• ক্রিকেট

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল: কৃতজ্ঞতা ও সতর্কতা

পোস্টটি ৭২১৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ধন্যবাদ, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

১৮ বল ৪৩ রান, নট আউট। এমন স্নায়ুতাড়িত পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে যেভাবে ম্যাচ বের করে নিয়ে এসেছেন তা নিয়ে অনবদ্য রোমাঞ্চকর গল্প লেখা যায়, হতে পারে ক্রিকেটীয় এক উপাখ্যান। চার বলে ১২ রান, ইনিংসের শেষ ওভার, না জিতলে ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়া তথা দেশে ফেরা। তার উপর আগের দুই বলে আম্পায়ার কর্তৃক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, রান আউট, ক্যাপ্টেন বা টিমের সবার আবেগী হাকডাক। আপনি তারপরও ছিলেন, হাতে যেন ব্যাট নয় আশার মশাল নিয়ে। আপনি জানতেন এই মশালের জ্বালানীটুকু আপনাকেই সরবরাহ করতে হবে। উদানার ৫ম বল যখন আপনার ব্যাট স্পর্শ করে গ্যালারিতে গিয়ে আছড়ে পড়লো ততক্ষনে আপনি লিখে ফেললেন এক মহাকাব্য। পুরো দেশকে ভাসালেন উদ্বেলিত আনন্দে।

কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এমন মাহমুদউল্লাহ একবারে তৈরি হয় না। এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের সাথে ২ রানের হার। রিয়াদ তখনও ক্রিজে ছিলেন, আমরা বলেছি আপনি আমাদের ডুবালেন। ভারতের সাথে টি২০ বিশ্বকাপের শেষ ওভারে ৩ বলে ২ রান আপনি-ই নিতে পারেন নি। অথবা পরপর দুই ম্যাচ সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপের কোয়ারর্টার ফাইনালে যখন আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেই ম্যাচ আমরা জিতি নি। রিয়াদের মারা বলে শেখর ধাওয়ানের ক্যাচ বাউন্ডারী লাইন ছুয়েও আমরা সিক্স পাইনি। এই অভিজ্ঞতাগুলোই আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। রিয়াদ প্রতিটি দিন শিখে শিখে কাল প্রেমাদাসায় পূর্ন রূপে আর্বিভূত হয়েছেন। দ্বিতীয় বলে নো না দেয়ায় রিয়াদ প্রতিবাদ করেছেন। মাঠের আম্পায়ারদের সাথে যুক্তি তুলে ধরেছেন, মেনে না নেয়ার দৃঢ়তা দেখিছেন। কিন্তু মাঠ ছাড়েন নি। এটিই ম্যাচ্যুরিটি, কারন জিততে হলে খেলেই জিততে হয়। জবাব মুখে নয়, ব্যাটেই দিতে হয়। আপনাকে স্যাল্যূট সাইলেন্ট কিলার, মিঃ কুল। আমরা এমনই বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ক্রিকেট খেলতে চাই, সারা বিশ্বকে দেখাতে চাই যে, জিততে যাওয়া ম্যাচগুলো হারতে হারতে এখন আমরা হারতে যাওয়া ম্যাচগুলো বের করে আনতে শিখেছি। আমাদের অবজ্ঞা করে যদি 'ভারত বনাম শ্রীলংকা ফাইনাল' লেখা পাশ বিলি কর, তবে তা আবার ছাপাতে হবে।

ধন্যবাদ, তামিম ইকবাল।

আপনি  শুরুর দিকে না খেললে ম্যাচ আমরা জিতি না, সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য সার্বজনীন সত্য হয়ে গেছে। কালকে ৫০ রানের ইনিংস এই জন্য সমান দরকারি ছিল। কিন্তু আমার চোখ জুড়ে আছে আপনার অন্য কিছু ছবি, আমি প্রান ভরে দেখেছি। সাকিব যখন ফোর্থ আম্পায়ারের সাথে বিতর্ক করছে, হাতের ইশারায় রিয়াদ-রুবেলকে ডাকছে অনেকে হয়তো মিস করেছে কিন্তু আমি আপনার হাতের ইশারাও দেখেছি। আপনি রিয়াদকে বলছেন মাঠে থাকতে। যখন পুরো টিম আবেগের উত্তেজনায় ভাসছে, তখন আপনার মত দু’একজনকে এমন ভূমিকায় আসতে হয়। খেলা শেষের পর রাগান্বিত কুশাল মেন্ডিসকে যে বুক পেতে আগলে রইলেন। সেই বুক বাংলাদেশের জমিন হয়ে রইলো। আমরা সারা বিশ্বের কাছে এমন বাংলাদেশকেই পরিচয় করিয়ে দিতে চাই যেখানে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের জন্য বুক ভরা ভালোবাসা থাকবে। মাঠের প্রতিযোগীতা, খেলোয়াড়ের পরিনিতবোধ এবং জেতার জন্য আকুলতা থাকবে, থাকবে বাঘের গর্জন। কিন্তু খেলা শেষে আপনার মত বিশাল বক্ষ বাড়িয়ে দেবার মানসিকতাও থাকবে। আপনার ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলার ছবি দেখে অসংখ্য নবীন বাংলাদেশি শিখবে। আশা করি সোহানও শিখবে যে আঙ্গুল থাকলেই তাক করাতে হয় না। আমরা এমন উদ্ধত বাংলাদেশ ক্রিকেটার চাই না। আমরা আপনার মত একজনকে চাই।

ধন্যবাদ, সাকিব আল হাসান।  

“I need to remain calm next time.”  ধন্যবাদ সাকিব ম্যাচ শেষের সহজ স্বীকারোক্তির জন্য। আপনি বলেছেন আমরা সবাই মানুষ, কেউ আবেগের উর্ধে নয়। ম্যাচের ওই মুহূর্ত মাঠের মধ্যেই থাকবে বলে আপনার বিশ্বাস। একজন জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে আরো পরিনত আচরণ করার প্রয়োজনীয়তা আপনি অনুভব করছেন, সেইটাই মূলকথা। কিন্তু আমরা সাধারন দর্শক এইটা বুঝি না। আমরা ‘সরি’ বলাকে প্রোমোট করি না। জানি না কি এক অবাক কারনে আমরা শুধু আপনার আবেগী উন্মাদনাকে প্রচার করি। দিনশেষে সারা বিশ্বকে আমরা নিজের অজান্তেই উদ্ধত হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেই। একজন সাকিব-আল-হাসান দলে আসা মানে যে কি রকম প্রানশক্তির সঞ্চার হওয়া আমরা তা কালকে দেখেছি। পুরো একটি দলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আপনি পরিবর্তন করতে পারেন। এমন ইন্জুরি ছেড়ে মাত্র একদিন প্রাক্টিস করে মাঠে নেমে পড়েছেন, চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারতেন। অথচ এইতো সেই দিন আপনি নাকি নিজের জন্য টেস্ট থেকে বিশ্রাম নিয়েছেন বলে রব উঠেছিল! আপনার মত স্বার্থ দেখা খেলোয়াড় নাকি আর টিমে নেই! আপনি এসেছেন, ম্যাচের প্রথম ওভারেই বল হাতে তুলে নিয়েছেন। ম্যাচের চরম মুহুর্তে টিমকে ডেকে পাঠানোর গাটস যেমন আছে তেমনি ম্যাচ শেষে নিজের ভুল মেনে নেবার সৎ সাহসও আপনার আছে। আপনার এই টেম্পেরামেন্টই হয়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশের ছবি। আপনি আসলেন, দেখলেন আর জয় করলেন।

 

এবার আসুন সতর্ক হই।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন প্রতিটি অসামান্য জয় পায় আমি প্রতিবার ভীষণ ভয়ে থাকি, আমরা কি এই জয়ের আনন্দ উদযাপন করতে পারবো! আমাদের উল্লাস কি আক্রমনে রূপ নেবে না! আমার এই ভয় নিতান্ত অমূলক নয়। খেলা শেষে যখন সামাজিক মিডিয়াগুলোতে তাকাই আমাদের অনেকেরই কুৎসিত রূপ বেরিয়ে আসে। কিছু মানসিক বিকারগ্রস্থ বাংলাদেশী নাম নিয়ে অনলাইনে প্রতিপক্ষ সমর্থকদের আক্রমন করে বেড়ায়। শত শত অসুস্থ ট্রল-লেখা, বিরক্তিকর ছবি টাইমলাইনে ভাসতে থাকে। আমাদের দল যখন ধীরে ধীরে শিক্ষিত হচ্ছে, দক্ষ হচ্ছে তখন আমরা দর্শক হিসেবে ততই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি। এই সমস্যা অবশ্য পুরো উপমহাদেশ জুড়েই, কিন্তু তারা অধম বলেই তো আমাদের উত্তম হবার দরকার। “নোয়াখালি বিভাগ চাই” লিখে নিজেকে হিউমারাস প্রমান করা যে কতটা আহাম্মকি আমরা বুঝি না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পেজে গিয়ে হার না মানা উদ্ভট কমেন্ট করে দেশের নাম ডুবানোর যে কোন যৌক্তিকতা যে নেই সেইটা আমরা শিখি না। সাকিবের এগ্রেশনকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে আমরা লিখে ফেলি, ম্যাচ শেষে ভুল স্বীকার করাটা নাকি বোকামি হয়েছে! নুরুল হাসানের থিসারার প্রতি দেখানো আঙ্গুল নাকি আমাদের বীরত্বের প্রতীক! আমরা বুঝতে পারি না যে পুরো দলের সাথে যখন দলের ম্যানেজার মাঠের মাঝখানে গিয়ে ‘নাগিন ড্যান্স’ দেয় সেইটা কত লেইম দেখায়। আমরা সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি করে ফেলি। মাঠে আম্পায়ারের সাথে মাহামুদউল্লাহর  যু্ক্তি তর্ক যে আমাদের অনেক বড় প্রটেস্ট সেটা না বুঝে আমরা মাঠ থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই। বাস্তব জীবনে অফিসিয়াল মিটিংয়ে বসে কোন কিছু নিয়ে বিতর্ক করা আর রাগ হয়ে সেই মিটিং থেকে বের হয়ে আসা যে এক নয় সেইটা বুঝতে হবে। দশ বছর ক্রিকেট খেলা, বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসানের মত এটিচ্যুড দেখাতে যাবার আগে সোহানকে বুঝতে হবে তার গ্রহনযোগ্যতা বা আঙ্গুল তাক করানো কতটুকু শোভন। যেখানে থিসারা পেরেরা অপর দলের ক্যাপ্টেন, একজন সিনিয়র খেলোয়াড়। আমাদের সাকিব-তামিমের সাথে একই আচরন করলে কেমন লাগতো, সেই অনুভুতিটুকু তাদেরও আছে!

আমাদের সীমারেখা টানতে হবে, এখনই সময়। আপনি-আমি যে নাগিন ড্যান্স ঢাক ঢোল বাজিয়ে দিতে পারি, টিএসসি মাতাতে পারি। পাড়ায় পাড়ায় পটকা ফুটাতে পারি। সেই একই কাজ বাংলাদেশ জাতীয় দলের ম্যানেজার মাঠে ঢুকে করতে পারেন না। যতই আমাদের মত রক্ত মাংসের মানুষ তিনি হোন না কেন, আমাদের মত দেশপ্রেম-আবেগ থাকুক না কেন। প্রোটোকল বলে জিনিস টা মেনে চলতে হবে। আমি এমন আশংকায় থাকতে চাই না যেখান ড্রেসিংরুমের কাঁচ ভঙ্গার অপরাধে কোন প্রতিভাবান ক্রিকেটার নিষিদ্ধ হন। আমরা তো ক্রিকেট খেলতে গিয়েছি, মাস্তানি করতে নয়। আমাদের খেলোয়াড়-দর্শক সবারই ভিতর সীমাহীন আবেগকে কাজে লাগেতে হবে, নতুন এক বাংলাদেশ ক্রিকেট ব্র্যান্ড তৈরির জন্য। ফেইসবুক টুইটারে আমরা যে ট্রল আজ শুরু করেছি, সেই ট্রল কিন্তু ফিরে আসবে অতি সত্তর। তখন কি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মত মাথা ঠান্ডা রাখতে পারবো? অন্য দলের কোন সমর্থক যখন তেড়ে ফুড়ে আসবে কমেন্টের গোলা নিয়ে তখন কি আমরা তামিমের মত তাকে শান্ত করতে পারবো? অথবা আমাদের আচরণে যদি কেউ কষ্ট পায়, সাকিব আল হাসানের মত কি বলতো পারবো, আই নিড টু বি কাম নেক্সট টাইম?