• ফুটবল

রিয়াল মাদ্রিদের হারানো দাবার গুটি

পোস্টটি ২৯২৯১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ম্যানেজার হিসেবে জিনেদিন জিদানের দায়িত্ব নেওয়ার পরে থেকেই ভাগ্য বদলে গেছে সাফল্যপিপাসু রিয়াল মাদ্রিদের। সাম্প্রতিক সময়ে বলতে গেলে সফলতার চূড়ায় অবস্থান করছে এই ক্লাব ও তার সমর্থকরা। জিদান এনে দিয়েছে বহু আকাংক্ষিত লীগ শিরোপা সেই সাথে পর পর দুইবার ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ। দর্পচূর্ণ হওয়ার পথে এতদিন ক্লাব ফুটবল শাসন করা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার।

 

এই রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে যখন আড্ডা শুরু হয় তখন কোন কোন খেলোয়াড়দের কথা মাথায় আসে ফুটবলপ্রেমীদের? গোলমেশিন রোনালদো, দানব বেল, ক্যাপ্টেন রামোস, আবেগী মার্সেলো, স্নাইপার ক্রুস, সৃষ্টিশীল মড্রিচ, উঠতি স্টার এসেন্সিও, লর্ড বেনজেমা। কিন্তু এই মাদ্রিদ একাদশে জিদান তার ভরসার হাতটা এমন আরো একজনের কাঁধে রেখেছে যে প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকে দলকে ঠিকই এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জিদান পূর্ববর্তী কোচদের রিয়াল মাদ্রিদের দাবার বোর্ডের হারানো সেই গুটিই হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার কার্লোস হেনরিকে জোসে ফ্রান্সিস্কো ভ্যানান্সিও ক্যাসেমিরো। মাদ্রিদের সফলতার পেছনে জিদানের যতটা কৃতিত্ব তার একটা বড় অংশই যাবে এই ক্যাসেমিরোর ঝুলিতে। ধারণা করা হচ্ছে ফ্রান্সের এলান ম্যাকালেলেকে প্রতিস্থাপন করার মত কোন প্রতিভা দীর্ঘ ১৫ বছর পরে ফুটবল বিশ্বে এসেছে যার বর্তমান গুরু জিনেদিন জিদানের মত সাবেক বিশ্বসেরা।

 

জিদান তার পূর্বসূরিদের ব্যবহৃত ৪-৪-২ বা ৪-৩-৩ দিয়ে শুরু করলেও সেগুলোকে যোগ করে এক নতুন ৪-১-২-১-২ ডায়মন্ড শেপে খেলানো শুরু করে মাদ্রিদকে।

 

41212

 

ক্যাসেমিরোকে সেখানে ডিফেন্স লাইনের উপরে মাঝমাঠে প্রতিপক্ষকে আটকানোর জন্য রাখা হয়। এতে করে মাদ্রিদের বিশ্বসেরা মিডফিল্ডারদ্বয় ক্রুস ও মড্রিচ আরও স্বাধীনভাবে উপরে খেলতে পারে। গ্যারেথ বেলের ইঞ্জুরি থাকায় মাঝমাঠের আক্রমণাত্মক অংশে ইস্কোকে খেলানো হয় এবং উপরে রোনালদো আর বেঞ্জেমা জুটি বেশ সাবলীলভাবে নিজেদের রক্ষণাত্মক ভূমিকা রেখে নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারে। ফল তো আপনাদের চোখের সামনেই। রোনালদোকে একটু মাঝে আনার ফলে গোল মেশিনের কর্মদক্ষতা কত বেড়েছে তার নমুনা।


ronaldo

case

 

ডিফেন্সের একটু উপরে মাঝমাঠের জায়গাটায় বোধহয় এখন বিশ্বের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়টিই ক্যাসেমিরো যাকে বলে নাম্বার সিক্স (যদিও এই জার্সি নাম্বার নিয়ে আধুনিক ফুটবলে বেশ মতবিরোধ রয়েছে)। তার মত ডিফেন্স লাইনের রক্ষক এখন খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। সাথে রয়েছে ম্যাচের সময়, ফলাফল এবং প্রতিপক্ষের অবস্থানের ভিত্তিতে অসাধারণ জায়গা বদলানোর ক্ষমতা।

 

majhec

 

প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে বল থাকলে সে মাঝমাঠে প্রতিপক্ষের পাসিং লেন বন্ধ করে তাদের পাসের সুযোগ ছোট করে ফেলে।

 

passblock

 

মাঝমাঠে বল এসে গেলে সে নীচে থেকেই পাসিং লেন বন্ধ করে রেখে প্রয়োজন বুঝে চার্জ করে বলের নিয়ন্ত্রণ নিজে নেয়। পুরো চ্যাম্পিয়ন্স লীগে মোট ৪৮ ট্যাকেল সফল্ভাবে সম্পন্ন করে এবার ক্যাসেমিরো যা এবারের টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ থেকে ১২টি বেশি। তবে ক্যাসেমিরোর সবচেয়ে শক্তির জায়গা প্রতিপক্ষের সাথে দৌড়ে ওয়ান ওন ওয়ানে জিতে আসার ক্ষমতা। প্রতিপক্ষের যেকোন পাশ থেকে ওয়ান ওন ওয়ান অবস্থা থেকে বল ছিনিয়ে আনাকে রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে নিজের বুদ্ধিমত্তা, গতি আর শরীর দিয়ে।

 

Casemiro_I_TACTICAL_ANALYSIS_I_The_key_to_Real_Madrid_s_success

 

পুরো দল এবং দলের খেলা একা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাও খুব ভালো করে জানা আছে ক্যাসেমিরোর। পোর্তোতে থাকার সময় এ কাজটি খুব ভালো করে পালন করে দেখিয়েছে ক্যাসেমিরো। তবে মাদ্রিদে তাকে সাময়িকভাবে এ দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়ে রেখেছে কোচ জিদান। কেননা এ মূহুর্তে মাদ্রিদের মিডফিল্ড শাসন করছে ক্রুস ও মড্রিচ মানিকজোড়। পুরো ম্যাচের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মত যে অসাধারণ ক্ষমতা ক্রুসের রয়েছে নিজের পাসের মাধ্যমে তা অতুলনীয়। সেই সাথে রয়েছে জাদুকর মড্রিচ। এতটাই সৃষ্টিশীল যে মড্রিচের পায়ে বল গেলে যে তা কোথায় যাবে বা পরবর্তীতে বলের নিয়ন্ত্রণ কোনদিকে নিবে তা বোঝার বা ধারণা করার ঘটনা এখন কোন ফুটবলবোদ্ধারও নেই বোধহয়। সেইসাথে সামনে থাকে বেল, বেঞ্জিমা ও রোনালদো। তাই আক্রমণের দায়িত্বে এখন খুব বেশি যেতে হয় না ক্যাসেমিরোকে।

 

এক মিডফিল্ডের আক্রমণে যতটা কাজ দরকার তার থেকে বেশিই অনবরত করে যাচ্ছে ক্রুস-মড্রিচ। তাই আর আক্রমণকে না বরং ডিফেন্স আগলে যে আক্রমণে যেতে পারবে এমন আরেকজন দরকার। ক্যাসেমিরোর কাজ শুধুমাত্র ডিফেন্স আগলে রেখে যত বেশি পারা যায় প্রতিপক্ষের পা থেকে বল নিয়ে তার সংগীদ্বয়দের দিয়ে দেওয়া। তবুও প্রায়শই দেখতে পাওয়া লং শটে দূর থেকে গোল, কর্ণারে হেডার সাথে লম্বা লম্বা বল সামনে পাঠিয়ে দেওয়া। ক্যাসেমিরো আরেকটা ক্ষমতা মাঠে রিয়ালকে এতটা বেগবান করেছে। হঠাত পায়ে বল পেলে সামনে ফাঁকা থাকলে ক্যাসেমিরো বল নিয়ে মড্রিচ আর ক্রুসকে বাইপাস করে নিজেই এগিয়ে যায় ত্রিশ-চল্লিশ মিটার বল নিয়ে। শক্তি, নিখুঁত শর্ট ও লং পাসিং, লং শটে জোর সাথে বুদ্ধিমত্তা মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পরে প্রতিপক্ষ। সাথে রয়েছে দূর পাল্লার ফ্রি কিক থেকে পাস এবং শট উভয়ে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা।

 

 

ক্যাসেমিরোর আলো থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হল সে শুধু জিদান প্রদত্ত দায়িত্বটুকু মাঠে পালন করে আসে। নিজের ক্ষমতার প্রদর্শনের চেষ্টা সে করে না। নিজের আক্রমণাত্মক মনোভাবকে লুকিয়ে রেখে শারীরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সে শুধু ডিফেন্স আগলে রেখে বল সরবরাহ করে যায় প্রতিনিয়িত ক্রুস আর মড্রিচকে। দর্শক মহলে তার প্রতি বিরুপ মনোভাবের কারণ তার দ্বারা ফাউলের পরিমাণ।

 

রিয়ালে তার পারফর্মেন্স এবং তার ক্ষমতা দেখে এখন ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরাও আশায় বুক বাঁধা শুরু করেছে। ব্রাজিল ফুটবলে আক্রমণভাগে প্রতিভার ছড়াছড়ি হলেও ডিফেন্সিভ মিডে তেমন কেউ নেই বললেই চলে সেখানে এমন খেলার গতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম একজন থাকলে যেমন আক্রমণে জোর বাড়বে তেমনি আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা ডিফেন্সের চিন্তা ভুলে আরও নিশ্চিন্তে নিজেদের আক্রমণে উজার করে দিতে পারবে।

 

আজকের এই ক্যাসেমিরোর কারণে পুরো মাদ্রিদ ডিফেন্স গত মৌসুমে বেশ শান্তিতে সময় পার করেছে। ক্যাসেমিরোবিহীন যেকোন ম্যাচই প্রমাণ করে রিয়াল ডিফেন্স এই বাচ্চা ছেলেকে ছাড়া এখন কতটা নড়বড়ে হতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এখনো ছেলেটা মাঠে নিজের সর্বোচ্চ থেকে বেশ দূরে। জিদান এটা জেনেই তাকে এমনভাবে তৈরি করছে যেন ভবিষ্যত মাদ্রিদ ক্রুস বা মড্রিচের অনুপস্থিতিতে তাদের অভাবটা যেন কোনভাবেই টের না পায়।