দরকার। একদিন বাংলাদেশ থেকেই কোন রাহুল দ্রাবিড়, রিকি পন্টিং, জাভেদ মিয়াদাঁদ, ভিভ রিচার্ডস কিংবা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি জন্ম নিবে।

বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে আমরা একজন সাকিব আল হাসানকে পেয়েছি। যে কোন ফরমেটের ক্রিকেটে সাকিব কত বড় খেলোয়াড় সেটা এখন অবশ্য আমরা বুঝতে পারছি না। সে দিন বুঝতে পারব যে দিন সাকিব আল হাসান অবসরে যাবে এবং তার একজন বিকল্প খুঁজে পেতে আমাদের বেশ কষ্ট পেতে হবে। আমরা অবশ্য চাই না সাকিবের বিকল্প খুঁজে পেতে আমাদের খুব একটা কষ্ট করতে হোক। একজন ভাল মানের অলরাউন্ডার সাকিবের অবসরোত্তর দিনে তার যায়গা নিক এটাই আমাদের পরম চাওয়া কিন্তু অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা যায় বাংলাদেশের পক্ষে আরেকজন সাকিব খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আরেকজন গ্যারি সোবার্স পায়নি, বোথামের পর ফ্লিনটফকে পেতে ইংল্যান্ডকে অনেকটা সময় পার করতে হয়েছে, ভারত এখনো কপিল দেবের বিকল্প খুঁজে ফেরে, পাকিস্তানে একজন ইমরানের জন্য আজো হাহাকার, অল-রাউন্ডারদের স্বর্গভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা কবে আরেকজন ক্যালিস খুঁজে পাবে সেটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সাকিব এই শ্রেণির ক্রিকেটারদের একজন যারা দলে থাকলে দলীয় শক্তি অনেকটা বেড়ে যায়। টপ ক্লাস একজন অলরাউন্ডার দলে থাকলে কন্ডিশন অনুযায়ী অধিনায়ক একজন অতিরিক্ত বোলার কিংবা ব্যাটসম্যান খেলাতে দ্বিধায় পড়েন না। 

পেস বোলিংয়ে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের দুর্বলতা চিরন্তন। এটা পাকিস্তান নয় যে হালি হালি দীর্ঘদেহী পেসার এখানে জন্ম নিবে। শারীরিক দুর্বলতা মেনে নিয়েই আমাদের সঠিক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে। ভারত এক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ করেছে আজ থেকে বছর দশেক আগে। তারা এখন আস্তে আস্তে সুফল পেতে শুরু করেছে করছে। বাংলাদেশ দলে খেলা তাসকিন-রুবেল-মুস্তাফিজ অবশ্যই দেশ সেরা বোলার। যোগ্যতা-দক্ষতায় এরা কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বসেরাও বটে। এদের উপর বিশ্বাস রাখা জরুরি। একই সাথে এদেরকে যেন দলে যায়গা ধরে রাখতে কম্পিটিশনের মধ্যে পড়তে হয় সেজন্য উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে বের করা জরুরি। পাঁচ বছর আগেও জাতীয় দলের হয়ে মাশরাফির সাথে জুটি গড়ে বল করার জন্য দ্বিতীয় একজন পেসার খুঁজে পেতে আমাদের হয়রান হতে হত। এখন সেই অবস্থা বদলেছে। অন্তত গোটা চারেক বোলার আছে যারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে। অবশ্যই এই সুস্থ প্রতিযোগিতা ভাল ফল বয়ে আনবে।

বাস্তবতা হল বাংলাদেশ দলের পঞ্চপান্ডব বলে পরিচিত তামিম-সাকিব-মুশফিকুর-রিয়াদ-মাশরাফির কেউই ২০২৩ বিশ্বকাপের পরে একদিনের ক্রিকেটে জাতীয় দলের হয়ে খেলবে না। মাশরাফি তো আরও আগেই বিদায় নিবে। বয়সজনীত কারণ কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্যই তারা অবসরে যেতে বাধ্য হবে। ভাবতে পারেন এরা চলে গেলে দলে কতটা শূন্যতা তৈরী হবে ? একটা প্রজন্মের অবসান হবে। এই অভাব পূরণ করা খুব কঠিন। ভারত-অষ্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট কাঠামো খুব ভাল থাকায় একটা প্রজন্মের অবসানের পরও তারা দ্রুত গুছিয়ে উঠতে পেরেছে কিন্তু পাকিস্তান-শ্রীলংকা খোঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ কোন দলে যাবে সেটি নির্ভর করবে আমাদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি কতটা সুদৃঢ় তার উপর।

ভারতের বিপক্ষে আজকের পরাজয়ের পর অনেকেই কোচিং দলের মুণ্ডুপাত করবেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এরাই আমাদের ক্রিকেট দলকে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। এখানে বড় কোন পরিবর্তন করতে বলার আবার অর্থ শূন্য থেকে করা, যেটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। আমাদের অবশ্যই ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কোন নিশ্চিয়তা নেই যে আসন্ন বিশ্বকাপে আমরা সেমি-ফাইনালে খেলব কিন্তু চলমান প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখা জরুরি। স্বপ্ন দেখা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দিবাস্বপ্ন দেখা আত্মঘাতী। আমাদের সঠিক পথে যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। ভুল-ত্রুটি শুধরে এগিয়ে যেতে হবে। সাফল্য কেবল ট্রফি দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। সব ভাল দলই ট্রফি জিতে না। ২০১৫ বিশ্বকাপে ভারত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা শক্তির বিচারে অষ্ট্রেলিয়ার চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু যেকোন কারণেই দুটি দলের একটিও ফাইনালে পোছাতে পারেনি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলংকা দলটির চেয়ে অবশ্যই অষ্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান ভাল দল ছিল। কিন্তু শেষের দুটি দলের কোনটিই ট্রফি জেতেনি। ১৯৯৬ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই বা হিসেবের বাইরে রাখি কীভাবে ? দক্ষিণ আফ্রিকা তো বিশ্বমঞ্চে সব সময়ই অন্যতম সেরা। যদিও ১৯৯৮ এর আইসিসি নক-আউট ট্রফি ছাড়া তাদের অর্জন শূন্য ! ১৯৯৯ বা ২০০৩ এর পাকিস্তান দল কি একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা দল ছিল না ? ট্রফি পেয়েছে ?

বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সুসময়ের কেবল সূচনা হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই দলটি আমাদের আরো এন্টারটেইন করবে। ভাল খেলা উপহার দিবে সমগ্র বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদেরকে। শুভকামনা নিরন্তর।7a461393d0a7734f2a6114f05615a355-5943663623ca6