ভালোবাসার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
পোস্টটি ১৫৬৫৮ বার পঠিত হয়েছেপ্রিয় রিয়াদ ভাই
বাংলাদেশ দলে আপনার যখন সূচনা, আমি তখন কলেজ পড়ুয়া, সদ্য কৈশোর পেরিয়েছি। “বেশ বড় হয়ে যাওয়ায়” কলেজ ফাঁকি দিয়ে আমার নিয়মিত মাঠে যাওয়াটাও তখনই শুরু।
আপনি শুরু করেছিলেন শ্রীলংকায়। টিভিতে দেখেছিলাম। আপনার – আমার একই নাম হওয়ায় ১৭ বছরের আমার বেশ উত্তেজনা লাগছিলো, বৃথা যায়নি। খুব আহামরি বড় ইনিংস খেলেন নি। কিন্তু মনে গেঁথে গিয়েছিলো যতক্ষন উইকেটে ছিলেন। বল হাতেও গোটা দুই উইকেট নিয়ে নিয়েছিলেন।
এরপর, থিতু হয়ে গেলেন দলে।
মিথ্যে বলবো না, ব্যাটিং এর নাড়িনক্ষত্র বোঝার মতো বয়স তখনো আমার হয়নি। এমনি নামের মিলের জন্য আলাদা একটা টান অনুভব করতাম। তার উপর নামতেন শেষের দিকটায়। প্রায় প্রতি ইনিংসে টেলএন্ডারদের নিয়ে সংগ্রামটা যতটুক না দলের কাজে দিতো, তারচেয়ে বেশি হতো নিজের মধ্যে। একটা মায়া, আপনার জন্য একটা খারাপ লাগা। জয় পরাজয় সেখানে দূরে থেকে যেত, মুখ্য হয়ে যেত আপনার একাকী যুদ্ধটা।
ভালোবাসার শুরুটাও সেসময়।
তবে সবময় পাদপ্রদীপ থেকে দূরে থাকায় গঞ্জনা আপনাকে কম সইতে হয়নি। চেষ্টাটুকু মানুষের চোখে অধরাই থেকে যায়। সংগ্রামটুকুর মূল্য দেয় না অনেকেই। কিন্তু এক – দুই ম্যাচ খারাপ করলে ছেড়ে দিতো না তারা কখনো। আর আমি, একে তো নামের মিলের জন্য একটা মায়া কাজ করতো, তার উপর আপনার চেষ্টা, সংগ্রামটা হৃদয়ের কোথায় যেন আলাদা ভালোবাসা তৈরী করে রেখেছিলো, তারও উপর, ততদিনে আমি দৌড়া বাঘ আইলোর একজন সদস্য। ব্যানারটা দেখেছেন মাঠে আপনি নিশ্চয়ই। কম দিন তো হয়নি, কোন ম্যাচ বাদও দেয়নি দৌড়া বাঘ আইলো। অন্ধভক্ত হবার সুবাদে যেকোন প্লেয়ারকে নিয়ে বাজে কথা হচ্ছে দেখলেই ঝাপিয়ে পড়তাম। আপনার বেলায় তো আরো বেশি। ওই যে, আগেই বললাম কেন।
দেশের মাটিতে যেবার বিশ্বকাপ হলো, ৫৮ রানে অলআউট হবার পরও জয়ের তীব্র বিশ্বাস নিয়ে গিয়েছিলাম চিটাগাং। ছুটেই গিয়েছিলো তারপরও ম্যাচটা। ৮ উইকেট নেই। উইকেটে আপনি – শফিউল। ফ্যান ক্লাবের বাকি সদস্যদের থেকে সরে পশ্চিম গ্যালারীর পিছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস কি নড়ে গিয়েছিলো একটু? আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
সেদিন, দৌড়া বাঘ আইলোর প্রত্যেকে জয়ের পর কেঁদেছে। বিশ্বাস করুন। প্রত্যেকে। কোনো উদপযাপন না, কোনো আনন্দ না। শুধু কেঁদেছে। রিয়াদ ভাই, আপনি আমাদের কাঁদিয়েছেন। আপনি আমাকে কাঁদিয়েছেন। এই ঋণ কিভাবে আপনাকে শোধ করবো, আমি জানি না। আমি আপনাকে ভালোবাসি রিয়াদ ভাই। অনেক ভালোবাসি।
২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালেও, ট্র্যাজিক হিরো হয়ে থাকলেন আপনি। আমার চোখে আমার রিয়াদ ভাই আরো উচ্চতার শিখরে পৌছে গেলো। সেবছর, বা তারপরের বছর, ঠিক খেয়াল নেই, আপনি একবার বাদ পড়লেন। দল হারলো টানা কিছু ম্যাচ। আমি কার পোস্টে যেন লিখেছিলাম, ‘আই ওয়ান্ট রিয়াদ ভাই ব্যাক ইন মাই টিম’। বন্ধু একজন মজা করে বলে আমি নিজেকে চাচ্ছি কিনা দলে। আমি আপনার সেই ইংল্যান্ড বধের পর জার্সিতে বিসিবির লোগো দেখানোর যুদ্ধংদেহী ছবিটি দিয়ে বলি, ‘আই ওয়ান্ট দিস রিয়াদ ব্যাক ইন মাই টিম’। যোদ্ধারা বেশিদিন বাইরে থাকে না। আবার চলে এলেন।
ব্যক্তিগত একটা কথা বলি এবার রিয়াদ ভাই। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ ভোর ৫টায় আপনি আমাকে দূর থেকে একবার ডেকেছিলেন বিমানবন্দরের লাউঞ্জে, মনে পড়ে ভাই? হ্যা, আমিই সেই রিয়াদ। আপনাকে খুব ভালোবাসি বলেই হয়তো আল্লাহ এই সুযোগটা দিয়েছিলেন আমাকে। হজ্বে আমার রুমমেট ছিলেন প্রিয় ওবায়েদউল্লাহ কাকা। আপনি আমার কথা শুনেছেন উনার মুখে, বিমানবন্দরে ডেকেছিলেনও দূর থেকে। ধন্যবাদ রিয়াদ ভাই। সারাজীবন মনে গেঁথে রাখার মুহুর্ত ছিলো সেটি।
২০১৫ বিশ্বকাপে উপরে ব্যাট করার সুযোগ পেলেন, নিজেকে প্রমান করলেন। আমি তখন খুব বকবক করি। ভালো খেলেন আপনি, আর আমি মানুষকে বলি, দ্যাখ, এবার বল কি বলবি। পরিচিত মহলে সবাইই তো জানে আমার দ্বিতীয় প্রিয় খেলোয়াড় আপনি (প্রথমজনের নাম নিশ্চয়ই বলতে হবে না, তিনি তো আপনারও গুরু)। ভালো খেলেন আপনি, মুখ ফাটাই আমি। আপনার গর্ব যেন তখন আমার নিজের গর্ব। এরপর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে, নিউজিল্যান্ড এর সাথে ৩৩ রানে ৪ উইকেট চলে গেলো। একবারের জন্যও বিশ্বাস হারাইনি। রিয়াদ ভাই, কতটা ভালোবাসি জানেন আপনি?
আপনার একাকী যুদ্ধের জন্য আপনাকে ভালোবাসি। আপনার সংগ্রামের জন্য ভালোবাসি। শেষ ম্যাচে আপনি কেঁদেছেন, মাঠ থেকে সেটা দেখতে পাইনি তবে একেকটা উইকেট যায় আর আপনি উইকেটে হাটু গেড়ে বসে পড়েন, সেটা দেখেছি ইস্ট গ্যালারী থেকে। কান্নার ছবিটাও পরে দেখেছি। অন্যদের নায়ক হবার দিনে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আপনি লড়ে যান। আপনার নায়ক হবার দিনে কেউ থাকে না। আমাদের নীরব একাকী যোদ্ধা একাই লড়ে যান। না পারার বেদনায় কাঁদেন। প্রতিটা চোখের ফোঁটার জন্য ভালোবাসি আপনাকে রিয়াদ ভাই। অনেক বেশি ভালোবাসি।
যাক। লিখতে থাকলে শুধু লিখতেই থাকবো, এই রচনা আর ফুরাবে না। শেষ করি বরং।
সাকিবের অনুপস্থিতিতে অধিনায়ক হয়েছেন দুই টেস্টের জন্য। সত্যি বলি, এভাবে অধিনায়ক হোন কখনো চাইনি। সাকিব তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন, এই প্রার্থনা করি। তবে প্রথমবারের মতো যখন সহ-অধিনায়ক হয়েছিলেন ২০১১ সালে, চেয়েছিলাম টেস্টের অধিনায়ক আপনি হোন! ঢাকা মেট্রোর অধিনায়কত্ব করতেন তখন খুব সম্ভবত। পেপারে পড়তাম। এবারো চেয়েছিলাম টি-২০ এর অধিনায়কত্ব আপনার থাকুক! যাক, এগুলা সম্পুর্ন ব্যক্তিগত মত। ভাগ্যের খেল দেখেছেন রিয়াদ ভাই? যেই হাথুরুসিংহের আমলে শ্রীলংকার সাথে টেস্ট দল থেকে আপনাকে বাদ দিলো, সেই শ্রীলংকার বিপক্ষেই আপনি ১১ জনের নেতৃত্ব দিয়ে নামবেন মাঠে। ভাগ্য কখনো বঞ্চিত করে না রিয়াদ ভাই। যা কিছু থেকে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত হয় কেউ, একদিন না একদিন ফেরত পাবেই। নাহলে মাশরাফি ভাইকে ইঞ্জুরির আখ্যায় বাদ দিয়েছিলো যে বিশ্বকাপের দল থেকে, পরের বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বেই কি আমরা সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাইনি?
অনেক শুভকামনা আপনার জন্য রিয়াদ ভাই। অনেক ভালোবাসা ও শুভ কামনা। দলের জন্য, আমাদের জন্য, আপনাকে অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন।
রিয়াদ আহমেদ
উপদেষ্টা
দৌড়া বাঘ আইলো
- 0 মন্তব্য