• ক্রিকেট

সেই সময় এই সময়

পোস্টটি ১৭৪৪৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সেই সময়

 

ক.

সুনীলের ‘সেই সময়’ পড়া দূরে থাক, টাইম ট্রিলজীর একটা বইও পড়া হয়নি তখন। পরে ‘পূর্ব পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’ পড়লেও, ‘সেই সময়’ আজও অপঠিতই রয়ে গেছে।

 

খ.

ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। মহাগ্রন্থ মুখস্থের কঠিন পাঠ চুকিয়ে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মূল স্রোতে যুক্ত হয়েছি মাত্র। বিকেল বেলা ছুটে যাই বাসার সামনের বিশাল মাঠটায়। আড্ডা জমে, খেলা জমে, জমে উঠে কৈশোরের দুরন্তপনাও। মাঠে যাওয়া যদি বারণ হয়, তাহলেও কুছ পরোয়া নেই। বাসার সামনের লাল বারান্দায় প্লাস্টিক বলে জমে উঠে টুকুস-টাকুস ক্রিকেট। তাতে বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার শা’লম ভাই এসে বল নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, থেমে থাকে না খেলা। একজন পাহারাদার রেখে চলতে থাকে, দশ ওভার দশ উইকেটের জমাটি ক্রিকেট খেলা।

বাসার নীচে গেইটে হেলান দিয়ে জমে উঠে আড্ডা। পাড়ার ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বাদ যায় না কোন কিছুই। আইচ বাবু আংকেলের দোকানে আজাদী নেওয়া হলে, কিছুক্ষণ চোখ বুলানো হয় পত্রিকায়। কানু বাবু আংকেলের দোকানে আবার রাখা হয় ভোরের কাগজ। সুবিধামত পড়া হয় সেটাও। আর একটু এগোলে, নতুন একটা ফার্মেসী হয়েছে। সেখানে রাখা হয় সমকাল। সেটাও তখন ‘নতুন’ পত্রিকা। সুযোগ পেলে পড়ার তালিকা থেকে বাদ যায় না সমকালও। নানুর বাসায় আবার নয়া দিগন্ত। সেখানে গেলে অবধারিতভাবে পড়া হয় তাও। বাসায় তো প্রথম আলো আছেই। সব পত্রিকার প্রথম এবং একমাত্র আকর্ষণ অবশ্যই খেলার পাতা। এক খবর বারবার পড়তেও যেন কোনো ক্লান্তি নেই।

 

গ.

বসন্তের শেষে, এপ্রিলের সূচনায় এলো অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ সফরের আতিথ্য গ্রহন করেছে তাঁরা। অজি-অহংয়ের উত্তাপ-ঔদ্ধত্যের আমেজ উপহার দিতেই হয়তো রিকি পন্টিং জানালেন, ‘বাংলাদেশের কখনোই টেস্ট খেলা উচিৎ নয়’; এপ্রিলের উত্তাপ আর কালবৈশাখী ঝড়ের চেয়েও বেশী বিপজ্জনক হয়ে ধরা দিল, এই অজি অহং!

টেস্ট আঙিনায় বাংলাদেশ তখনো সংগ্রাম করছিল বটে, তাই বলে এমন নির্লজ্জ অপমান? যদিও পরে স্থানীয় সাংবাদিকদের চাপের মুখে পন্টিংয়ের সুর কিছুটা নরম হয়েছিল বৈকি! ম্যাচ শুরুর আগের দিন নতুন বুট জুতা হাতে শাহরিয়ার নাফিসকে দেখতে পেয়ে রিচার্ড ম্যাকিন্সও হয়তো খানিকটা খোঁচা দেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেননি।

বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া, ১২৯ বছরের টেস্ট খেলুড়ে অস্ট্রেলিয়া, বছর ছয়েকের টেস্ট-অভিজ্ঞ বাংলাদেশকে চাপের উনুনে বসিয়ে দেয়ার পণ করেই বুঝি বাংলাদেশে পা রেখেছিল। কে জানত তখন, চাপের উনুন অস্ট্রেলিয়াকেই সাদরে বরণের জন্য মুখিয়ে আছে?

 

ঘ.

ছোটো খালার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ততা ছিল, প্রাত্যহিক ব্যস্ততাও ছিল, কৈশোরের নানান রোমাঞ্চকর ব্যস্ততাও উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। কিন্তু হঠাৎ আবিস্কৃত হলো, সব ব্যস্ততা হয়ে গেছে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট কেন্দ্রীক।  

রোববারের প্রথম আলোর জন্য অপেক্ষা থাকে পাক্কা এক সপ্তাহ। এক রোববার শেষে, পরের রোববারের অপেক্ষা! সেদিন ‘স্টেডিয়াম’ বেরোয়। ভেতরের আইনের পাতা আর বিজ্ঞান পাতা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকে না, আগ্রহ কেবল রঙ-বেরঙের ওই প্রথম এবং শেষের পাতায়। সেবারের স্টেডিয়াম পাতায় ‘পবিত্র কুন্ডু’ বাতলে দিলেন অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দারুণ দাওয়াই। পছন্দ হয়ে গেল সে টোটকা।

পছন্দ হবে নাই-বা কেন? শেন ওয়ার্নকে কি আমরা চিনি না? সিডনীর পথে কেন বসেছিলেন জানি না? পন্টিংয়ের ‘পান্টার’ নামের রহস্য কি আমাদের জানা নেই? তাহলে ফুসলে-ফাসলে খেলা থেকে ওদের মনোযোগ সরানো যাবে না কেন?

কোনোভাবে একবার যদি উস্কে দেয়া যায় বিতর্কের আগুন, বিশ্বজয়ী পরিবারটাতে যদি জ্বালিয়ে দেয়া যায় অশান্তির দ্বীপশিখা, তাহলেই তো কেল্লাফতে! অস্ট্রেলিয়া বধ ঠেকায় কে?

দু’নম্বুরি চিন্তা? হোক, ক্ষতি কি! তবু তো অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যাবে।

 

ঙ.

প্রবল প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার দাপটই এমন ছিল যে, ক্রিকেট দিয়ে ওদের হারানোর কথা দুঃস্বপ্নেও তখন কল্পনা করা অন্যায়। ওরা অজেয়, ওরা অবধ্য। ওদের সাথে খেলার উদ্দেশ্য যেন জেতা নয়, পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনা কেবল!

তাই অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর জন্য কল্পিত নানা ছক কষছিলাম আমরা।

ক্রিকেটাররা নিশ্চয় আমাদের মতো ভাবেননি। তাঁরা লড়াইটা করেছিলেন মাঠের ক্রিকেটেই। ওয়ার্ন-ম্যাকগিলের ঘূর্ণনকে বিহ্বল করে দিয়েছিলেন। এ্যাশেজ খোয়ানো পন্টিংকে উপহার দিয়েছিলেন আরো কয়েকটি নির্ঘুম, যন্ত্রণাময় রাত।

বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্যের জবাবটা ক্রিকেটাররা তো দিয়েছিলেনই, ডেভ হোয়াইটমোরও সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য উন্ডেড টাইগার।’

 

এই সময়

 

চ.

সেই সময় থেকে এই সময়, পাক্কা এগারো বছর গত হয়ে গেছে! গত হয়েছেন ‘সেই সময়’ উপন্যাসের স্রষ্টাও। ওরা হারিয়েছে হিউজ, আমরা হারিয়েছি রানা। আবেগের কত ঢেউ আছড়ে পড়েছে  পাঁজরে; স্নেহ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়!

গত হয়েছে বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার সেই জৌলুস, সেই দাপট, সেই ত্রাস, সেই ‘অপরাজেয়’ সময়টাও। গত হয়েছে আমাদের কৈশোর, সেই খেলার বিকেল, সেইসব আড্ডা, প্লাস্টিক বলের সেই টুকুস-টাকুস ক্রিকেট, সব গত হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে কালের কোন গহীন গহ্বরে!

আসলে গত হয়ে গেছে আমাদের সেই সময়টাই!

 

ছ.

এখন সময় পালটেছে অনেক। কৈশোরের পর, তারুণ্যের প্রথম কালও পেরিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক পাঠচক্রও প্রায় শেষের পথে। বদলেছে ক্রিকেট, পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে আমাদের জীবন চক্রেও। এখন হাতের মুঠোতেই পাওয়া যায় সব পত্রিকার খেলার পাতা, চাইলেই পড়া যায়। বাংলাদেশের ‘আমাদের সময়’ থেকে ভারতের ‘এই সময়’, যে কোনো পত্রিকায় বুঁদ হওয়া যায় খুব সহজেই। রঙ-বেরঙের খেলার পাতার জন্য এখন সাতদিন অপেক্ষার দরকার পড়ে না, কত সহজ হয়ে গেছে সব!

তাহলে কি জীবনযাত্রা এখন একঘেঁয়ে, পানসে হয়ে গেছে? বোধহয় না। এখনকার রোমাঞ্চ, উত্তেজনা সে আবার অন্যরকম, অন্যস্বাদের। অস্বীকারের উপায় নেই, এই সময়টাও দারুণ বৈচিত্র্যে ভরপুর।

ক্রিকেট খেলার সেই বয়স আর নেই, তবে আড্ডার বয়স ঠিকই আছে। আড্ডার কোন ফাঁকে, ক্রিকেট এসে পড়ে বোঝা না গেলেও, ক্রিকেটের আড্ডা যে বেঁচে আছে, ঠিক বোঝা যায়।

ক্রিকেটের আড্ডা ছিল সেই সময়ে, আছে এই সময়েও। 

 

জ.

ক’দিন পরপর ঘোর বর্ষণে জনজীবন কেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজপথ জুড়ে ইয়া বড় বড় গর্ত, গর্ত তো নয় যেন রাস্তাগুলো আমাদের গিলে খাওয়ার প্রহর গুনছে। এবারের বর্ষাটাও কেমন দীর্ঘ মনে হচ্ছে। শেষ হওয়ার নাম-গন্ধ যেন নেই। অস্ট্রেলিয়ার দুই টেস্টের ছোট্ট সফরটাও যেমন দীর্ঘায়িতই হচ্ছিল কেবল! সবশেষে সফরের নিশ্চয়তা যখন মিলল, তখন আরেক অনিশ্চয়তা, ম্যাচগুলো ঠিকঠাক হবে তো! বৃষ্টি-বাঁধায় ভেস্তে যাবে না তো?

 

ঝ.

অস্ট্রেলিয়া নেই ‘সেই’ অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশও নেই ‘সেই’ বাংলাদেশ।

‘সবাই জানে চ্যালেঞ্জটা অনেক কঠিন। তবে আমাদের আত্নবিশ্বাস আছে আমরা অস্ট্রেলিয়াকে কঠিন সময় দিতে পারব, যেটা ইংল্যান্ডকে দিতে পেরেছি।’ বাংলাদেশ দলপতির কন্ঠে এখন প্রবল আত্নবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষিত হয় সিরিজ জয়ের প্রত্যয়। যে ঘোষণাকে একটুও বাগাড়ম্বর মনে হয় না, বরং নিদারুণ বাস্তবতা বলেই মেনে নিতে হয়।

প্রায় দেড়শো বছর বয়সী ক্রিকেট খেলুড়ে দেশটিও হয়তো মেনে নিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশের আধিপত্য। না মেনে আর উপায় কি, মিরপুরের গোধূলী বেলার রোমাঞ্চ যে খুব বেশী দিন আগের নয়! কলম্বোর সোনারাঙা বিকেলটা তো মাত্র মাস-পাঁচেক আগের!

তাই এই সিরিজে এই বাংলাদেশের আধিপত্য মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, অজি-অহংয়ের পতাকাবাহী অধিনায়ক স্টীভ স্মিথের।

 

ঞ.

এই এগারো বছরে দুটো দলের শক্তিমত্তায়ও অনেক উলট-পালট ঘটে গেছে। উলট-পালট ঘটেছে বিশ্বাসে, উপলব্ধিতে ও রণকৌশলেও। তাই এখন অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দাওয়াই খুঁজতে আমরা আর মাঠের বাইরে যাই না। অস্ট্রেলিয়াকে যে এখন মাঠের ক্রিকেটেই পরাভূত করা সম্ভব। খুব সম্ভব।

হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসা অতিথিদের অভ্যার্থনা জানাতে ত্রুটির কোনো জায়গা রাখছেন না, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিভাবকেরা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সাথে সম্ভব সর্বোচ্চ আপ্যায়নের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে অস্টেলীয় অথিতিদের জন্য।

অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকছে মাঠের ক্রিকেটেও। সেখানকার আয়োজন পরিকল্পনায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, হেড কোচ থেকে পিচ-কিউরেটর পর্যন্ত সবাই।

 

 

সেই সময় এই সময়

সেই সময় ক্রিকেটাকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্রহটির মহা নক্ষত্রেরা ধুলি-ধূসরিত এই বাংলাদেশে পা রেখেছেন, সেটাই ছিল বিশাল ব্যাপার। ওদের সাথে খেলতে পারাটাই ছিল মহাসৌভাগ্যের, অতবড় তারকাদের কাছ থেকে দেখতে পারাটাই ছিল সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।

আর এই সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত মেহমানদের সৎকারে শলা-পরামর্শের কমতি নেই, কোচ-ক্যাপ্টেন, ক্রিকেটারদের। অতিথিদের ঠিকঠাক সৎকার সাধনেই যেন সব তৃপ্তি, সব আনন্দ, সব আয়োজন হবে পরিপূর্ণ।

সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে এই সৎকার আর সেই সমাদরের ভাষাতেই হয়তো সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা ঘটে গেছে!