• অন্যান্য

পুরানো সেই দিনের কথা...

পোস্টটি ৭২৪০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

হয়তো বড় মাঠে ক্রিকেট খেলছি। হঠাৎ খেলা ছেড়ে সবার দৃষ্টি গেল আকাশপানে। চোখ সেই আকাশে নিবদ্ধ রেখেই ব্যাট-বল ছুঁড়ে তারপর শুরু হলো যেন দৌঁড় প্রতিযোগিতা। সে কী দৌঁড়, একেকজনের গতি বুঝি শোয়েব আকতারকেও হার মানাবে! না দৌঁড়ে উপায় কি বলুন, অমন মরিয়া দৌঁড় না দিলে যে, উড়ে আসা ঘুড়িটার নাগাল পাওয়া যাবে না! 

অনেক দৌঁড়ের পর কোনো এক সৌভাগ্যবান পেয়ে যেত, কেটে আসা ঘুড়িটা। কখনো বা অনেক হাতে পড়ে ছিঁড়ে তছনছ হয়ে যেত সাধের ঘুড়ি। আবার কখনো হয়তো ঘুড়িটা আটকে যেত গাছের উঁচু কোনো ডালে বা বৈদ্যুতিক থামের তারে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখতাম!

ঘুড়ি উড়ানোই শুধু নয়, ঘুড়ির সুতা বানানো থেকে শুরু করে, নাটাই চালনা পর্যন্ত কত্ত কাজ! পুরোটাই যেন একটা শিল্প। এই শিল্পের সুনিপুণ শিল্পী চাইলেই হওয়া যায় না, সাধনার দরকার হয়। সেই সাধনা করতে গিয়ে সুতার ধার বাড়াতে গিয়ে কতজনের হাত কেটে যে রক্তাক্ত হতো! ঘুড়ি কেনার জন্য বাসায় টাকা চাইতে গেলে, বকা-মার-গালিও কম জুটত না। সে সমস্যার সমাধানও ছিল। ঝাড়ুর শলাকা আর পলিথিন দিয়ে অনেকেই খুব সুন্দর করে ঘুড়ি তৈরী করে ফেলতেন।

এক-একটা সময় ছিল, যখন চট্টগ্রামের আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়াতো রঙ-বেরঙের ঘুড়ি! আমরা সেসব দেখতাম। কেউ মাঠে, কেউ ছাদে নাটাই হাতে ঠিক ব্যস্ত থাকতেন। নাটাইয়ের মৃদুমন্দ দ্রুত সঞ্চারণও যে কত আনন্দ দিত!

আজ কত দিন হয়ে গেল, তেমন ঘুড়ি-উৎসব দেখি না!

দেখি না আরো অনেক কিছুই। আমাদের শৈশবের বাহারী ধাঁচের খেলাগুলোর অস্তিত্বও খুব একটা চোখে পড়ে না। ছোটো ছোটো ভাই-বোন আছে, ভাগ্নে-ভাগ্নী আছে, আছে ভাইপো-ভাইঝি, কই তাদের তো তেমন কোনো খেলায় মেতে উঠতে দেখি না!

মোবাইল গেমস, কম্পিউটার গেমসে ব্যস্ত সময় পার করছে তাঁরা। আমাদের মতো অভিনব সব খেলাধুলোয় ব্যস্ত হওয়ার সময় কই তাদের?

গেমস অবশ্য সেই সময়ও ছিল। ভিডিও গেমস। এক টাকার কয়েন দিয়ে খেলতে হতো। ‘মোস্তফা’ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। বাবা বা শিক্ষক কিংবা বড় কেউ যদি ভিডিও গেমসের দোকানে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে তো হয়েছে, তাহলে আর রক্ষে নেই। তাই এদিক-সেদিক কত দিক দেখে যে সেখানে ঢুকতে হতো!

তাই বলে আমাদের মনোজগতের পুরোটা জুড়ে সেসব ভিডিও গেমস থাকত না। সেখানে কত ধরণের খেলা। গুটি খেলা, বিচি খেলা, কাইম খেলা কত কি!

কাইমের শুদ্ধ কি ঠিক জানি না। তবে খেলাটা বড় মজার ছিল। কোয়ালিটি আইসক্রিম থেকে পাওয়া কাঠিকে (হ্যাঁ, কাইমকে কাঠিও বলতে পারেন) একশ ধরে, বাকী কাইমগুলো দশ ধরে ভালোই জমত খেলাটা। এক গেম চলত দিনের পর দিন! দেশলাই কাঠি দিয়েও একটা মজার খেলা ছিল। কি জানি, এখন আর সেসব খেলা হয় কি না! অবশ্য হবে কোত্থেকে, অটোমেটিক গ্যাসের চুলা তো দেশলাই কাঠির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিয়েছে অনেকাংশেই।

রোজার দিনে খেজুর বিচি সংগ্রহ করা হতো। ইফতারের পর জমত বিচি খেলা। অথবা সকালেও। কদু বিচি, তেতুল বিচি, কাঠাল বিচি, শিম বিচি সেসব দিয়েও দারুণ খেলা হতো।

এক-এক মৌসুমে জমতো এক-এক ধরণের খেলা।

পাঁচ গুটি মানে পাঁচটি পাথর নিয়ে খেলা। সেখানে একটির পর একটি স্তর। শেষ স্তরে আছে গেম। একটার পর একটা গেম শেষ হয়, আর মোট গেম হিসেব হয়। এভাবে চলতে থাকে খেলা। অনেকে অবশ্য এটাকে মেয়েদের খেলা বলে বাঁকা চোখে দেখেন বা দেখতেন।

আরো কত ধরণের যে খেলা ছিল! এত ধরণের খেলায় মত্ত হতে দেখে আব্বু-আম্মু কখনো বলে উঠতেন, “এত খেলা যে তোরা কই পাস!”

ক্রিকেটও যে কত ধরণের ছিল। খাতায় গোল করে স্টেডিয়াম এঁকে, তারপর ঘর ঘর করে সেখানে ক্রিকেটের বিভিন্ন আউট, রান লিখে দেয়া। এবার চোখ বন্ধ করে কলম দিয়ে খেলা। ফুটবলেও অনেকটা এরকম একটা খেলা ছিল। দুই পাশে থাকবে দুই গোলবার। তারপর যার যার সুবিধেমত প্লেয়ার বসানো, এবার এক প্লেয়ার থেকে আরেক প্লেয়ারকে কলম দিয়ে ‘পাস’ দেয়া।

Cricket Football

 

আহা, কেমন নস্টালজিক করে দেয়! কত রকমের খেলা যে দেখেছি, খেলেছি!

আচ্ছা, বসে বসে ক্রিকেট খেলেছেন কখনো? যখন হেফজখানায় ছিলাম, সেখানে এই খেলা খেলতাম! ব্যাটিং বসে, বোলিং বসে, ফিল্ডিং বসে, আম্পায়ারিংও বসে বসে। শুধু চার, ছয় মারলেই আউট। শর্টপিচেও অবশ্য ছয় মারলে আউট। কিন্তু সেখানে তো দৌঁড়ে রান থাকে, আমাদের ‘সিটিং ক্রিকেটে’ দৌঁড়ে কোনো রান নেয়ার সুযোগ ছিল না!

আহা, কি সব সময় ছিল! মাঝে মাঝে পুরনো কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে, কথা হলে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়-

আয় আর একটিবার আয় রে সখা

প্রাণের মাঝে আয়।

মোরা সুখের দুখের কথা কব

প্রাণ জুড়াবে তায়।

 

মার্বেল, লাটিম, ডাংগুলি এসব বোধহয় বেঁচে আছে এখনো। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। গ্রামে গেলে কত শত ধরণের যে খেলা হতো, সেসব অনেক মনেও নেই! তবে স্কুলগুলোতে হয়তো এখনও কিছু খেলা বেঁচে আছে। হয়তো সব খেলাই বেঁচে আছে, শুধু আমারই চোখে পড়ে না, এই যাঃ!

অনেকে আবার দাবা পারত না, তাঁরা খেলত ১৬ গুটি।

এই ১৬ গুটি, লুডু এসব এখন মোবাইলেও ফিরে এসেছে। বিচিত্র আনন্দ নিয়ে মানুষ এখন সারাদিন এসব খেলে। হয়তো হারাতে বসা শৈশবের কোনো খেলাকেও একদিন ফিরে পাবো, গুগল প্লে স্টোরে। সেখান থেকে ডাউনলোড করে প্রবল উত্তেজনায় খেলতে বসতেও পারি। অথবা হয়তো খেলবোই না। ঠিক যেমন খেলা হয়নি লুডু স্টার। কি জানি!

তবে এটুকু নিশ্চিত জানি, আমাদের বর্ণময় শৈশবের সেইসব সোনালী বিকেল, বিচিত্র সব খেলার চিত্তানন্দের সময়গুলো বড় ভালো ছিল। বড় আনন্দের ছিল। বড্ড সরল আর সাধারণ ছিল।