• ফুটবল

নতুন করে রোনালদোর জেগে উঠার গল্প

পোস্টটি ৯০৯৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বিগত মৌসুমগুলোর মত এবারও চলছে মাদ্রিদ তারকা রোনালদোর গোল উৎসব। ৩৩ বছর বয়সী পর্তুগীজ গোলমেশিন এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩৫ ম্যাচে ৩৭ গোল করে ফেলেছে। যদি রিয়াল চ্যাম্পিয়ন্স লীগে শেষ পর্যন্ত যেতে পারে আর রোনালদোও তার গোলের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে তবে হয়তবা নিজের ৫৪ ম্যাচে ৬১ গোলের রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও রেকর্ডের খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারবে সিয়ারসেভেন। সর্বোচ্চ আরও ১৪ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতে পারে রোনালদো এই মৌসুমে। এ অল্পকয়েক ম্যাচে আরও ২৫ গোল করা ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথার গল্পের মত মনে হলেও গত ১১ ম্যাচে ২১ গোল করা রোনালদোর পক্ষে অসম্ভব নয়।

 

 

এ মৌসুমের ৩৫ ম্যাচে ৩৭ গোল করা রোনালদো কি তাহলে পুরো মৌসুমেই ছিল বরাবরের মত উজ্জ্বল? লা লীগা পয়েন্ট টেবিল সে কথা কিন্তু বলে না। সবার উপরে থাকা বার্সেলোনা থেকে এখনো ১৫ পয়েন্ট পিছিয়ে ৩য় অবস্থানে রোনালদোর দল। মৌসুমের প্রথমার্ধে যারা নিয়মিত রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন সে সময়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচে ৯ গোলের রেকর্ড গড়া রোনালদোকে লীগের ম্যাচে ‘সিয়ারসেভেন’রূপে না পেয়ে কতটা ভুগেছে রিয়াল মাদ্রিদ। যে মানুষটার উপর ভরসা করে মাদ্রিদ সমর্থকরা ইতিহাস গড়ে টানা তিনবারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতার স্বপ্নে বিভোর কি হয়েছিল মৌসুমের প্রথমে সেই মানুষটির? চলুন খুঁজে দেখার চেষ্টা করি বিখ্যাত ফুটবল এনালিসিস্ট গ্রাহাম হান্টারের বিশ্লেষণ অনুসারে

 

 

Real-Madrid-v-Malaga

 

 

রোনালদোর গোলগুলোর সিংহভাগ তার সঙ্গীরা অসাধারণভাবে  তৈরি করে দেয়। যেকোন রকমের বল থেকে গোল করতে পারার জন্যই রোনালদো আর সকলের থেকে আলাদা। রান্নাঘরের কাজ এতটাই সুন্দর করে গুছিয়ে দেয় রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠ, উইংগার আর উইংব্যাকরা যে রোনালদোর রান্নার স্বাদ বাজে হওয়ার কোন সুযোগই থাকে না। মার্কো এসেন্সিও, টনি ক্রুস, ক্যাসেমিরো, লুকাস ভাস্কেজ, লুকা মড্রিচ, মার্সেলো, কারভাজাল, এমনকি বেঞ্জেমা সবারই শেষ লক্ষ্য কিন্তু রোনালদো। অবশ্য একথাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে রোনালদো ছাড়া অন্য কেউ রান্নাটা বারবার এত সুন্দর করে শেষ করতে পারবে না! রোনালদো অবশ্যই সেই রান্নাঘরের পুরো বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যোগ্য নেতা।

 

 

সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি ম্যাচে বেঞ্জেমা তাকে কেন এখনো মাদ্রিদে নিয়মিত একাদশে রাখা হয়েছে তার কারণ দেখিয়ে দিয়েছে - আলাভেস, গেটাফে আর জিরোনার বিপক্ষে। এতদিন মাদ্রিদে একসাথে খেলার ফলে রোনালদোর মাঠে মুভমেন্ট সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান রাখে বেঞ্জেমা। রোনালদো এমন একজন যে কিনা প্রতিদিন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছে আর তাই তার সাথে এমন একজনই দরকার যে মাঠে তার অবস্থান বা পরবর্তী চাল সম্পর্কে বুঝে তাকে সাহায্য করতে পারবে।

 

 

এক লাইনে ব্যাপারটা এমন যে ‘বেঞ্জেমা যখন মাঠে নিজেকে খুঁজে পায়, তখন রোনালদো নিজেকে আরো আগ্রাসীভাবে মেলে ধরতে পারে’।

 

 

একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো রোনালদো বলের জোগান মাঠের কোন জায়গা থেকে পায়? ডানপাশে কারভাজাল আর বামপাশে মার্সেলোর পা থেকে সরাসরি রোনালদোর মাথায় বা পায়ে কিংবা ক্রুস, মড্রিচের ডিফেন্সচেরা পাস মাঝমাঠ থেকে বা কোণাকুণি এসেন্সিওর বক্সে বল পাঠানো (মাটি বা বাতাসে) সেইসাথে ভাস্কেজের সাথে ওয়ান টু। আসলে কোন একদিক নয়, যেকোন দিক থেকে, যেকোন সময়, যেকোন ভাবে বল চলে আসতে পারে রোনালদোর কাছে। আরো একটি ব্যাপার খেয়াল করা যায় যে, বেঞ্জেমাকে দেওয়া ক্রসের লাইনে পেছন থেকে এসে রোনালদো ফাঁকা জায়গা বানিয়ে গোল দেয়।

 

 

প্রতিপক্ষ যে কোন ম্যাচের পূর্বে খোঁজার চেষ্টা করে সাধারণত কোন কাজগুলি বিপক্ষ দল নিয়মিত করে। তারা সেই ট্রেন্ড ভেঙ্গে বিপক্ষের স্বাভাবিক খেলাকে বাধা দিতে চায়। কিন্তু মাদ্রিদে রোনালদো এত দিক থেকে এত ভাবে বল পায় যে প্রতিপক্ষ বুঝে উঠতে পারে না কোনদিক বাদ দিয়ে তারা কোন দিক মার্ক করে রাখবে। কে রোনালদোকে শেষ বল কোথায় থেকে কিভাবে দিবে তা বোঝাটা প্রায় ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই সাথে রোনালদোর স্পেস বোঝা বা তৈরি করার অসাধারণ ক্ষমতা তো আছেই। মাঠে রিয়াল একটা করে পাস দেয় সামনে আর বিপক্ষের মাথায় দুশ্চিন্তার রেখা আরো গাঢ় হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল রোনালদো যে কখন, কোথায় থাকে তার আন্দাজ করা এতটাই কষ্ট যে গোলকিপার কারো শট ঠেকিয়ে বল ধরতে না পারলে সাথে সাথেই সেখানে পৌঁছে যায় রোনালদো (জিরোনার সাথে বেঞ্জেমার শটটি)।

 

 

না বুঝেই বার্সার সাথে সেই সুপার কাপের প্রথম লেগে রেফারিকে ধাক্কা দিয়ে কার্ড খেয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় সময়ের জন্য সাসপেন্ড হয় রোনালদো। এসময় মনে হয় রোনালদো তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় পার করছিল। মাঠে ফিরে সেই ট্যাকনিক্যাল নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস, ঠান্ডা মাথা এবং গোলবারের সামনে দৃঢ় ‘সিয়ারসেভেন’কে হারিয়ে ফেলে রোনালদো নিজেই।

 

 

কিছু উদাহরণ দেখা যাক। গেটাফের মাঠে গিয়ে রোনালদো গোল দিবে মাদ্রিদ জিতে আসবে যেকোন সময়ের জন্য এটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু গোলবার থেকে মাত্র তিন গজ দূরে থেকে নেওয়া ভলিটা যে মাদ্রিদ সমর্থকদের পরিচিত সিয়ারসেভেন নেয়নি তা রোনালদো নিজেও বুঝতে পেরেছিল।

 

 

কিংবা জিরোনার সাথের সেই প্রথম ম্যাচটি। বক্সের ডানপাশ থেকে ক্রুসের স্বভাবসুলভ অমায়িক পাস কিন্তু রোনালদোর পায়ে যখন বল আসল তখন তা যেন এক কনক্রিটের ব্লক হয়ে গেল! আরো একবার বক্সে বল উড়িয়ে মারল ইস্কো। জায়গামতই ছিল রোনালদো। শুধু মাথা দিয়ে দিক নির্দেশ করে দিতে হবে বলের যা রোনালদোর জন্য কোন ব্যাপারই না। কিন্তু তার ভুলে বল মাথায় না বরং ঘাড়ে লেগে গেল। আরো একটি মিস!!

 

 

অ্যাথলেটিকোর সাথে মাদ্রিদ ডার্বিতে এসেন্সিওর পাস বক্সে যা রোনালদোর ক্ষেত্রে সিংহভাগ সময়ে গোল বা গোলকিপারের অসাধারণ সেভ হয় তা এবার রোনালদোর এতদিনের ফুটবলের উপর যে কর্তৃত্ব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। যেন কিভাবে বলকে প্রথম টাচে ধরে শট নিতে হয় তাই পারে না এই ব্যালন ডি অর বিজয়ী।

 

 

আর এল ক্ল্যাসিকোতে এই গত রবিবার জিরোনার সাথে বামপাশ থেকে যে পাস দিল ক্রুস এমনি এক পাস দিয়েছিল। জিরোনার বিপক্ষে কিন্তু গোলটি ঠিকই হয়েছে রোনালদোর পা থেকে কিন্তু বার্সার সাথে রোনালদো পায়ে বল লাগাতে না পেরে ট্রলের শিকার হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। ঠিকই তো আছে যে সাম্রাজ্য জয় করেছে রোনালদো সেখানে তো এমন ভুলের কোন সুযোগ নেই। সেখানে তো শুধুই রোনালদোর বীরত্বগাথা অথবা ব্যর্থতা।

 

 

এইতো কিছুদিন আগেও মেসি রোনালদো সমানে সমানে ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লীগে। কিন্তু রোনালদো এখন গোল আর ফাইনাল খেলা বা জেতার দিক থেকে এগিয়ে গেছে মেসিকে পেছনে ফেলে। কিভাবে? পরিশ্রম করে।

 

 

গত ডিসেম্বরে বিখ্যাত ফুটবল অ্যানালিসিস্ট গ্রাহাম হান্টার বলেছিলেন, রোনালদোর আবার ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। আসলেও তাই। সেই সুপার কোপার পরে মাঠ থেকে বাইরে গিয়ে রোনালদো হারিয়ে ফেলে নিজের আত্মবিশ্বাস, ট্যাকনিক্যাল নিয়ন্ত্রণ আর সেই শতভাগ ফিট রোনালদোকে। ফলে ভুগতে থাকে গোলের সামনে। সেই সাথে বিগত নয় মাসে নিজের পরিবার নিয়ে বেশ ব্যস্ততা ছিল রোনালদোর, দুইটা পর পর গ্রীষ্মের টুর্নামেন্ট, একটি ট্যাক্স কেস মিলিয়ে ফুটবল থেকে দূরে থাকা সময়টি আরো কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। আরো রয়েছে বিভিন্ন কমার্সিয়ালে অভিনয় করতে যাওয়া। এত এত ঘটনা কি একটু হলেও রোনালদোর সৃজনশীল জীবনীশক্তিকে কমিয়ে দেয়নি? তাই তো মাঠে ফিরে হারিয়ে ফেলে নিজেকে। ফিরে যায় ট্রেনিং গ্রাউন্ডে আবারো রোনালদো। খোঁজার চেষ্টা করে নিজেকে আবার নতুন করে।

 

 

পরিশ্রমই সাধারণকে মহান করে। যে শারীরিক অবস্থার দরকার রোনালদোর মাঠে সিয়ারসেভেন হয়ে উঠতে সেটা হারিয়ে ফেলেছিল তা আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ফিরে গিয়ে আবারো রোনালদো খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। ফিরে এসেছে মাঠে পুরনো রূপে, নতুন উদ্যমে।

 

 

শুধু সহকর্মীদের কাছে থেকে অসাধারণ সব বানানো বল পেয়ে রোনালদো হয়ে উঠেননি অজেয় সিয়ারসেভেন বরং হয়ে উঠেছেন নিজের ইচ্ছায়, আগ্রহে, পরিশ্রমে, মেধায়। মৌসুমের শুরুতেও কিন্তু ছিল তার সহযোদ্ধাদের বানানো বল, ছিল না শুধু সিয়ারসেভেন। কিন্তু ফিরে এসেছেন আবারো নিজ যোগ্যতায়, নিজ পরিশ্রমে, মাদ্রিদের হয়ে।  

 

 

cristiano-ronaldo-crushes-girona-with-four-goals-in-another-goalscorer-party

ফুটবল এনালিসিস্ট গ্রাহাম হান্টারের ইএসপিএনে প্রকাশিত অ্যানালাইসিস অনুসারে