• ফুটবল

স্বপ্নভঙ্গের বেদনার মধুর স্মৃতি !

পোস্টটি ২৬২০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আরে! স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি আবার মধুর হয় না কি? হয় বৈ কি। ছোটবেলায় স্কুল শিক্ষকদের বকুনি-পিটুনির জন্য কত কান্নাকাটিই না করেছি। এখন ফিরে দেখলে ওগুলোই মধুর মনে হয়। প্রথমবার বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে অনেকটা সেরকম অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। সময়কাল ১৯৯৮ সাল।

তখন ছিলাম গ্রামের বাড়িতে। আর টিভি-ইন্টারনেটের জোয়ারও ছিল না। চলতি খেলার খবর পাওয়ার কোনো জো নেই। একমাত্র ভরসা ছিল খবরের কাগজ। ভোরের কাগজ (আজকের প্রথম আলো) ছিল ফেবারিট। এছাড়া জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, ইনকিলাব - যা হাতের কাছে পেতাম, খেলার পাতাটা খুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। বিশ্বকাপের সময় পত্রিকার চেহারাও বদলে যেত - সাদাকালো পেজ হয়ে যেত রঙ্গিন, এক পৃষ্ঠা থেকে দুই পৃষ্ঠার বর্ধিত কলেবর। বাসার বারান্দার কেবিনে পোস্টার লাগতাম - রোনালদো, বাতিস্তুতা, মাইকেল ওয়েনদের। যেন একটা ফেস্টিভ লুক সবখানে ছড়িয়ে পড়ত! পত্রিকা থেকেই  কোন দল ভাল, কেন ভাল, কে কোন দলে খেলে এসবের একটা আইডিয়া পেতাম। 

বিশ্বকাপে কেন মানুষ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দলের সাপোর্ট করে? শুধু মাত্র খেলা দেখে? আদতে না।  মূলত মানুষ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সাপোর্ট করে বাপ-চাচা-মামা-এলাকার বড় ভাই এদের সাপোর্ট আর উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে। যাইহোক, আমার ক্ষেত্রেও একি কেস। মামাদের দেখতাম ব্রাজিল নিয়ে দারুণ উত্তেজনা। আর পত্রিকা পড়ে আরো জানতে পারলাম, ব্রাজিল আর ফুটবল - যেন সমার্থক শব্দ। কালো মানিক পেলে, গারিঞ্চা, ডিডি, ভাভা, টোস্টাও , রিভেলিনো, ফ্যালকাও, জার্জিনহো, সক্রেটিস, জিকো, রোমারিও - কী গাল ভরা সব নাম! যুগে যুগে এসব কিংবদন্তী তুল্য খেলোয়াড়রা 'জোগো বনিতো' - 'সুন্দর ফুটবল' দিয়ে বিশ্বকে মোহাচ্ছান্বিত করে রেখেছেন।

brazil

১৯৯৮ সালেও ব্রাজিল দলটা ছিল হট ফেবারিট। রোনালদো (আসল রোনালদো) ছিল তখনকার সুপারস্টার। ব্যালন-ডি-অর,  বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি ঝুলোয় ভরেছেন অলরেডি। সাথে কাফু, ডুঙ্গা, রবার্তো কার্লোস, রিভালদো, বেবেতো, ক্লদিও টাফারেলদের নিয়ে দুর্দান্ত একটা টীম। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত সেবারের বিশ্বকাপে তাই সবার অনুমান সত্যি করে ফাইনালে উঠে গেল ব্রাজিল। ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর অন্যান্য ব্রাজিল সমর্থকের মতো আমারো একাদশে বৃহস্পতি অবস্থা। ঠিক দলকেই সাপোর্ট করতেসি- গর্বে বুক ফুলে শরীফ ছাতা হয়ে গেল। 

ওদিকে ফ্রান্স দলটা আন্ডারডগ ছিল। স্বাগতিক দেশের সুবিধা নিয়ে ফিক্সচারটা মনে হয় একটু সহজই ছিল। কয়েকদিন আগে মিশেল প্লাতিনি স্বয়ং স্বীকার করেছেন ব্যাপারটা । যাহোক, তাই বলে ফাইনালে উঠে যাবে এরকম কম মানুষই ভেবে ছিল। আমার কী? ফ্রান্স যদি দুর্বল দল হয়, ব্রাজিলের জিততে তো  সুবিধেই হবে। ভাল। আরাম করে ঘুমালাম ফাইনালের আগের দিন গুলি।  

ফাইনালের দিন  দুপুরে/বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিল মনে আছে। বৃষ্টি হলেই  টিভিতে ঝিরঝির করতো, এন্টেনা নাড়াচাড়া দিয়ে একটু ভাল সিগনাল আনা হল। খেলা শুরুর পর থেকেই ব্রাজিল টিমকে কেন জানি ছন্নছাড়া মনে হল। রোনালদো কেমন জানি নিস্প্রভ। কমেন্টেটরদের মুখে শুনে ঠিক বুঝতে পারলাম না, ব্যাপারটা কি! কিন্তু কিছু একটা গোলমাল যে হয়েছে, শিউর। যাহোক, ২৭ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে টেকো মাথার একটা প্লেয়ারের হেডে  ফ্রান্স এগিয়ে গেল। বিরতির ঠিক আগে আবার কর্নার; আবার টেকো মাথার প্লেয়ারের হেড। ২-০ তে  ফ্রান্স এগিয়ে গেল।  তখনো মনে হয়নি ব্রাজিল হারবে। একটা আশা ছিল - বিরতির পরে নতুন শক্তিতে ঝাপিয়ে পড়বে ব্রাজিল। রোনালদো যদি একটু চমক দেখায়, কামব্যাক করতে পারবে। সেটা আর হয়নি। উলটো শেষ মুহুর্তে কাউন্টার এটাক থেকে গোল দিয়ে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় ফ্রান্স।  

zidane_header_brazil

৩-০ ! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আমিতো তখন নয়া সাপোর্টার, মাত্র খেলা বুঝতে শুরু করেছি। যারা পোড়খাওয়া সমর্থক ওদের কালো মুখ দেখে বুঝতে সমস্যা হয়নি যে কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। এই ফাইনাল নিয়ে অনেকদিন সমালোচনা হয়েছে - এন্টি ব্রাজিল সাপোর্টারদের তো পোয়াবারো। সারা বিশ্বেই আলোচনার ধুম পড়ে গিয়েছিল কেন ব্রাজিল এমন বাজে খেলল- কী হয়েছিল রোনালদোর ? সবই যেন রহস্যময় - যার জট এখন পর্যন্ত ধোয়াশে রয়ে গেছে।

ronaldo

কথা হচ্ছে, এত বেদনার স্মৃতি কিভাবে মধুর হল? কারণ, সেই বিশ্বকাপেই দেখতে পেলাম নতুন পরাশক্তির আবির্ভাব - ফ্রান্স। বার্থেজ, থুরাম, ভিয়েরা, দেশম আর সেই বিখ্যাত টেকো মাথার খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান। কী অবলীলায়ই না মাঠে ছড়ি ঘোরাতেন ! জিদান মাঠে নামলেই যেন বাকি খেলোয়াড়রা এক লেভেল উপরে উঠে যান - এমনি প্রভাব ছিল। ফ্রান্সের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যে ফ্লুক ছিল না, তা পরবর্তি ইউরো জিতে ভালভাবেই প্রমান করেছিল। ২০০২ বিশ্বকাপে ১ম রাউন্ড থেকে বাদ পড়াটা অন্যতম অঘটন ছিল, নইলে ২০০৬ এ রানার্স-আপ হয়ে নিজেদের শক্তি জাহির করেছিল ফ্রান্স - যেখানে বরাবরের মতোই 'জিজু' ছিলেন নায়ক-খলনায়ক।  

zizu

আর ২০০২ বিশ্বকাপে ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে ব্রাজিল কোন ভাবে বাছাইপর্ব পেরিয়ে ছিল। তেমন আশাও করেননি সমর্থকরা। কিন্তু সেখানেই বাজিমাত করে ব্রাজিল, চ্যাম্পিয়ন হয়ে আগের বিশ্বকাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব করে । রোনালদোও জ্বলে উঠেন সময়মতো। সাথে রোনালদিনহো নামক নতুন তারকার আবির্ভাব। তাই আগের বিশ্বকাপের হতাশা কাটিয়ে সমর্থকদের মুখে হাসি ফিরে আসল। তাই, এখন ফিরে দেখলে মনে হয় মন্দ ছিল না '৯৮ বিশ্বকাপ!

স্বপ্নবোনার আর স্বপ্নভাঙ্গার অম্ল-মধুর স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে প্রথম বিশ্বকাপের স্মৃতিগুলো।