• ফুটবল

চাওয়া না পাওয়ার বিশ্বকাপঃ পর্ব ১ - জাম্বিয়া ১৯৯৩

পোস্টটি ৩৪০৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২৭ এপ্রিল, ১৯৯৩। গোধূলির ম্লান আলো এসে পড়ছে গ্যাবনের রাজধানী লিবারভিলে। জাম্বিয়ান এয়ারফোর্সের ছোট্ট ডি হ্যাভিলান্ড কানাডা (ডিএইচসি-ফাইভ) বাফেলো এয়ারক্র্যাফটটি ফের আকাশে ওড়ার প্রস্ততি নিচ্ছে। জাম্বিয়ার লুসাকা থেকে যাত্রা শুরু করা বিমানটি প্রথম বিরতি নেয় কঙ্গোর ব্রাজাভিলে। এরপর লিবারভিল হয়ে যাবে আইভরি কোস্টের আবিদজানে। সেখান থেকে ফ্লাইটের শেষ গন্তব্য সেনেগালের ডাকারে।

ছোট্ট বিমানটির যাত্রী হিসেবে আছে নিজেদের ইতিহাসের সেরা জাম্বিয়া জাতীয় দল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতেই গন্তব্য সেনেগাল। ব্রাজাভিলেই ইঞ্জিন সমস্যা টের পাওয়া গিয়েছিল পুরনো বিমানটির, কিন্তু পাইলট সিদ্ধান্ত নিলেন যাত্রা থামাবেন না। লিবারভিল ছাড়ার মিনিটখানেক বাদেই বামদিকের ইঞ্জিনে আগুন ধরলো, তারপর একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। আগের দিনই মরিশাসে আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সের বাছাইপর্বের ম্যাচের পর দলটিকে দেশে ফিরিয়ে আনা ক্লান্ত পাইলট করলেন অদ্ভুত এক কাজ। ডানের ইঞ্জিনটাও বন্ধ করে দিলেন। দুই ইঞ্জিন ছাড়া জীবনের সব শক্তি হারানো বিমানটি আছড়ে পড়লো আটলান্টিক মহাসাগরে, তীর থেকে মাত্র ৫০০ মিটার অদূরে। সেই বিধ্বস্ত বিমানেই বিধ্বস্ত হলো ৩০ জীবনের স্বপ্ন, জাম্বিয়ার স্বর্ণালী প্রজন্মের বিশ্বকাপ স্বপ্ন!

ভাগ্যের জোরে বিমানটিতে ছিলেন না তিন তারকা। চিপোলোপোলো অধিনায়ক কালুশা বাওয়ালিয়া তখন ব্যস্ত ডাচ লিগে পিএসভি আইন্দহোভেনের হয়ে খেলতে, আলাদাভাবে যাবার কথা ছিল সেনেগালে। বেলজিয়ামের আন্ডারলেখটের হয়ে খেলা চার্লস মুসোন্দাও বেলজিয়াম থেকে যাবার কথা। আর চাকরির ঝামেলায় বেনেট সিমফুকের যাবার কথা ছিল ভিন্ন ফ্লাইটে।

 

1993037BL

সতীর্থদের সমাধির পাশে অধিনায়ক কালুশা

 

চিপোলোপোলো (কপার বুলেট) খ্যাত জাম্বিয়ার এই দলটায় কমতি ছিল না প্রতিভার, ছিল সম্ভাবনার মিছিল। সেই আগুনে সম্ভাবনার প্রথম ঝলক দেখা যায় ১৯৮৮ সিওল অলিম্পিকে। দলের নিউক্লিয়াস কালুশার হ্যাটট্রিকে ইতালিকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে দলটি। রজার মিলা, জর্জ উইয়াহদের যুগে প্রথম জাম্বিয়ান হিসেবে সেবছর আফ্রিকার বর্ষসেরা হন কালুশা। অলিম্পিক কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে যায়নি গল্পটা। ১৯৯০ সালের আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সে ব্রোঞ্জ পদক পায় কপার বুলেটরা। জাম্বিয়ার ফুটবল জোয়ারে এনকানা রেড ডেভিলস আফ্রিকান ক্লাব চ্যাম্পিয়নস কাপের ফাইনালে ওঠে ১৯৯০-তে, পরের বছর পাওয়ার রেঞ্জার্স জিতে নেয় আফ্রিকান কাপ উইনার্স কাপ। ১৯৯৩ আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সের শিরোপা স্বপ্নে বিভোর দলটা পাখির চোখ করেছিল প্রথমবারের মত ১৯৯৪ বিশ্বকাপে পা রাখাকেই।

গডফ্রে চিতালুকে মনে আছে? লিওনেল মেসির ৯১ গোলের বছরে নাম শুনেছেন হয়ত। ১৯৭২ সালে এই জাম্বিয়ান করেছিলেন শতাধিক গোলের রেকর্ড! সেই চিতালু ছিলেন এই দুর্ভাগা দলটির কোচ। সাথে কালুশা, মুসোন্দা, বেনেট, প্যাট্রিক ‘বম্বার’ বান্দা, শাবালার মত তারকারা। প্রাথমিক পর্বে উড়ন্ত জাম্বিয়া চূড়ান্ত বাছাইপর্বে মুখোমুখি হবার কথা সেনেগাল আর মরক্কোর সাথে। সেনেগালের সাথে দেখা হবার আগেই সেই দুর্ঘটনা।

 

450px-Lusaka_Heroes_Acre_-_memorial

১৯৯৩ সালের সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো বীরদের সমাধি নির্মাণ করা হয় লুসাকার ইন্ডিপেনডেন্স স্টেডিয়ামের ঠিক বাইরেই। যা বর্তমানে পরিচিত ‘হিরোজ এইকার’ নামে। 

 

১৮ খেলোয়াড় আর ৫ কোচিং স্টাফ হারানো জাম্বিয়া প্রত্যাবর্তন করে ছাইভস্ম থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্স পাখির মতই। কালুশার নেতৃত্বে নবীন এক দল বানিয়েই কঠিনতম যাত্রা শুরু হয় বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব আর আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সের জন্য।

আফ্রিকা সেরা হবার লক্ষ্যে দারুণ আক্রমণাত্মক খেলা উপহার দেয় চিপোলোপোলোরা। সব বাঁধা-বিপত্তিকে হার মানানো কালুশার দল সেমিতে ৪-০ গোলে হারায় মালিকে। তবে ফাইনালে তারকাসমৃদ্ধ নাইজেরিয়ার সাথে এগিয়ে গিয়েও স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় সুপার ঈগলদের দু'গোলে। সেবার বীরবেশে দেশে ফেরা দলটি হৃদয় জিতে নিয়েছিল পুরো আফ্রিকার তাবৎ ফুটবল ভক্তদের।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে প্রথম ৩ ম্যাচে ১ জয়, ২ ড্রয়ে প্রথম বিশ্বকাপ স্বপ্ন থেকে দূরত্ব ছিল মাত্র ১ পয়েন্টের। কালুশার শট দুবার পোস্টে লেগে ফিরে আসা মরক্কোর বিপক্ষে সেই ম্যাচে গ্যাবনিজ রেফারি জিন ফিদেলের বিতর্কিত সব সিদ্ধান্ত আর লাঘ্রিসির একমাত্র গোলে অবিশ্বাস্য বিশ্বকাপ স্বপ্নটা থেমে যায় সেইদিনই। আর কখনো বিশ্বকাপ খেলা হয়নি জাম্বিয়ার।

১৯ বছর পরে ২০১২ সালে রূপকথার গল্প আবার শুরু করে চিপোলোপোলোরা। সেনেগাল, লিবিয়া, ঘানার মত পরাশক্তিদের হারিয়ে ফাইনালে দেখা হয় দিদিয়ের দ্রগবার আইভরি কোস্টের সাথে। গোলশূন্য ১২০ মিনিটের পর ৮-৭ গোলের শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মত আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সের শিরোপা জেতে জাম্বিয়া।

কোথায় জানেন? সব হারানোর সেই লিভারভিলেই, বিধ্বস্ত জায়গাটা থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরেই।

 

article-2100183-11B4B5D1000005DC-70_1024x615_large

২০১২ সালের শিরোপাজয়ী জাম্বিয়া দল 

 

টীকা

  • এবছর শোকের রজতজয়ন্তী পার করা সেই দুর্ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্ত রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করেনি জাম্বিয়া সরকার। গুজব আছে, জাম্বিয়া এয়ারফোর্সের মিলিটারি বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং গ্যাবনের সামরিক বাহিনীর গুলিতে ভূপাতিত হয়। তদন্তের জন্য মিলিটারি বিমান হওয়ায় ব্ল্যাকবক্স ছিল না। এই দুর্ঘটনার পর বহু বছর জাম্বিয়া ও গ্যাবনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ খারাপ ছিল।
  • ২০০৩ সালে গ্যাবন সরকারের রিপোর্টে পাইলটের ত্রুটি ও ক্লান্তিকেই দায়ী করা হয়।
  • ২০১৪ সালে হুয়ান রদ্রিগেজের পরিচালনায় বিমান দুর্ঘটনাটি নিয়ে ‘Eighteam’ নামক ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়।