প্রথম সে জয়ের ক্ষণে...
পোস্টটি ১৩৫৭৭ বার পঠিত হয়েছেএখনো স্পষ্ট মনে আছে সে দিনটার কথা। চতুর্থ দিনের পড়ন্ত বিকেলে জিম্বাবুয়ের ৩ উইকেটের পতনে প্রায় নিশ্চিত করে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ের সাথে এই টেস্টটা আমরা অন্তত হারছিনা। ড্র অথবা জয়, এই ছিল পঞ্চম দিনের সম্ভাব্য ফলাফল। তবে মুলতানের সেই 'এত কাছে তবু এত দূরে' স্মৃতিটা তখনো ছিল বেশ সতেজ। মুলতানেও চতুর্থ দিনের গোধুলী বেলায় পাকিস্তানের একের পর এক উইকেট পতন আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল সেই কাঙ্খিত জয়ের পথে। পরদিন আমাদের আর প্রথম টেস্ট জয়ের মাঝে ব্যবধান হয়ে ছিলেন ইনজামাম-উল-হক। তবে আমাদের চিন্তা-চেতনায় তখন কেবলই ছিল জয়।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া সেই দিনটা ক্রমশই আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। একটা ভাল বল, একটা উইকেট আর আমাদের প্রথম টেস্ট জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে গেলেন সেই ইনজামাম। খেললেন অতিমানবীয় এক ইনিংস আর মুঠো থেকে কেড়ে নিয়ে গেলেন আমাদের প্রথম টেস্ট জয়টিও। আকাশপানে ভাবনার জগত খুঁজে বেড়াচ্ছিল শুন্যতার বিশালতা যা এক নিমিষেই হারিয়ে গেল। অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন দল নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
তখনও যে 'আমরা টেস্ট জিতেছি' এই বাক্যটা অধরাই হয়ে ছিল আমাদের কাছে। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর থেকেই চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ বড্ড ক্লান্ত করে তুলছিল। সাবেক ক্রিকেটার, ইতিহাসবিদরা কদিন পরপরই হিসেব কষে দেখিয়ে দিতেন কোন দেশের কত সময় লেগেছিল প্রথম টেস্ট জয়ে। নিয়মিতই প্রশ্ন উঠতো আমাদের সামর্থ্য নিয়ে। অস্ফুট স্বরে ভেতর থেকে ভেসে আসতো নিরব অসহায়ত্ব। আমরা কি টেস্ট জিততে পারবোনা? আমরা কেন টেস্ট জিততে পারিনা? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা ছিলনা। তবে বিশ্বাসটা ছিল, ক্রিকেটের প্রাচীনতম এই ফরম্যাটেও আমরা একবার পাঁচদিন ধরে প্রতিপক্ষকে শাসন করে তুলে নিব জয়।
চট্রগামে তাই আরেকটি পঞ্চম দিনের প্রাক্কালে বারবার ফিরে আসছিলো সেই মুলতান বিরহগাথা। তবুও আমরা স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলাম। তবুও আমরা আশায় বুক বেধেছিলাম। মন্ত্র যপছিলাম একটিই, “আমরা করব জয়”
৩ উইকেটে ৪৬ রান দিয়ে পঞ্চম দিন শুরু করা জিম্বাবুয়েকে সুন্দর সুচনা এনে দেন ব্রেন্ডন টেইলর ও হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। ওদিকে অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের চিন্তার কপালে ক্রমশ ভাঁজ বাড়ছিলো। লাঞ্চের আগে আক্রমণে নিয়ে আসলেন প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য থাকা তরুণ স্পিনার এনামুল হক জুনিয়রকে। কে জানতো তিনিই হয়ে উঠবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক জয়ের মুল কারিগর?
প্রথমে তুলে নিলেন টেইলরের উইকেট। তবে একটু পরই জিম্বাবুয়েকে বড় ধাক্কাটা দেন টাটেন্ডা টাইবুকে আফতাব আহমেদের ক্যাচ বানিয়ে। পুরো সিরিজেই এই টাইবুই ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হুমকি।
ততক্ষণে জয়োৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে প্রতিটি রাস্তায়। নিয়ম ভেঙে ছুটিরঘণ্টা বেজে গেলো। স্কুলের গেট পেরিয়েই যে যে যার যার মত ছুটে গেলাম টিভির সামনে। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হবে যে! আমরা যে আজ টেস্ট জয় করবো!
খানিক বাদেই মাসাকাদজাকে ফিরিয়ে জয়ের সুবাস যেন আরো ছড়িয়ে দিলেন এনানুল। অপর প্রান্তে মাশরাফির শিকারে পরিণত হলেন জিম্বাবুয়ের শেষ বাধা এলটন চিগাম্বুরা। এরপর দ্রুতই পতন ঘটে আরো দুটি উইকেটের। অপেক্ষা তখন আর মাত্র একটি উইকেটের। প্রতিটি বলেই জয়োল্লাসের জন্য প্রস্তুত গোটা দেশ। মুলতান ট্র্যাজেডির দলে থাকা বাশার, রফিক, মাশরাফিরা কি তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে করছিলেন সেই একটি উইকেটের জন্য সেদিনের অপেক্ষা? না হওয়ারই কথা। চট্রলার মাটিতে সেদিন তো তাদের হাতে ইতিহাস রচিত হওয়ার দিন। সেই বিশ্বাসটা ছড়িয়ে পড়েছিল গ্যালারিতে উপস্থিত দর্শকদের মাঝেও। জিম্বাবুয়ের নবম উইকেট পতনের পর ক্যামেরার দৃষ্টি কেড়ে নিল একটি প্ল্যাকার্ড। যাতে লেখা ছিল, "We Want To Win Test"
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এনামুল হকের বলটি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন ক্রিস্টোফার এমপফু। কিন্তু বলটি সোজা চলে গেল শর্টে দাঁড়ানো মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে। ক্যাচটি মুঠোবন্দী করেই এক হাত তুলে ভোঁ দৌড় দিলেন তিনি। যেন চিৎকার করে বলছেন, "দেখে নাও বিশ্ব, আমরাও টেস্ট জিতেছি"।
মাঠে, মাঠের বাইরে খেলোয়াড় দর্শকদের বাঁধভাঙা উল্লাস মিলেমিশে একাকার। স্মারক স্টাম্প নিতে যেন সবাই নিতে ছুটলেন। খালেদ মাসুদ, নাফিস ইকবাল, মাশরাফি, জাভেদ ওমররা তাতে সবার আগে হাত ছোঁয়ালেন। রাজিন সালেহরা ডিগবাজী খাচ্ছেন একের পর একেক। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বাইরে মানুষের মিছিল জমতে শুরু করেছে, 'বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, ক্রিকেট, ক্রিকেট।'
ওদিকে ড্রেসিংরুমে একজন মানুষ ফটোগ্রাফারকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন দুর্লভ মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দী করার। আবার পরক্ষনেই করতালি দিচ্ছেন। কে সেই ব্যাক্তি? কাঁচাপাকা গোফের রাশভারী সেই মানুষটি আর কেউ নন। তিনি ডেভ হোয়াটমোর। যার হাত ধরে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আমরা পেয়েছিলাম প্রথম ওয়ানডে জয়। তবে প্রথম টেস্ট জয় তো সবকিছু ছাপিয়ে। বাংলাদেশী আবেগ নেই বলেই হয়ত সেদিন তার চোখে ছিলোনা কোন আনন্দাশ্রু। তবে প্রিয় শিষ্যদের অর্জনে তার চেয়ে গর্বিত বোধহয় আর কেউ ছিলেন না। খেলোয়াড়দের আপন সন্তানের মত স্নেহ করা এই মানুষটাই তো তাদের মাঝে বুনে দিয়েছিলেন আত্নবিশ্বাসের বীজ।
দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটশিকারী এনানুল হক জুনিয়র ম্যাচসেরা নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশের সেই জয়ে দলগতভাবে অবদান ছিলো সবারই। 'মি: ফিফটি' খ্যাত হাবিবুল বাশার দুই ইনিংসেই করেছিলেন অর্ধশত রান। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ করেছিল টেস্টে ততকালীন সেরা সংগ্রহ ৪৮৮ রান। যাতে অবদান ছিল নাফিস ইকবাল, রাজিন সালেহ'র তিনটি অর্ধশতকের। আরো ছিল খালেদ মাসুদ এবং মাশরাফির দুটি চল্লিশোর্ধ রানের দুটি ইনিংসেরও। বল হাতে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশকে বড় লিড এনে দিতে সাহায্য করেছিল রফিকের পাঁচ উইকেট। আবার চতুর্থ দিন বিকেলে ২ রানে ২ উইকেট তুলে নিয়ে জিম্বাবুয়েকে শুরুতেই চাপে ফেলে দিয়েছিলেন তাপশ কুমার বৈশ্য।
পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে খেলোয়াড়রা পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করলেন। জাতীয় পতাকা হাতে তাতে নেতৃত্ব দিলেন হাবিবুল বাশার। গ্যালারি থেকে ভেসে আসছে গগনবিদারী চিৎকার, 'বাংলাদেশ, বাংলাদেশ'। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতেই খেয়াল করলাম পাশে বসা এক বড় ভাই চোখ মুছে নিচ্ছিলেন আড়ালে। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন তারও ছিল যা শেষ হয়েছিল এক সড়ক দুর্ঘটনায়। একটি টেস্ট জয় হয়ত সেদিন তার সেই কষ্টটা ভুলিয়ে দিয়েছিল ক্ষনিকের জন্য।
আচ্ছা, সেই মুহূর্তে কেমন লেগেছিল সেই ভক্তটির যিনি প্ল্যাকার্ডে কিছু শব্দে একেছিলেন পুরো একটি জাতির ব্যাকুলতা? তিনিও কি ডেভ হোয়াটমোরের মত করে শুধুই করতালি দিচ্ছিলেন? নাকি স্বদেশীয় আবেগে অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলেন? কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে যায়। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায়না। কল্পনার রাজ্যে চড়ে আমরা দিব্যি সেখানে দেখতে পাই ভালোবাসার মুহূর্তগুলো।
- 0 মন্তব্য