• ক্রিকেট

তুমি আর নেই সে তুমি

পোস্টটি ১১৩৪২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

ক্রিকেট খেলাটা কি তবে সার্কাস হয়ে গেল?

প্রশ্নটা ভালোই পেয়ে বসেছে মাইনুদ্দীনকে। গত ক’দিন ধরে বিষয়টা খুব ভাবাচ্ছে তাকে। তার মনে পড়ে ছেলেবেলায় সে আর কৌশিক মিলে ১০ ওভার আর ১০ উইকেটের ম্যাচ খেলত। তাদের বাসার সামনের বারান্দায় প্লাস্টিক বল দিয়ে টুকুস-টাকুস করে ক্রিকেট খেলতে তারা নির্মল আনন্দ পেত। তখন তাদের খুব পছন্দের ছিল এই ধরণের ক্রিকেট। একবার পত্রিকা মারফত জানতে পারল ইডেন গার্ডেনের ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে পাকিস্তান-ভারত একটা প্রীতি ম্যাচ খেলেছে। তখনও ইডেন গার্ডেনের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। ইডেন যে কলকাতার একটা মাঠ সেটাও বোধহয় জানত না। তারপরও তারা তাদের ১০ ওভার ১০ উইকেটের ক্রিকেটকে বিশেষায়িত করল ‘ইডেন গার্ডেন’ ক্রিকেট নামে। ঘন্টা খানেক খেলার সময় পেলেই মাইনুদ্দীন বেশ উত্তেজনার সাথে বলে উঠত ‘চলো আজকে ইডেন গার্ডেন খেলি।’ কৌশিকও সাথে সাথে রাজী হয়ে যেত। স্কুল পালিয়ে, বিকেলের ঘুম ফাঁকি দিয়ে কতটা সময় যে ‘ইডেন গার্ডেন’ ক্রিকেটে দিয়েছে!

কেমন যেন নস্টালজিকতা পেয়ে বসে মাইনুদ্দীনকে।

তাদের সেই ‘ইডেন গার্ডেন’ ক্রিকেটই বোধহয় ভোল পালটে এখন টি-টেন রুপে ফিরে এসেছে! কত্ত বড় বড় ক্রিকেটাররা খেলছেন! আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পাচ্ছে এসব ক্রিকেট! যে ক্রিকেট একসময় পাড়া তো দূরের, সামনের বড় মাঠটাতেও কখনো খেলত না তারা। শুধু বারান্দায়, প্লাস্টিক বলে যে ক্রিকেট ছিল সীমাবদ্ধ সেটাই নাকি এখন মরগান, সাকিবদের মতো বিশ্বক্রিকেটের বড় বড় মহাতারকারা খেলেন! ভাবতেই আশ্চর্য্য লাগে মাইনুদ্দীনের। তারা একসময় ছয় ওভার, আট ওভারের ক্রিকেটও খেলত; সূর্য ডুবু ডুবু হয়ে গেলে তখন খুব তাড়াহুড়ো করে তিন ওভার করে খেলত। তবে কি ছয় ওভার, আট ওভার কিংবা তিন ওভারের ক্রিকেটও খুব সিরিয়াস ক্রিকেট হিসেবে দেখতে হবে? ভেবে পায় না মাইনুদ্দীন।

 

২.

মাইনুদ্দীনের মনে আছে শৈশবে খেলাটা কীভাবে তাকে টানত! নিশ্চয় অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি আছে খেলাটার, নইলে অত খেলা থাকতে এই খেলাটাই কেন ভালো লাগবে তার? একবার শোয়েব আকতারের বল সৌরভের পাঁজরে আঘাত হানল। মাইনুদ্দীনের স্পষ্ট মনে পড়ে, সে চমকে শোয়া থেকে উঠে বসেছিল। কী তেজ! অমন বাঘের মতো ক্ষিপ্র কোনো ফাস্ট বোলার যদি না দেখত তাহলে কি তার ক্রিকেটটা এত ভালো লাগত? কিংবা জয়সুরিয়ার সেই পা তুলে মারগুলো? ‘৯৬তে ইংল্যান্ডকে কী মারটাই না দিল! ডিফ্রেটাস-ইলিংওয়ার্থের জন্য এখনো সমবেদনা জাগে মাইনুদ্দীনের।

ক্রিকেটটা তখন কত্ত আনন্দের ছিল! বিটিভিতে টেস্ট ক্রিকেট দেখাত। ইংল্যান্ডের কোনো একটা দল এসেছিল বুঝি। খেলার ফাঁকে মীনা কার্টুনও দেখাত। মাইনুদ্দীনের এখন ঠিক মনে নেই খেলার মাঝে মীনা কার্টুনেই বেশী আগ্রহ পেত নাকি খেলাটাই তাকে বেশী টানত! তবে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের শিহরণটুকু ঠিক মনে আছে তার! বড় চাচার সে কী উত্তেজনা! নিজের কাপড়ের দোকানটা বন্ধই করে দিয়েছিলেন ক’দিনের জন্য। খেলা দেখবেন বলে!

 

৩.

মাইনুদ্দীনের শৈশব জুড়ে বড় চাচা বিশাল একটা জায়গা দখল করে আছেন। ক্রিকেটের প্রতি এত আগ্রহের পেছনেও নিশ্চয় বড় চাচা-ই রেখেছেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা। ছেলেবেলায় মাইনুদ্দীন বড় চাচার মুখে একটা টেস্টের গল্প খুব শুনেছে। যে গল্পকে সে নামাঙ্কিত করেছিল ‘মেলবোর্ন টেস্ট’ নামে। বড় চাচা বলতেন, “বুঝলি, গ্রামে তো তখনও সেভাবে পত্রিকা যায় না।” বড় চাচা বলতে শুরু করলেই তন্ময় হয়ে শুনত মাইনুদ্দীন। “রাস্তাঘাট ভালো না। দুই-তিন দিন পর পত্রিকা যেত। একবার পত্রিকা পড়ে আমার হয়ে গেল বিরাট সমস্যা। নিউজিল্যান্ড চতুর্থ দিন শেষ করেছে ৯ উইকেটে ২৮৫ রান নিয়ে। লিড হয়েছে ২৪৫।” এই পর্যায়ে এসে দম নিতেন চাচা। যেন তিনি সিডনী শেলডনের কোনো থ্রীলার গল্পের বর্ণনা দিচ্ছেন। এক্ষুণি উন্মোচন করবেন সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অংশটা। “শেষ দিনের খবর পাওয়ার জন্য আরো তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে। কী যে করি! মজার ব্যাপার কী জানিস, যে দিন আমি ৪র্থ দিনের খবরটা পেয়েছি ততদিনে টেস্টটারও শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।”

মাইনুদ্দীন অবশ্য এখন এই অবস্থার কথা কল্পনাও করতে পারে না। সে ছেলেবেলা থেকেই টিভিতে ক্রিকেট দেখে অভ্যস্ত। এখন তো আবার প্রতি মুহূর্তে স্কোর আপডেট পাওয়া যায়। একটা টেস্টের স্কোর জানার জন্য তিন-চার দিন অপেক্ষা, টেস্ট শেষের ৫/৭ দিন পর ফলাফল জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা, কেমন জানে লাগে মাইনুদ্দীনের। অথচ বড় চাচা নাকি তিন রাত ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেননি। প্রায় মাইল-বারো হেঁটে দূরের এক ভদ্রস্থ বাজারেও ছুটে গিয়েছিলেন, যদি টেস্টের ফলাফলটা জানা যায়। কিন্তু সেখানে যে পত্রিকা পেয়েছিলেন তাতে ছিল না অস্ট্রেলিয়া-নিউজল্যান্ডের সেই ম্যাচের রেজাল্ট।

শেষ পর্যন্ত যখন বড় চাচার হাতে সেই আকাংখিত পত্রিকাটি আসল, ম্যাচের ফলাফল দেখে নাকি তার এত খুশী লেগেছিল যে, এই ক’দিনের অন্তহীন উত্তেজনা বেমালুম ভুলে যেতে একটুও খারাপ লাগেনি।

মাইনুদ্দীন ঘাঁটাঘাঁটি করে সেই ম্যাচ বের করেছে। স্কোর কার্ডে চোখ বুলিয়ে আরো একবার বুঝি শৈশবে ফিরে গিয়েছিল সে। বক্সিং ডে টেস্ট দেখে সেই ম্যাচটার প্রতি অন্যরকম ভালো লাগার মাত্রাও বেড়ে যায় তার। ম্যাকডারমট, হুইটনি, স্যার হ্যাডলীর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধও জেগে উঠে।

ম্যাকডারমট-হুইটনি মিলে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পরাজয়, আর স্যার হ্যাডলীর ফাইফার ম্যাচটাকে দিয়েছিল ধুন্ধুমার এক উত্তেজনার পর্যায়। কেউ না হেরে ক্রিকেটকেই বিজয়ী হওয়ার সুযোগ যে করে দিয়েছিলেন তাঁরা।

মাইনুদ্দীন সেই ম্যাচ স্বচক্ষে না দেখলেও কতবার যে মেলবোর্নের সেই বিকেলে ফিরে গিয়েছে!

 

৪.

নিজেকে কখনোই বিশুদ্ধবাদী মনে হয় না তার। সময়ের সাথে ক্রিকেটের বিবর্তন বা রুপান্তরেও নেই অত আপত্তি। কিন্তু ক্রিকেটের বিস্তার, বিশ্বায়ন বা জনপ্রিয় করার নাম করে যেভাবে ক্রিকেটের বিকিকিনি হচ্ছে, সেসব একদমই সহ্য হয় না তার।

প্রথমে এলো বিশ-বিশ, এখন আবার দশ-দশ! তারপর কী হবে কে জানে! সংক্ষিপ্ত করতে করতে কি একটা সময় কেবল টসেই নেমে আসবে ক্রিকেটটা? অতদূর ভাবতে বসলেই কেমন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে মাইনুদ্দীনের। সে ক্রিকেটের অমন বেহালাবস্থা মোটেও কল্পনা করতে চায় না।

ছেলেপিলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখলেই সে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের খেলাও সে বড় আগ্রহ নিয়ে দেখে। মাঠে হোক বা বারান্দায়, টিভিতে কিংবা পত্রিকায়, ক্রিকেট দেখলেই সে থমকে যায়। খেলাটাই যে তার বড্ড ভালো লাগে।

সে ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটই আশা করে বরাবর। ক্রিকেটের চাদরে অন্যকিছু চলবে, ক্রিকেট ভাঙিয়ে ব্যবসা হবে, আবার সেটা তার দেখতে হবে; কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগে তার।

সেই হাঁসফাঁস অবস্থা নিয়েই তবু সে ক্রিকেট দেখে। ভেতরটা কেমন ডুকরে কাঁদে, শচীন দেব বর্মন যেন গুনগুন করে গেয়ে উঠেন-

তুমি আর…

তুমি আর নেই সে তুমি…।