• ফুটবল

এক ফুটবল জাদুকরের গল্প

পোস্টটি ৯৬২৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এক দেশ খাদের কিনারে। দলের সিনিয়র বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় অবসরে। এই অবস্থায় কোচ একজনকে অনুরোধ করলেন দেশের স্বার্থে অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসতে। চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় তিনি, দেশের ডাকে সাড়া দেয়া টা তার জন্য স্বাভাবিক।
অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসলেন তিনি, বাছাই পর্বে সংগ্রাম করা দলকে নিয়ে গেলেন মূল পর্বে। সেখানে দুর্দান্ত খেলে দলকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। সেইবার চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও পুরো বিশ্বকে আরো একবার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেনো তিনি সর্ব কালের অন্যতম সেরা।
তিনি আর কেউ নন, জিনেদিন জিদান।

ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক বার তাকে শুনতে হয়েছে যে তিনি মাঠে তেমন গতিময় না। বোর্দো তে থাকাকালীন একবার ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের ম্যানেজার ক্যানি ডানগ্লিস মালিক পক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন জিদানকে দলে নেয়ার জন্য। মালিক পক্ষ বলেছিলো, "আমাদের দলে টিম শেরউড থাকতে জিদানকে কি দরকার?"

অথচ এই প্লেয়ার টাই এক দশকের বেশি সময় পুরো বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন তার পায়ের জাদুতে। দলবদলের রেকর্ড গড়ে যোগ দিয়েছিলেন জুভেন্টাস আর রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে।

নিজ দেশের ক্লাব কান'এ ক্যারিয়ার শুরু। সেখানে ৪ মৌসুম কাটিয়ে যোগ দিয়েছিলেন বোর্দো তে। সেখানে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে নজর কাড়েন জুভেন্টাস ম্যানেজার মার্সেলো লিপ্পির। সেখানে জিতে নেন দুটি সিরি আ টাইটেল আর একবার উয়েফা সুপার কাপ।
ট্রান্সফার মার্কেটে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন ২০০১ সালে। সেখানেও জিতে নেন লীগ শিরোপা আর চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফি।

তবে পুরো বিশ্ব তাকে চিনে নেয় ১৯৯৮ বিশ্বকাপে। নিজ দেশে বিশ্বকাপ, তার উপর ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন। ২য় ম্যাচেই সরাসরি লাল কার্ড দেখে পরের ২ ম্যাচ ছিলেন বেঞ্চে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইটালিকে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে হারানো ম্যাচে ফিরলেন। সেমি ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো সেই আসরের "ডার্ক হর্স" ক্রোয়েশিয়া। সেই ম্যাচে দারুণ পারফরমেন্স ছিলো জিদানের। ২-১ গোলে জিতে ফাইনালে জায়গা করে নেয় ফ্রান্স।
ফাইনালে প্রতিপক্ষ আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। আর সেখানেই জিদান নিজের আসল জাদু দেখালেন। দুর্দান্ত ২ গোল করলেন, দুটোই হেড থেকে। ৩-০ গোলে জিতে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নিলো ফ্রান্স।

২ বছর পরের ইউরো তে সেই একই জিদান। ফ্রান্স তো চ্যাম্পিয়ন হলোই, পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ খেলে জিদান জিতে নেন টুর্নামেন্ট সেরার ট্রফি।

২০০২ বিশ্বকাপ টা ছিলো জিদানের ক্যারিয়ারের ভূলে যাওয়ার মতো অধ্যায়। ইনজুরির কারণে প্রথম দুই ম্যাচ বেঞ্চে বসে দেখতে হয়েছিলো দলের অসহায় আত্মসমর্পণ। পুরোপুরি ফিট না হয়েও দলের প্রয়োজনে মাঠে নামেন জিদান। কিন্তু বিধিবাম। সেই ম্যাচেও গোলশূন্য থেকেই শেষ হয় ফ্রান্সের বিশ্বকাপ অভিযান।

২০০৬ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ধুকতে থাকা ফ্রান্সের সেই সময়ের কোচ রেমন্ড ডমেনেখ জিদান কে অনুরোধ করেন অবসর ভেঙ্গে জাতীয় দলে ফিরে আসতে। কোচের অনুরোধে জাতীয় দলে ফিরে আসেন জিদান। তার সাথে ফিরে আসেন লিলিয়ান থুরাম আর ক্লদ ম্যাকালেলে। নিজের দেশকে নিয়ে যান বিশ্বকাপের চুড়ান্ত পর্বে।
শুরুটা অবশ্য খুব ভালো হয়নি। প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের সাথে গোল শূন্য ড্র, দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ১-১। তার উপর টানা ২ ম্যাচ হলুদ কার্ড দেখে জিদান গ্রুপের শেষ ম্যাচে ছিলেন বেঞ্চে। শেষ ম্যাচে টোগো কে ২-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ রানার আপ হয়ে পরের রাউন্ড নিশ্চিত হয় ফ্রান্সের।
নক আউট স্টেজে জিদান খোলস ছেড়ে বের হতে শুরু করেন। স্পেনের বিপক্ষে সেই ম্যাচে নিজে এক গোল করেন আর প্যাট্রিক ভিয়েরা কে এক গোল বানিয়ে দেন। ৩-১ গোলে জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হয়।
কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ ব্রাজিল। টুর্নামেন্টের টপ ফেভারিট দল, তার উপর সেই ব্রাজিল দলে ছিলো রোনাল্ডো, রোনালদিনহো, কাকা, আদ্রিয়ানো কে নিয়ে গড়া "ম্যাজিক কোয়ার্ট্রেট"। ব্রাজিল কে সেমিতে ধরে নিয়েই সবাই সেই ম্যাচ দেখতে বসে। আর সেদিনই সবাই উপভোগ করে জিদানের One of the best পারফরমেন্স। কি এক ম্যাচ খেলেছিলেন সেদিন। ম্যাচের শুরু থেকেই পুরো মাঝ মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। কখনো বডি ডজ দিয়ে মার্কার কে ছিটকে ফেলে এগিয়ে যাওয়া, কখনো ডিফেন্ডার কে বোকা বানিয়ে ফলস পাস, কখনো এরিয়াল বল বুক দিয়ে রিসিভ করে সেই বিখ্যাত ৩৬০ ডিগ্রি "রুলেট"। পুরো ম্যাচে মনে হচ্ছিলো জিদান একাই খেলেছেন আর বাকি সবাই দর্শক। শেষ পর্যন্ত তার ফ্রি কিক থেকে থিয়েরি অরির গোলে ফ্রান্সের সেমি ফাইনাল নিশ্চিত হয়।
নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত ব্রাজিল সেদিন ফ্রান্সের পোস্টে একটা মাত্র শট নিতে পেরেছিলো।
সেমি ফাইনালে জিদানের পেনাল্টি গোলে পর্তুগাল কে হারিয়ে ফাইনালে যায় ফ্রান্স।

বার্লিনের সেই ফাইনালে ইটালির বিপক্ষে ৭ মিনিটেই জিদানের পেনাল্টি তে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ১৯ মিনিটে সেই গোল শোধ করে দেয় ইটালি। ফাইনালেও দুর্দান্ত খেলেন জিদান কিন্তু ইটালির বিশ্বমানের ডিফেন্স বারবার ফ্রান্সের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিচ্ছিলো। নির্ধারিত সময় শেষে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। জিদানের বুলেট গতির এক হেড ঠেকিয়ে দেন বুফন। বলা যায় নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সেভ টা সেদিন করেছিলেন বুফন। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই সেই "ঢুস" কান্ড। মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় জিদানকে। বিশ্বকাপটাই সেদিন ফেলে দিলেন জিদান।

কোচিং ক্যারিয়ারেও জিদান সপ্রতিভ। কার্লো আনচেলত্তির সহকারী হিসাবে রিয়াল মাদ্রিদে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। তাদের হাত ধরেই ১২ বছর পর ২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতে রিয়াল।
৪ জানুয়ারি ২০১৬ তে রিয়াল মূল দলের দায়িত্ব যখন পান তখন রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থা তথৈবচ। সেই দলকে নিয়েই সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতেন। লা লিগা শেষ করেন বার্সার চেয়ে ১ পয়েন্ট কম নিয়ে। পরের মৌসুমে লা লিগা'ও জিতে নেন। সাথে টানা ২য় বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগ। ক্লাব বিশ্বকাপ, উয়েফা সুপার কাপ সহ ৮ টি ট্রফি জেতা হয়ে গেছে। কোচিং জগতের কিংবদন্তী হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।

২০০৬ বিশ্বকাপ শেষে নিজ দেশে পেয়েছিলেন বীরের মর্যাদা। তখনকার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক তাকে নিয়ে বলেছিলেন, ""The match you played last night was full of talent and professionalism. I know that you are sad and disappointed but what I want to tell you is that the whole country is extremely proud of you. You have honoured the country with your exceptional qualities and your fantastic fighting spirit, which was your strength in difficult times, but also in winning times."

বহুল প্রচলিত একটা কথা মনে হয় জিদানের ক্ষেত্রেই ভালো মানায়,
"Once a champion, always a champion"