• ক্রিকেট

এজবাস্টন ২০০৫ - "রিমেম্বার দ্যা গেইম"

পোস্টটি ২৪৭১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
কিছুক্ষণ আগেই এক ক্রিকেট মহাকাব্যের সমাপ্তি হলো। জয়ী দলের ১০ জন তখন উদযাপনে ব্যস্ত। কিন্তু ব্যতিক্রম একজন। তিনি ধীর পায়ে হেটে গেলেন পরাজিত দলের ব্যাটসম্যানের কাছে। হতাশায় পিচের উপর হাটু গেড়ে বসে থাকা খেলোয়াড়ের কাঁধে হাত রাখলেন, হাত ধরে সান্ত্বনা দিলেন, আর এর সাথেই জন্ম নিলো ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক ছবি গুলোর একটির। পরাজয়ের হতাশায় মাটিতে বসে থাকা ব্রেট লি কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন জয়ী দলের এন্ড্রু ফ্লিনটফ।
 
এটি যে ২০০৫ অ্যাশেজের এজবাস্টন টেস্টের দৃশ্য সেটা ক্রিকেট রোমান্টিক রা এতক্ষণে বুঝে গেছেন।
অস্ট্রেলিয়া তখন মহাপরাক্রমশালী দল। তার উপর ১৯৮৬ সাল থেকে অ্যাশেজ সিরিজ তাদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০০৫ এর অ্যাশেজ যে অস্ট্রেলিয়া জিতবে না সেটা নিয়ে বাজি ধরার মতো মানুষ তখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিলো।
 
সিরিজের শুরুটা দেখে মনেই হচ্ছিলো এটাও আগের অ্যাশেজ গুলোর মতোই এক ঘেয়ে হতে যাচ্ছে। ১ম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া ২৩৯ রানের বিশাল ব্যবধানে জিতে নেয়, বলা যায় ইংল্যান্ড কে একরকম গুঁড়িয়ে দেয়।
২য় টেস্ট মানে এজবাস্টন টেস্টের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়া বড় একটা হোচট খায়। আগের টেস্টে ৯ উইকেট পাওয়া গ্লেন ম্যাকগ্রা প্র্যাকটিসের সময় গোড়ালির ইনজুরিতে পড়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে পরেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত এজবাস্টনে হওয়া ১৩ টেস্টের ১২ টিতেই প্রথমে বোলিং করা দল জিতেছে। সেটা চিন্তা করেই হয়তো পন্টিং টসে জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ে পাঠান। ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে হোক কিংবা পন্টিংয়ের সিদ্ধান্ত কে ভূল প্রমাণ করতেই হোক, ইংল্যান্ড প্রথম দিনেই ৪০৭ রান তুলে নেয়। Attack is the best defense এই কথায় উজ্জীবিত হয়ে কেভিন পিটারসেন আর এন্ড্রু ফ্লিনটফ মাত্র ১৭ ওভারে ১০৩ রানের জুটি গড়েন।
 
জবাবে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শুরু হয় ম্যাথু হেইডেনের ক্যারিয়ারের প্রথম "গোল্ডেন ডাক"এ আউট হওয়া দিয়ে। পন্টিং আর ল্যাঙ্গার ইনিংস মেরামতের কাজ শুরু করলেও দলীয় ৮৮ রানে তাদের জুটি ভেঙ্গে যায়। তারপর আরো কিছু পার্টনারশিপ গড়ার চেষ্টা করলেও তাদের ইনিংস থামে ৩০৮ রানে।
 
২য় ইনিংসে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার দেখেশুনে শুরু করলেও ৩য় দিনের শুরুতেই ১২ মিনিটের মধ্যে ব্রেট লি'র তিন উইকেটে তাদের স্কোর দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ৩১। কেভিন পিটারসেন আর ইয়ান বেল প্রতিরোধ গড়লেও দলীয় ৭১ রানে পিটারসেন আর ৭৫ রানে বেল এর বিদায়ে দল আরো চাপে পরে।
 
এরপরেই দৃশ্যপটে আসেন সেই অ্যাশেজের হিরো এন্ড্র ফ্লিনটফ। লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান দের নিয়ে শুরু করেন কাউন্টার এটাক। তার মধ্যে শেষ উইকেটে সাইমন জোন্সের সাথে ৫১ রানের পার্টনারশিপ গড়েন। রিকি পন্টিং এক পর্যায়ে ৯ জন ফিল্ডারকে বাউন্ডারিতে দাঁড় করিয়ে দেন। কিন্তু ফ্লিনটফের তান্ডব তাতেও থামেনি। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন আউট হলেন দল তখন ২৮১ রানের লিড পেয়ে গেছে আর তার নামের পাশে ৭৩, যাতে ছিলো ৬ টি বাউন্ডারির সাথে ৪ টি বিশাল ওভার বাউন্ডারি। শেন ওয়ার্ন টানা ২৩ ওভার বোলিং করে নেন ৬ উইকেট।
২৮২ রান নিতে অস্ট্রেলিয়ার হাতে ছিলো আড়াই দিন। সে সময়ের অস্ট্রেলিয়া দলের এই রান একদিনেই তুলে ফেলা সম্ভব ছিলো। তাদের শুরুটা সেই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। দেখেশুনে ব্যাট করে ১২ ওভারে স্কোরবোর্ডে ৪৭ রান তুলে ফেলেন ল্যাঙ্গার-হেইডেন জুটি। তখনই ইংল্যান্ড দলের ত্রাতা হয়ে আবারো মঞ্চে এন্ড্র ফ্লিনটফ। নিজের প্রথম ওভারের ২য় বলেই দারুণ লেগ কাটারে ভেঙ্গে দেন ল্যাঙ্গারের স্ট্যাম্প। ক্রিজে আসেন রিকি পন্টিং। ওভারের ৩য় বলে লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন আম্পায়ার নাকচ করে দেন। পরের বল পন্টিংয়ের ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ ফিল্ডারের সামনে পড়ে। পঞ্চম বলে আবারো লেগ বিফোরের আবেদন। ততক্ষণে পুরো গ্যালারী উন্মাতাল। ষষ্ঠ বল পন্টিং ছেড়ে দেন আর সেটা হয় 'নো' বল। সপ্তম বলে ফ্লিনটফ আবারো করলেন লেগ কাটার। বল পন্টিংয়ের ব্যাট ছুঁয়ে উইকেট কিপারের গ্লাভসে। পন্টিং হয়তো এখনো ভাবেন ষষ্ঠ বল টা 'নো' না হলেও তো পারতো। আর ফ্লিনটফ জন্ম দিলেন সেই অ্যাশেজ তথা ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ওভার। বলা যায় এই একটি ওভার সেই টেস্ট তো বটেই পুরো সিরিজের মোমেন্টাম পাল্টে দেয়।
 
৪৭/০ থেকে ৪৮/২, ইংল্যান্ডের বোলার রা তখন অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরেছে। হেইডেন, মার্টিন, ক্লার্কের ছোট ছোট ইনিংস গুলো কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে শুরু করলেও সেগুলো যথেষ্ট ছিলো না। হেইডেন পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছিলেন কিন্তু দলীয় ৮৩ রানে তার বিদায়ে আবারো ছন্দপতন। মার্টিন, ক্যাটিচ আর গিলক্রিস্ট যখন প্যাভিলিয়নে ফেরেন, দলের রান ১৩৬/৬। মাইকেল ক্লার্ক তখনো ক্রিজে। গিলেস্পি নাইটওয়াচম্যান হিসাবে নামলেও টিকতে পারলেন মাত্র ২ বল। দিনের শেষ টা ক্লার্ক আর ওয়ার্ন মিলে ভালো ভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে জাইলসের এক ওভারে ওয়ার্ন নিলেন ১২ রান। ক্লার্কও স্বচ্ছন্দে খেলছিলেন। কিন্তু সেদিন ইংল্যান্ডের বোলাররা মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ৩য় দিন শেষ হওয়ার কয়েক বল আগে হার্মিসনের দুর্দান্ত এক স্লোয়ারে ক্লার্কের স্ট্যাম্প ভেঙ্গে গেলো।
 
৪র্থ দিনের শুরুতে ইংল্যান্ডের দরকার ২ উইকেট আর অস্ট্রেলিয়ার ১০৭ রান। অস্ট্রেলিয়া দলের পাঁড় ভক্তও মনে হয় সেদিন তাদের শোচনীয় পরাজয় ভেবে রেখেছিলেন। কিন্ত ক্রিজে থাকা ওয়ার্ন আর ব্রেট লি'র মাথায় তখন অন্য চিন্তা। "হারার আগে হারবো না" এই মানসিকতা তাদের বিশ্বের সেরা দল বানিয়েছে, তারা কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিবেন। শুরু হলো প্রতিরোধ। ইংল্যান্ডের আগুনঝড়া বোলিং এর সামনে বুক পেতে দু'জন মিলে তুলে নিলেন ৪৫ রান।
 
কিন্তু বিধাতা সেদিন ইংল্যান্ডের পক্ষে ছিলেন। নাহলে পুরো ইনিংসে একটাও সুযোগ না দেয়া ওয়ার্ন কেনো হিট উইকেট হয়ে আউট হবেন। তার বিদায়ে স্কোর তখন ২২০/৯। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৬২ রান। শেষ ব্যাটসম্যান ক্যাসপ্রোভিচ সেদিন সত্যিকারের ব্যাটসম্যান হয়ে গেলেন। ব্রেট লি কে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছিলেন। কোন ঝুঁকি না নিয়ে সিংগেল আর ডাবলস নিয়ে জয়ের কাছাকাছি যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে জয়ের জন্য যখন ১৫ রান দরকার, সাইমন জোন্স ছাড়লেন ক্যাসপ্রোভিচের ক্যাচ। ইংল্যান্ডের বোলাররা তখন লাগাতার শর্ট বল করেছিলেন। জয়ের জন্য ৪ রান দূরে থাকতে হার্মিসনের করা ইয়র্কার থেকে লি নিলেন এক রান। ক্যাসপ্রোভিচ সেদিন ফ্লিনটফ, হার্মিসন, জোন্স দের ভালোই সামলাচ্ছিলেন। লি হয়তো ভেবেছিলেন বাকি ৩ টা রানও স্বচ্ছন্দে নিয়ে নিবেন। পরের বলটা হার্মিসন করলেন শর্ট। ক্যাসপ্রোভিচ সেটা ঠেকাতে গেলেন কিন্তু বল তার গ্লাভসে লেগে চলে গেলো উইকেট কিপারের কাছে। দুর্দান্ত এক ডাইভে বলকে গ্লাভস বন্দি করলেন জেরাইন্ট জোন্স। এর সাথেই শেষ হলো (কিংবা জন্ম হলো) ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ম্যাচের। হতাশায় মাটিতে বসে পরা ব্রেট লি কে সমবেদনা জানাতে এলেন জয়ের নায়ক এন্ড্রু ফ্লিনটফ।
 
ক্রিকেট বোদ্ধা দের মতে সেই টেস্ট ম্যাচ আসলে টেস্ট ক্রিকেট কেই বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। এই এক ম্যাচ ইংল্যান্ডের ক্রিকেট এর গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো। পরবর্তী ৮ টি অ্যাশেজের ৪ টিই ইংল্যান্ড জিতে নেয়।
এজবাস্টনের ঐ টেস্ট টি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম টেস্ট তো বটেই, টেস্ট টি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ফ্লিনটফ আর ব্রেট লি'র সেই অমর ছবিটির জন্য।