• ফুটবল

রাউল গঞ্জালেসঃ মাদ্রিদের দেবদূত

পোস্টটি ৭০৫৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

৪০ বছর আগের এই দিন। মাদ্রিদের উপকণ্ঠের ছোট্ট এলাকা সান ক্রিস্টোবাল জন্মেছিল এক দেব শিশু। ঐ শিশু পরবর্তীতে পরিচিত হবেন এল অ্যাঞ্জেল দি মাদ্রিদ (মাদ্রিদের দেবদূত) নামে। এক স্থানীয় দল দিয়ে ফুটবল শুরু করলো ছেলেটা। ১৩ বছর বয়সে যোগ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ক্যাডেট দলে ডাক পেলো সে। প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ক্যাডেট দলের হয়ে জিতলো জাতীয় বয়সভিত্তিক শিরোপা। কিন্তু দুবছর পরেই অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগতে থাকা ক্লাবটি যুব একাডেমী বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলে প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল লুফে নিল সুযোগটা। প্রতিভাবান সেই দুরন্ত কিশোর সহ দলের সবাইকেই নিজেদের অংশ করে নিলো ক্লাবটি। তারপরের সময়টা কাটলো যেন চোখের পলকে! লা ফ্যাব্রিকা থেকে শুরু করে জুভেনাইল সি, বি, এ পার করে মাত্র দুবছরেই ছেলেটার জায়গা হল মূল দলে। বলছিলাম রাউল গঞ্জালেসের কথা। আজ সাবেক স্প্যানিশ ফরোয়ার্ডের ৪০তম জন্মদিন।

১৯৯৪-৯৫ মৌসুমটা শুরু করেছিলেন মাদ্রিদ সি দলের হয়ে। প্রথম ৭ ম্যাচেই ১৬ গোল করে পড়লেন মাদ্রিদ ম্যানেজার হোর্হে ভালদানোর নজরে। কিংবদন্তী বুত্রাগুয়েনো ফর্মে নেই। আরেক নিয়মিত ফরোয়ার্ড পড়েছেন ইঞ্জুরিতে। তাই মূল দলে ডাক পেলেন রাউল। লীগের নবম সপ্তাহে রিয়াল জারাগোজার সাথে ম্যাচের আগে ভালদানো রাউলকে জানালেন সেদিন অভিষেক হবে তাঁর, নার্ভাস যাতে না হন। কিন্তু শান্ত রাউলের তড়িৎ প্রত্যুত্তরে কথা হারালেন ভালদানো নিজেই। ''আপনি জিততে চাইলে আমাকে খেলান। যদি জিততে না চান, তাহলে অন্য কাউকে মাঠে নামান।''

 

১৭ বছর ১২৪ দিন। মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক হল রাউলের। অভিষেকটা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। বদলি হিসেবে মাঠে নামার পর গোলকিপারকে একা পেয়েও তিনটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলেন। রিয়াল ম্যাচটি হারলো ২-৩ ব্যবধানে। কোচিং স্টাফের সবাই ভেবেছিল, ১৭ বছরের ছেলেটা হয়ত ড্রেসিং রুমে এসে কেঁদেই ফেলবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদম চুপ মেরে রইলেন। সহকারী কোচ অ্যাঞ্জেল কাপ্পা এসে যখন সান্ত্বনা দিতে চাইলেন, মৃদুস্বরে শুধু বললেন, আরেকটা ম্যাচ সুযোগ দিন।

সুযোগ মিলল পরের ম্যাচে। বার্নাব্যুতে মাদ্রিদ ডার্বিতে শৈশবের ক্লাবের সাথেই। প্রথমে ফাউলের শিকার হয়ে দলের জন্য পেনাল্টি আদায় করলেন, এরপর জামোরানোর জন্য বানিয়ে দিলেন একটি গোল। মিনিট দশেক পর নিজের প্রথম গোল করলেন ছোটবেলার ক্লাবের সাথেই। রিয়াল ডার্বি জিতলো ৪-২ গোলে। প্রথম ডার্বিতেই বার্নাব্যুর দর্শকদের নয়নমণি হয়ে গেলেন স্প্যানিশ রাইজিং স্টার। সেই থেকে ইতিহাসের শুরু। শুরুটা কি আদৌ শেষ দেখেছে আজ অব্দি?

 

 

পরের ১৬ বছর বার্নাব্যু দেখবে এক কিংবদন্তীর পথচলা। এই পথচলার বেলাশেষ ছিল না। এই ১৬ বছরে বার্নাব্যুকে এতটাই মুগ্ধ বশীকরণ করে রাখবেন যে, ফুটবল বিশ্ব রিয়ালকে চিনবে রিয়াল মাদ্রিদ হিসেবে নয়, বরং রাউল মাদ্রিদ হিসেবে। রাউল হয়ে উঠবেন রিয়ালের সমার্থক। গ্যালাক্টিকো যুগের আগে-পরে তো বটেই, গ্যালাক্টিকো যুগে জিদান, ফিগো, বেকহ্যাম, কার্লোস, রোনাল্ডোর মত কিংবদন্তীর ভিড়েও রাউল হয়ে থাকবেন আস্থার প্রতীক হয়ে।

আমাঞ্চিও, হুয়ানিতো, বুত্রাগুয়েনোর পর রিয়ালের বিখ্যাত '৭' নাম্বার জার্সির যোগ্য প্রতিনিধি হবেন। ৭৪১ ম্যাচ খেলবেন, করবেন ৩২৩ গোল। বুত্রাগুয়েনোকে কিছুটা আগেই শেষ বলতে বাধ্য করে ভাঙবেন আরেক কিংবদন্তী ডি স্তেফানোর ৪৫ বছরের ক্লাব রেকর্ড। হিয়েরোর বিদায়ের পর ৮ বছর তাঁর বাহুতে থাকবে রিয়ালের আর্মব্যান্ড। জামোরানো, সুকার, মিয়াটোভিচ তো বটেই, ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত স্ট্রাইকিং জুটি তৈরি করবেন মরিয়েন্তেসের সাথে। এরপর 'এল ফেনোমেনন' রোনাল্ডো হয়ে নিস্তলরয়, ওয়েন, হিগুয়েইন, সিআর নাইনের শুরুটাও দেখবেন এই বর্ষীয়ান।

কি এমন ছিল রাউলের? দুদান্ত গতি? ড্রিবলিং? টেকনিক? নাহ, কোনটাতেই তিনি হাল আমলের 'এ প্লাস' ক্যাটাগরির ছিলেন না। তবে এসব গুণের সবগুলোই মোটামুটি ধারণ, সাথে এদেরকে সামলানোর জন্য চমৎকার একটা মস্তিষ্ক। জানতেন কখন, কোথায় থাকতে হবে এবং জালের ঠিকানা খুঁজে পেতেন সেই বদৌলতেই। অথচ সেই অর্থে কখনোই সেন্টার ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকার কোনটাই ছিলেন না।

দারুণ প্রথম টাচেই ডিফেন্সকে হতভম্ব করে দেওয়া, দ্রুত ফিনিশিং, কিছু বুঝে ওঠার আগেই চকিত শটে নিশানা খুঁজে নেওয়া, সুযোগ তৈরি করা - জাত ফরোয়ার্ডের সব লক্ষণই ছিল রাউলের মাঝে। মাদ্রিদের সাবেক অধিনায়ক, হিয়েরোর ভাষায়, ''রাউল কোনটাতেই ১০/১০ ছিল না। তবে সবকিছুতেই ছিল ৮.৫/১০। যেটা ওকে সেরাদের সেরা বানিয়েছে। ভালদানোর মত ছিল, ''ছেলেটার ট্যালেন্টের চেয়ে চাপ নেবার ক্ষমতা, ধৈর্য আর শান্ত ভাবটাই ওকে আলাদা করে দেয়।'' 

 

 

পেশাদার ক্যারিয়ারে ৯৩২ ম্যাচে কখনো লাল কার্ড না দেখার পরিসংখ্যানটাই বলে দেয় শৃঙ্খলার কথা। এল ক্লাসিকোর বৈরি আবহাওয়াতেও থাকতেন শান্ত হয়েই। তবে রাউলকে ফুটবল বিশ্ব চিনবে একটা টুর্নামেন্টের কারণে - আরও বেশি করে। চ্যাম্পিয়নস লীগ। চ্যাম্পিয়নস লীগ দেখবে টুর্নামেন্টের ইতিহাসের সেরাদের একজনকে। সেই একজন যে ১৯৯৮-২০০২, ৫ বছরে ৩ বার দলকে জেতাবেন মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে দুবার করবেন গোল (২০০০, ২০০২)। ঐ দুটো গোলই রাউলকে গেঁথে রাখবে ইতিহাসের পাতায়। একটি নিজেদের অর্ধের ভেতর থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ গজ দৌড়ে কিপারকে কাটিয়ে ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া গোল, আরেকটি এক নিরীহ দর্শন থ্রো-ইন থেকে চকিত দৌড় আর দ্রুত প্রথম টাচের ফিনিশিং। 

ক্যারিয়ার শেষের আগ পর্যন্ত থাকবেন চ্যাম্পিয়নস লীগ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। দুবার মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল, আর তিনবার মৌসুম সেরা ফরোয়ার্ড। যার প্রতিদান উয়েফা দেবে সর্বকালের সেরা চ্যাম্পিয়নস লীগ একাদশে তাঁকে রাখার মাধ্যমে। ১৬ বছর, ৭৪১ ম্যাচ, ৩২৩ গোল। সাথে ৬ লীগ, ৩ চ্যাম্পিয়নস লীগ, দুটো ইন্টার কন্টিনেন্টাল শিরোপা নিয়েই বিদায় বলেছিলেন বার্নাব্যুকে।

 


তবে দলের প্রতি পেশাদারিত্ব ছিল প্রবল। যে মুহূর্তে মনে হয়েছে, তিনি মাদ্রিদে থাকার যোগ্য নন, তখনই বার্নাব্যু ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাদ্রিদিস্তাদের রীতিমত কাঁদিয়ে  জার্মানির ক্লাব শালকেতে যোগ দেন ২০১০ সালে। পুনর্জন্ম ঘটলো আরেকবার। ৫১ ম্যাচে করলেন ১৯ গোল, সাথে লীগে দুটো হ্যাটট্রিক। জীবনের ৩৪ বসন্তে নিজেকে প্রমাণ করলেন আবার। রাউলের গোলে বায়ার্ন, বুরুশিয়াকে বোধ করে শালকেকে জিতলো জার্মান কাপ, সুপার কাপ। 


চ্যাম্পিয়নস লীগে শালকের হয়ে ৫ গোলে ছাড়িয়ে গেলেন ইনজাঘিকে। ৭৩ গোল করে উয়েফা প্রতিযোগিতা ও চ্যাম্পিয়নস লীগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন। ২০১১ সালে ভাঙলেন গার্ড মুলারের সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান গোলের রেকর্ড। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত পুচকে শালকেকে তুললেন চ্যাম্পিয়নস লীগ সেমিফাইনালে। গেলশেনকির্শেনে দ্বিতীয় মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে করলেন ২৩ গোল। স্পর্শ করলেন ৪০০ ক্যারিয়ার গোলের ল্যান্ডমার্ক। দুবছরেই এতটা মুগ্ধ করেছিলেন শালকে কর্মকর্তা ও সমর্থকদের যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য রাউলের ৭ নাম্বার জার্সিকে অবসরে পাঠায় ক্লাবটি।


২০১২ সালে ইউরোপ ছেড়ে আসলেন কাতারের আল সাদে। প্রথম ম্যাচেই গোল। তারপরের ম্যাচ থেকেই দলের অধিনায়ক। ৫ বছর পর আল সাদকে লীগ জেতানোর পথে ২২ ম্যাচে করলেন ৯ গোল। পরের মৌসুমে আমীর কাপ। ভেবেছিলেন ওখানেই শেষ করবেন অনেক অসাধারণে ভরা ক্যারিয়ারটা। কিন্তু না। এবারের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বিখ্যাত নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে প্রথম মৌসুমে ৪ গোল করলেন। জিতলেন লীগ শিরোপা। পরের বছর জিতলেন সাপোর্টার্স ট্রফি। ক্যারয়ারের শেষ ম্যাচেও খুঁজে ফেলেন জাল। সকার বৌল জিতেই সমাপ্তি টানলেন ২১ বছরের ক্যারিয়ারের।

 

 

৬ 

১০২ ম্যাচে ৪৪ গোল করে একসময় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও জায়গা মেলেনি ২০০৮ ইউরো জয়ী লুইস আরাগোনেসের দলে। পরে জেতা হবে না ২০১০ বিশ্বকাপটাও। ৪ বছর লা ফিউরি রোজাদের অধিনায়ক থাকলেও কোচের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আর পরে টিভিতে অপমানের জবাবটা দিয়েছেন ক্লাবের হয়েই। দেশের হয়ে বলার মত অর্জন কেবল ১৯৯৬ অলিম্পিকের রূপা। তবুও একসময়ের প্রতিপক্ষ পেপ গার্দিওলার মতে, তিনি স্পেনের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। 

ব্যক্তিগত অর্জন? অসংখ্য রেকর্ড, পেলের সর্বকালের সেরা ১২৫ খেলোয়াড়ের তালিকায় নাম, আর ২০০১ সালে ব্যালন ডি'অর আর ফিফার বর্ষসেরার রানার আপ। অথচ সেবারের ব্যালন জয়ী ওয়েন বলেছিলেন, রাউলের না জেতাটা ব্যালনের ইতিহাসে আশ্চর্য প্রশ্নবোধক হয়েই থাকবে!   

থাক। ঐ কাসুন্দি অন্যদিন ঘাঁটা হোক। আজ দিনটা মুখরিত হোক, সৌম্য দর্শন অধিনায়ক রাউলের মুগ্ধতায়! ভালো থাকুন এল ক্যাপিতান, এল প্রিন্স দি মাদ্রিদ, এল ফেরারি - রাউল গঞ্জালেস ব্লাংকো!