• ফুটবল

জিনেদিন জিদানঃ শুধুই কি সৌভাগ্যবান?

পোস্টটি ১২৩৫৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

'জিনেদিন জিদান’- নামটি শুনলে এই কিছুদিন আগেও আক্রমণভাগের এক দুর্দান্ত খেলোয়াড়ের কথা সবার মনে আসত। ফ্রান্সের হয়ে অসাধারণ সব স্পর্শে ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষকে নাকানি চোবানি খাওয়ানো কিংবা রিয়ালের গ্যালাকটিকো যুগে মধ্যমাঠ শাসন এসবই থাকত সেই কল্পনায়। কিন্তু ফুটবল বিধাতা গল্পটা একটু অন্যভাবে বোধহয় সাজাতে চেয়েছিলেন। তাই আজ ফুটবল বিশ্ব বড়ই দ্বিধান্বিত। কে সেরা? খেলোয়াড় জিদান নাকি কোচ জিদান নাকি খেলোয়াড় জিদান শুধু ভাগ্যের জোরে পার করছেন তার কোচিং ক্যারিয়ার।

 

 3205FF1800000578-3489998-image-a-5_1457862788657

 

 

জানুয়ারি ২০১৬, রীতিমত জোর করে জিদানের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয় রিয়ালের ম্যানেজারের দায়িত্ব। রাফা বেনিতেজকে সরিয়ে যখন জিদানকে দায়িত্ব দেওয়া হল তখন একদিকে দলে কলহ, নিয়মিত ফল বিপর্যয় অন্যদিকে জিদানের হাস্যকর ম্যানেজারিয়াল সিভি। শঙ্কিত ছিল তার পার ভক্তরাই । এমন স্টার খেলোয়াড়ের না জানি কিভাবে বিদায় হয় ক্লাব থেকে! কি লিখে রেখেছেন নিয়তি।

যে হটসিটে বসে প্যারেজকে খুশি করতে পারেনাই দেল বস্ক, প্যালেগ্রিনি, জোসে মরিনহো, কার্লো আঞ্চেলোত্তি সেখানে শুধুমাত্র আঞ্চেলোত্তির অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতাটুকু সম্বল করে কতদূর এগোতে পারবে জিদান!! সাথে মাদ্রিদ বি টীমে কোচ হিসেবে খুব বেশি কিছু না করতে পারাটাও দাগ কেটে রেখেছিল ভক্তদের মনে। তার উপর দলে নূন্যতম ভারসাম্যটুকু নেই তখন। এত অল্প বয়সে কিভাবে এত কিছু সামাল দিবেন খেলোয়াড় হিসেবে মাঠ কাঁপানো অনভিজ্ঞ ম্যানেজার জিদান?

শুরু হল এক কঠিন পথচলা। নড়বড়ে শুরুর পরে ফেব্রুয়ারিতে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এটলেটিকোকে ১-০ গোলে হারানোর পরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই জিদানকে। একে একে এল ১১ তম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, টানা ৪০ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড, ২০১১-১২ মৌসুমের পর প্রথম লীগ শিরোপা এবং নতুন ইতিহাস গড়ে টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ হাসিল। ফিরে এসেছিল দলের ভারসাম্য এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল দলের সকলকেই তিনি তার কথা মেনে চলতে বাধ্য করেছিলেন। স্টার খেলোয়াড়ে পরিপূর্ণ একটা দলকে কিভাবে পরিচালনা করতে হয় তা মনে জিদানের মত স্টারই ভাল বুঝেছিলেন।

 

Zidane_Cr7

 

মাদ্রিদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোচদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল স্টার খেলোয়াড়দের সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারার ফলে দলে মনোমালিন্য সৃষ্টি। কিন্তু নিজের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর সবাইকে ব্যবহার করে স্কোয়াড রোটেশনের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের ভেতরে তার জন্য একটা ভরসার জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন জিদান। সেই সাথে রিয়ালের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে বি দলের খেলোয়াড়দের ব্যবহার। নিজের জন্য না খেলে দল হিসেবে প্রতিটা ম্যাচে অংশ নিয়ে পিছিয়ে পরেও জিতে আসার মানসিকতা তিনি ক্লাবের সকলের মাঝে এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সকল খেলোয়াড়দের একই মাপে এনে তাদের আমিত্ব থেকে বের করে এনে একটা দল উপহার দিয়েছিলেন জিদান। এরই ফলস্বরূপ একে একে সফলতাগুলো আসতে থাকে।

জিদান তার ভান্ডারের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র রোনালদোকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হয় কিভাবে তাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন পুরো ফুটবল বিশ্বকে। প্রয়োজনমত বিশ্রাম দিয়ে এবং সঠিকভাবে ব্যবহারের ফলে রোনালদো আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে রিয়ালের হয়ে। ক্রিস্টিয়ানোর বয়স বাড়ার ফলে এক সমস্যা বিগত মৌসুমগুলোতে রিয়ালকে অনেক ভুগিয়েছে তা হল এপ্রিল-মেতে এসে শরীরের সাথে আর পেরে না উঠা। ফলে ইঞ্জুরি বা মাঠে থেকেও ক্লান্তির কারণে পারফর্মেন্সে ঘাটতি। কিন্তু গত মৌসুম খেয়াল করলেই দেখা যাবে একটু ভিন্ন চিত্র। লীগে টানা ৩৪ ম্যাচ খেলানোর পরে মার্চ থেকেই নিয়মিত লীগ ম্যাচে জিদান রোনালদোকে বেঞ্চে বসানো শুরু করে। লেগানোস, স্পর্টিং গিহন, দেপোর্তিভো লা করুনিয়া আর গ্রানাডার ম্যাচে এই গোল মেশিন ছিল বেঞ্চে। ফলস্বরূপ ফ্রেশ ও ফিট রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমি ফাইনালে ইউরোপের দুই পরাক্রমশালী ক্লাব বায়ার্ন আর এটলেটিকোকে ৮ গোল দিয়ে বলতে গেলে একাই ধরাশায়ী করে ফেলেন।

 

1

 

ভাগ্য যে জিদানকে সাহায্য করেনি তা নয়। যেমন বেলের ইঞ্জুরির জন্য জিদান দলকে আরো সাম্যাবস্থায় আনতে পেরেছিলেন ইস্কোকে ব্যবহারের মাধ্যমে। কিংবা দুইটা লাল কার্ডের বিরুদ্ধে আপিল করে নিজের পক্ষে রায় আসাতেও ছিল ভাগ্যের ছাপ বায়ার্নের বিরুদ্ধে। ভাগ্য অবশ্যই ক্ষেত্র বিশেষে জিদানকে সাহায্য করেছিল কিন্তু সাহস ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে কি ভাগ্য তাকে এভাবে সাহায্য করতে পারত?

জিদান নিজের সাহসের পরিচয় আরেকভাবে দেখিয়েছিলেন দলে ক্যাসেমিরোর মত বাচ্চাকে দলের অপরিহার্য অংশ বানিয়ে। যেখানে বড় বড় কোচ এসে পেরেজ বা ব্যবস্থাপকদের চাপে পড়ে দরকারী খেলোয়াড়দের বসিয়ে স্টারদের নামাতে বাধ্য হয় সেখানে জিদান নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে ক্যাসেমিরোকে ব্যবহার করে দেখিয়েছেন দলে কখন কে গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ধারণ করবেন ম্যানেজার, ম্যানেজম্যান্ট নয়। যথেচ্ছ খেলোয়াড় বিক্রি করে দলের ভারসাম্য নষ্ট করে নতুন নতুন গ্যালাক্টিকো সাইন করানো জিদান এসেই থামিয়েছেন, অসাধারনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়েছেন দলের ভারসাম্য।

 

2 

 

জিদানের সহকর্মীদের সাথে কথা বললে জিদান সম্পর্কে তারা প্রায়শই বলে থাকে খুবই লাজুক কিন্তু প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক তবে কখনোই মাত্রাতিরিক্ত নয়। কোচ জিদান নিজের দলেও এই বোধটার সঠিক সঞ্চারণ করতে পেরেছেন। যে কোন ম্যাচে তারা এগিয়ে থাকলে অধিক আত্মবিশ্বাসী নয় আবার পিছিয়ে থাকলেও হাল ছাড়ার পাত্র নয় কেউ। কত কত ম্যাচ জিদানের অধীনে রিয়াল পিছিয়ে পড়েও নিজেদের পক্ষে ফল বের করে এনেছে সঠিক পরিকল্পনা ও জিদানের প্রেরণার জোরে। এরই ধারাবাহিকতায় দলের সবার আর ভক্তদের অগাধ বিশ্বাস জন্মে গেছে ম্যানেজার জিদানের উপর।

জিদান তার ম্যানেজারিয়াল দক্ষতার আরো প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে মার্কো এসেন্সিওর মত তরুণদের ব্যবহারের মাধ্যমে। কোন তাড়াহুড়া নেই যেন। সময় ও ধৈর্য দিয়ে গড়ে তুলছে অল্প বয়সীদের। প্রতিযোগিতার  এ যুগে কেউ একটু ভাল পারফর্মেন্সের আশেপাশে গেলেই তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। উপযুক্ত সময়ের আগে মাঠে বেশি সময় কাটালে কিভাবে প্রতিভা নষ্ট হতে পারে তার উদাহরণ আজকের সময়ে বহুত। কিন্তু জিদান তার রত্নদের আলো থেকে দূরে রেখে নিজের মত করে আস্তে আস্তে মাঠে সময় বাড়িয়ে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে। একদিকে যেমন অভিজ্ঞদের সর্বোচ্চটা বের হয়ে আসছে অন্যদিকে ভবিষ্যতে দায়িত্ব নেওয়ার মত তরুণও তৈরি করে দিচ্ছে কোচ জিদান। 

 

download

 

জিদান কতটা শক্ত নেতা হিসেবে তা দেখা যায় প্রেস কনফারেন্সগুলোতে। কোনভাবেই মাথা না নোয়ানোই তার স্বভাব কিন্তু কাউকে প্রাপ্য সম্মান দিতে কোনভাবেই কার্পণ্যতা করেন না জিদান। যেখানে বর্তমান প্রজন্মের কোচগুলো চায় নিজেদের উপর আলো রাখতে কিন্তু জিদানের এমন কোন ইচ্ছাই নাই। সে তার দলকে সব সময় আলোতে রাখে এবং নিজে আলো থেকে দূরে।

জিদান খুব ভালো করেই জানে তার মাথার উপরে আছে পেরেজের মত একজন অধৈর্য সভাপতি, সফলদের ছোট ভুলেও ছাটাই করতে যার একটুও সময় লাগে না। কিন্তু তবুও জিদান সিদ্ধান্তে সাহসী, দলের প্রয়োজনে অটল। পেরেজ ভুলের একটাই সাজা দেয় তা হল ছাটাই। ট্রফিলেস মৌসুম বা কোন বড় ট্রফি ছাড়া মৌসুম শেষ হলেই জিদানের চাকরি চলে যাওয়ার এক বিশাল সম্ভাবনা আছে তা মাদ্রিদ ফ্যানবেজ সাথে জিদান খুব ভাল করেই জানে। তবুও আপস করতে নারাজ জিদান। এই মাথা না নোয়ানোর ক্ষমতাটাই হয়তবা জিদানকে কোচ হিসেবে সফলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

দল

শুরু

শেষ

ম্যাচ

জেতা

হারা

ড্র

গোল ডিফারেন্স

জেতার হার (%)

রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিলা

২৫ জুন, ২০১৪

৪ জানুয়ারি, ২০১৭

৫৭

২৬

১৪

১৭

(৮৮-৫৮)= ৩০

৪৫.৬১

রিয়াল মাদ্রিদ

৪ জানুয়ারি, ২০১৭

বর্তমান

৮৯

৬৭

১৫

(২৫০-৯৩)=১৫৭

৭৫.২৮

 

কোচ জিদানের পথচলা কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা সম্ভব না এখনই। কিন্তু জিদানের এই গতিতে এগিয়ে যাওয়া থেকে এটা বলাই যায় যে শুধু ভাগ্যের ছোঁয়ায় এরকম গতিতে এত অল্প সময়ে এতদূর যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। জিদান নিজেই নিজের ভাগ্য রচনা করে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। নিজের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতা দিয়ে কঠোর মনোবলের হার না মানা এক দল খুব অল্প সময়েই তৈরি করেছে জিদান। যে দলে ভাগ্যের ছোঁয়া থাকলেও তা শুধুমাত্রই জিদানের কৃতিত্বে যিনি কিনা নিজের প্রতিভার জোরে নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা।