• ক্রিকেট

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ওয়ানডে ইনিংস, ১৪৪?

পোস্টটি ৭০২৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সেরা বা সব’চে ভালো নির্বাচন হয় কীভাবে?

চাপ, প্রতিপক্ষ, সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি... ইত্যাকার কিছু নির্দিষ্ট ধারা গভীরভাবে পর্যালোচনার পর, বহু নিরীক্ষা শেষে, বহু দিক থেকে বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করে, অভিমতের স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ উপস্থাপন শেষে- একটা রায় জানানো হয়! এই তো?

এখন সেই রায় যদি যুক্তির মানদন্ডে উতরে যেতে সক্ষম হয়, অভিমত-দাতার পান্ডিত্য যদি আমাদের আস্থার স্থান দখল করে, তবে আমরাও মোটামুটি মেনে নিই। নইলে ভিন্ন মত দিই। তাহলে কোনোভাবে তর্কাতীত ‘সেরা’ ঘোষণা করা কী যায়? সম্ভব হয়?

নাহ!

কারণ, সব পান্ডিত্য, বিচারকার্য্যের মানদন্ড ও বিশ্লেষণের পরও আরও একটা ব্যাপার থাকে, তা হচ্ছে- দৃষ্টিকোণ। দেখার ভঙ্গি। সবাই একভাবে বিচার করে না, করতে পারে না। একেকজনের দেখার ভঙ্গি একেক রকম। তাই সন্দেহাতীতভাবে ‘সেরা’ নির্বাচন কঠিন-ই শুধু নয়, কখনো কখনো অসম্ভবও।

তারপরও এই কাজ হয়। কেনো তাহলে?

মানুষ তর্ক করতে ভালোবাসে। আড্ডা দিতে পছন্দ করে। পরিসংখ্যান নিয়ে খেলতে চায়, বলতে চায়। বিচার করতে চায়। অভিমত দিতে চায়। তুলনা টানতে চায়।

তাই ‘সেরা’ নিয়ে তর্ক হয়, হবে, এবং হয়তো হতে থাকবে...।

____________

 

১.

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ওয়ানডে ইনিংস নির্বাচন একদিক থেকে সহজ, আবার কঠিনও বটে! সহজ এই অর্থে যে- অন্য দলগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে খুব বেশী মহাতারকার আগমন ঘটেনি, অবিশ্বাস্য ইনিংসও তাই সেই অর্থে খুব বেশী ঝুলিতে জমা হয়নি। আবার যে ক’টা জমেছে তাও একদম ছেড়ে দেয়ার মতো নয়। সেখান থেকে বাছাই করা খানিক তো নয়-ই, ভীষণ ঝামেলারই আসলে!

 

২.

রানের পুরুষ্টুতা দিয়ে হয়তো আপনি, সর্বোচ্চ স্কোর পেতে পারেন। কিন্তু, সেরা বিচার করতে পারেন না। সেরা নির্বাচনে অবশ্যই আপনাকে স্কোরের বিশালত্ব ছাড়াও, পরিপার্শ্বিক আরো অনেক কিছুই দেখতে হবে। আবার অনেকেরই এমন অনেক ইনিংস আছে, যাদের সর্বোচ্চ ইনিংসটাই ‘সেরা’ বিবেচনায় নিয়ে নিতে পারেন অনায়াসে। কপিল দেবের ১৭৫, ভিভ রিচার্ডসের ১৮৯, সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪... এই ইনিংসগুলো শুধু তাদের কেনো, ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেরই হাতেগোণা সেরা কয়েকটি ইনিংস!  

আবার শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাপারটা দেখুন। ক্যারিয়ারে এত এত অসাধারণ ইনিংস খেলেছেন, কোনটা ছেড়ে কোনটাতে যাবেন? তারপরও তাঁর ক্যারিয়ার-বেস্ট অপরাজিত ২০০ অবশ্যই আলোচনায় থাকবে। কিন্তু শারজার সেই ব্যাক-টু-ব্যাক ১৪৩ ও ১৩৪? কিংবা সুপার সেঞ্চুরীয়নের সেই মহাকাব্যিক ৭৫ বলে ৯৮? আবার গিলক্রিস্টের ব্যাপারটাও দেখুন, বিশ্বকাপ ফাইনালের ১৪৯ ছাড়া তাঁর অন্য কোন ইনিংস নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী হবেন আপনি? গ্র্যান্ট ইলিয়টের ইডেন পার্কে, নট আউট ৮৪-তে দক্ষিন আফ্রিকাকে নক আউট পাঞ্চ দেয়া ইনিংসটা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো ইনিংস কী খুঁজতে যাবেন আপনি? ধোনীর বিশাখাপত্তমের ১৪৮ বা জয়পুরের ১৮৩’র চেয়ে ওয়েংকেড়ের ৭৯ বলে ৯১* নিয়েই নিশ্চয় কথা বলতে বেশী আগ্রহ হবে আপনার! আবার ডি সিলভার কথা যদি বলি, ইডেন গার্ডেনে ৯০ হাজার দর্শক সমানে চেঁচাচ্ছেন। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ১ রানে নেই ২ উইকেট, সেখানে নেমে তিনি খেললেন ৪৭ বলে ৬৬ রানের ইনিংস। ১৪টি বাউন্ডারী! বিশ্বকাপ ফাইনালে আবার অপরাজিত ১০৭! কোন ইনিংসকে এগিয়ে রাখবেন আপনি? এই দুটো বাদ দিয়ে তৃতীয় কোনো ইনিংস নিয়ে আসবেন? বেনসন এ্যান্ড হ্যাজেস টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলা ৯৩ বলে ১২৬?

তো, সেরা ইনিংস বলা যত সহজ, নির্বাচন যেন ততটাই কঠিন!

 

৩.

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ওডিয়াই ইনিংস নিয়ে বলতে গেলে অনেক অনেক ইনিংসই হুড়মুড়িয়ে চলে আসে। সাকিব আল হাসানের মুলতানের ১০৮, মুশফিকুরের কিম্বার্লিতে অপরাজিত ১১০, আনামুলেরও আছে উইন্ডিজের বিপক্ষে ১০৯, সেইন্ট জর্জেসে। নাসির হোসেন মিরপুরে খেলেছিলেন ১০০ রানের অসাধারণ একটা ইনিংস, পাকিস্তানের বিপক্ষে। করাচীর মাঠে ভারতের বিপক্ষে, অলক কাপালীর ইনিংসটা? হ্যামিল্টনে মাহমুদুল্লাহর আছে ১২৮*, জয়পুরে শাহরিয়ার নাফিসের ১২৩*, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তামিমের ১২৫... কতো কতো ইনিংস! কোনটা ছেড়ে কোনটাতে যাবেন?

আমরা যদি আমাদের নির্বাচন-মানদন্ড কেবলই ম্যাচ উইনিং নক-এ সীমাবদ্ধ করে ফেলি- তারপরও কি কম আছে, তেমন ইনিংস?

নাঈম ইসলামকে মনে আছে? চট্টগ্রামে তাঁর ৭৩* রানের ইনিংসটার কথা মনে পড়ে? ১০৫ রানে ৫ উইকেট পতনের পর নেমেছিলেন (আসলে ৬ উইকেট এক অর্থে; তামিম ইঞ্জুরড ছিলেন।), দলকে জয়ের বন্দরে ভিড়িয়ে তবেই উঠেছিলেন! ১৮৭ রানে নবম ব্যাটসম্যানও (১৭৯-তে অষ্টম উইকেট যাওয়ার পর, নেমেছিলেন ইঞ্জুরড তামিম। তিনিই আউট হয়েছিলেন নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে।) তাঁকে ছেড়ে গেলে পরের দুর্গম ৩৫ দৌঁড় যাত্রায়, তাঁর সঙ্গীর অবদান ছিল মাত্র ১! এই ইনিংসটাকে বাদ রাখা যায়?

কার্ডিফের যুগলবন্দী নিশ্চয় এখনও স্মৃতিতে ভীষণ তরতাজা? ৩৩ রানে নেই ৪ উইকেট, ২৩০ বল থেকে ২৩৩ রান করতে হবে, মাস্ট উইন ম্যাচ। ইংলিশ কন্ডিশনে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে- মাহমুদুল্লাহ ও সাকিব মিলে রচনা করলেন যুগল সেঞ্চুরীর ইতিহাস। এই দুটো সেঞ্চুরী থেকে কোনটিকে বাছাই করবেন?

সাকিব আলা হাসানের একা-হাতে জেতানো ম্যাচটার কথা কি ভোলা যায়? সেই যে প্রায় নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে ১১৩ বলে ১০৬ করেছিলেন যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে! মোহাম্মদ রফিকের ৮৭ বলে ৭৭? প্রথম ওডিয়াই জয় ছিল যে সেটা! অথবা প্রথম সিরিজ জেতা ম্যাচে আফতাবের ৮৭ বলে ৮১*? প্রবল শক্তিশালী দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে, প্রোভিডেন্সে আশরাফুলের ৮৩ বলে ৮৭-টা কী বাদ রাখা যায়? অথবা পাকিস্তান ও দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে সৌম্যের ইনিংসগুলো?

এক তামিমেরই কী কম ইনিংস আছে, আলোচনার জন্য? অথবা মুশফিকের? কিংবা সাকিবের?

 

৪.

তাহলে কী দাঁড়ালো? আমরা আলোচনা-টা টেনে নিতে পারছি না? উঁহু, একদমই তা নয়। শুরু যখন হয়েছে, একটা দাঁড়ি না-টেনে কী উপায় আছে? বলুন?

তো আমরা প্রথমে মোটামুটি সেরা পাঁচটি ইনিংস নিয়ে আলোচনা করবো। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে, আশা করছি।

কোনো র‍্যাংকিং অর্ডারে নয়, ইনিংসগুলোকে সাজাবো ইনিংসগুলোর বয়স বা সময় অনুসারে। সবচেয়ে পুরনোটা সবার শেষে, সবচেয়ে সাম্প্রতিকটা সবার আগে, এই তো!

 

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ১০৩, এ্যাডিলেইড ওভাল, বিশ্বকাপ ২০১৫ : প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড

এন্ডারসন ও ব্রডের পেসে রীতিমতো বেসামাল তখন বাংলাদেশের ওপেনার দু’জন। মাত্র তৃতীয় ওভারেই নামতে হলো তাঁকে, ৮ রানে নেই ২ উইকেট। সেখান থেকে সৌম্যকে নিয়ে প্রথমে প্রতি আক্রমণে সামাল দিলেন শুরুর হাঁসফাঁস অবস্থা। পরপর দু’ওভারে সৌম্য-সাকিব বিদায় নিলে, আবারও বিপদের ভয় ঝাঁপটা দিলেও, পাত্তা দিলেন না তিনি। মুশফিককে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুন্দরতম এক অধ্যারের রচয়িতা হয়ে গেলেন।

১৩৮ বলে ১০৩ রানেই ইনিংসে মাত্র ৭টি চার আর ২টি ছয়, ঠিকঠাক হয়তো বোঝাতে পারবে না, কী অসাধারণ একটা ইনিংসের কারিগরের পরিসংখ্যান এটা! এই ইনিংসে শুধু একটা জয়ই লেখা হয়নি, একটা দলের পরের কয়েক বছরের গতিপথও যে লেখা হয়ে গিয়েছিল!

 

তামিম ইকবাল ১৫৪, কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব, বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ ২০০৯ : প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে

আগের ম্যাচেও তিন শতাধিক স্কোর তাঁড়া করতে গিয়ে মুখ তুবড়ে পড়েছিল বাংলাদেশ টপ অর্ডার। নেতৃত্বে ছিলেন তিনিই, প্রথম বলেই শূণ্য রানে ফিরেছিলেন যে! কখনো তিন শতাধিক স্কোর তাঁড়া করেনি বাংলাদেশ, ইতিহাস বাংলাদেশের বিপক্ষে, পক্ষে আনতে দরকার ছিল তাঁকে। ঠিক দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। এক প্রান্ত থেকে একটু একটু করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনবদ্য এক ইতিহাসে যোগান দিয়ে গেছেন, নিজেও হয়েছেন ইতিহাস। তাঁর সেই ১৫৪ এখনো একদিনের ক্রিকেটে কোনো বাংলাদেশীর একক সর্বোচ্চ ইনিংস!

প্রতিপক্ষের বোলিং আহামরি ছিল না সত্যি, তবে রান তাঁড়ায় যে কোনো বোলিং বা যে কোনো স্কোরই বিষম চাপ। তাছাড়া তিনিও তো তখন আজকের মতো ত্রিশের অভিজ্ঞ কেউ ছিলেন না, নবীন একজনই ছিলেন। সেই সময় অমন চাপ সামলে ১৫৪ রানের মতো বিশাল ইনিংস, বিশেষ কদর দাবী রাখে নিশ্চয়!

 

সাকিব আল হাসান ৯২*, শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম, ত্রিদেশীয় সিরিজ ২০০৯ : প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা

হারলেই বাদ। জিততে হবে বোনাস পয়েন্টসহ, একটা নির্দিষ্ট ওভারের মধ্যে। ১১ রানে নেই ৩ উইকেট। এমন ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে, ওভার প্রতি ছয়েরও বেশী আস্কিং রেট মাথায় নিয়ে, মুরালী-মেন্ডিসদের সামলে তিনি খেললেন ৬৯ বলে ৯২ রানের চোখ ছানাবড়া করা এক ইনিংস! তাঁর এই ইনিংস শুধু বাংলাদেশকে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালেই তুলেনি, বরং সমর্থকদের গভীরে এক দৃঢ় বিশ্বাসও প্রোথিত করে দেয় যে- এই মানুষটা থাকলে নাথিং ইজ ইম্পসিবল!

শুধু সমর্থকদের কথাই-বা বলি কেন, তাঁর নিজের সম্পর্কেও কী নতুন করে জানেননি তিনি? তাঁর সক্ষমতা আর শক্তিমত্তা সম্পর্কে জেনে নিশ্চয় নব উদ্যমে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। তারপর থেকেই যে শীর্ষরেখায় বসতি গড়েছেন তিনি! আর বাংলাদেশ ক্রিকেটকেও একটু একটু করে উর্ধ্ব-পথে টেনে নিচ্ছেন, যে পথে টেনে নেয়ার সূচনা-টা তিনি করেছিলেন সেদিন!

 

মোহাম্মদ আশরাফুল ১০০, সোফিয়া গার্ডেন, ত্রিদেশীয় সিরিজ ২০০৫ : প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া

প্রতিপক্ষ, রিকি পন্টিংয়ের বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া। এটুকুই তো যথেষ্ট এই ইনিংসের মাহাত্ম্য বোঝাতে। আশরাফুল যখন এই ইনিংস খেলছিলেন, বোলিং আক্রমণে কারা ছিলেন জানেন? ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ক্যাসপ্রোভিচ ত্রয়ী! ২৫০ তাঁড়া করতে গিয়ে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অমন ইনিংস! এই ইনিংস নিয়ে বেশী কিছু বলা যায় না আসলে। অনেকে এটাকে ‘কার্ডিফ-রুপকথা’ বলেন, ব্যাপারটা আসলে তা-ই। রুপকথা-ই। ১১টি চারের সমন্বয়ে সাজানো ১০১ বলে ১০০ রানের ইনিংসটি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও আনন্দদায়ক গল্প।

 

আকরাম খান ৬৮*, আরআরআই মাঠ, আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭ : প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ড

এই ইনিংস দেখে কেউ চোখ কচলে উঠতে পারেন, ভ্রু কুঁচকে তুলতে পারেন। কিন্তু, এই ইনিংস ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ইনিংসের তালিকা করা অসম্ভব আসলে, অন্তত আমার জন্য তো বটেই! অনেকের মতে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আজকের অবস্থানের ভিত্তিপ্রস্তর ছিল, সেদিনের এই ইনিংস। তাই ‘ওডিয়াই’ না হলেও, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ওয়ানডে ইনিংসে নিশ্চয় চলে আসে এটা।    

নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাতে বাংলাদেশ পরাজয় এড়াতে পারলেই চলত, কিন্তু মাত্র ১৭২ রান তাঁড়া করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৫ রানেই খোঁয়া গেছে চার উইকেট! অধিনায়ক এক প্রান্তে আছেন বটে, তবে কতটা কী করতে পারবেন তাতে তিনি নিজেই সন্দিহান হয়তো! বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে, বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়ালো ৩৩ ওভারে ১৪১। ৬ উইকেট হাতে নিয়ে ৮৫ বলে করতে হবে ৮৫ রান! ৮৬ রানে গেল ষষ্ট উইকেট গেলে, তখনো ৫৫ দরকার ৫২ বলে। এক প্রান্তে তিনি তখন অবিচলতার প্রতিমূর্তি! কাভার আর মিড উইকেট দিয়ে ‘আকরাম স্পেশাল’ শটে, প্রায় মিলিয়ে যাওয়া স্বপ্নটাতে আবার রঙ দিয়েছেন তিনি।

শেষ পর্যন্ত বিজয়ের নোঙর ফেলে, ৯২ বলে অপরাজিত ৬৮ রানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বর্ণালী অধ্যায়ের প্রথম অভিযাত্রার কারিগর হয়েছিলেন তিনিই!  

 

৫.

এবার আসি, আমাদের আলোচ্যে। মুশফিকুর রহীমের সেদিনের ১৪৪ রানের ইনিংসটা কী বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ওয়ানডে ইনিংস? তর্ক হতে পারে, আলোচনা চলতে পারে, তবে তার আগে আমাদের এই আলোচনাটা শেষ হোক। কী বলেন?

মাত্রই দ্বিতীয় ওভারে নামতে হয়েছে তাঁকে, ১ রানে নেই ২ উইকেট, একটু পর হয়ে গেছে অনেকটা ৩ রানে ৩ উইকেট মতো! এমন পরিস্থিতি অনেকবার সামাল দিয়েছেন তিনি। বহুবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন, তামিম। সেই পরম নির্ভরতার সঙ্গী, ব্যথায় কাঁতরে মাঠ ছেড়েছেন। তাঁর নিজেরও অবস্থা সুবিধের না। পাঁজরের ব্যথাটা ভোগাচ্ছে খুব। দুবাইয়ের অসহনীয় গরম তো আছেই। শ্রীলংকার পেসাররাও ভালোই চেপে ধরেছেন। এমন এক অবস্থায় আনকোর এক সঙ্গীকে সাথে নিয়ে, লড়াইয়ের মঞ্চ সাজাতে হচ্ছে তাঁর। যেই মনে হচ্ছে সব নিয়ন্ত্রণে, ঠিক সেই অবস্থায় তাঁর থিতু হওয়া সঙ্গী আউট হয়ে গেলেন। একটু পর তাঁকে একে একে রেখে এলেন মাহমুদুল্লাহ, মোসাদ্দেক, মিরাজ ও অধিনায়ক মাশরাফিও। রুবেলও যখন ছেড়ে গেলেন সেঞ্চুরী হতে তখনো চার রান বাকী তাঁর! মুস্তাফিজকে সাথে নিয়ে তারপরও লড়াইটা চালিয়ে গেলেন তিনি। এক পর্যায়ে মুস্তাফিজও আউট হয়ে গেলেন। তখন তাঁর রান ১১২।

দেখলেন ইঞ্জুরড তামিম এক-হাতে ব্যাটিংয়ে নেমেছেন। তামিম কোনোমতে এক বল ঠেকালে, পরের ওভারে তিনি নিলেন ১ ছয় ও ২ চার-এ ১৫ রান, তারপর ৫, শেষ ওভারে আউট হওয়ার আগে আরো ২ ছয়-এ ১২; ১৫০ বলে ১৪৪ রান, ১১-চার আর ৪-ছয়! অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ এক ইনিংসের কারিগর যখন মাঠ ছাড়ছেন, প্রশ্ন যুগিয়ে দিয়েছেন- এটাই কী বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ওডিয়াই ইনিংস?

 

৬.

এটা সত্যি যে, এই ইনিংস প্রথম ইনিংসে ছিল। সুতরাং আশরাফুল-সাকিব বা তামিম-আকরাম খানের মতো তাঁকে রান তাঁড়া করার চাপ সামাল দিতে হয়নি। অন্যদিকে দুবাইয়ে উত্তপ্ত অবস্থা হলেও, তাঁকে মাহমুদুল্লাহর মতো দারুণ বোলিং আক্রমণের সামনে পড়তে হয়নি।

তারপরও কথা থেকে যায়। শ্রীলংকার বোলিং লাইনআপ-কে কী খুব একটা দূর্বল বলা যায়? মালিঙ্গা-পেরেরা-লাকমলরা কী ঠিকই চেপে ধরেননি? ধনাঞ্জয়া-দিলরুয়ানরা কী একদমই সমস্যায় ফেলেননি? আচ্ছা, সাকিব-তামিমদের কী এতটা চাপ সামাল দিতে হয়েছিল। এক-একজন আউট হচ্ছেন, আর মুশফিক জানেন- বাকী পথটা তাঁকে একাই পেরোতে হবে। তাঁর উপরই নির্ভর করছে সব, সাথে কেউ নেই, সামনেও নেই কেউ। লড়তে হবে একাই। অথচ তামিম-সাকিবদের অতটা চাপ নিশ্চয় সামাল দিতে হয়নি তখন! তাঁরা বড় ইনিংস খেলবেন জেনে খেলেননি, খেলতে খেলতেই হয়ে গেছে তা। আর এদিন মুশফিক জানতেন, তাঁকে বড় ইনিংস খেলতে হবে। দলের জন্য তাঁকে শেষ ওভার পর্যন্ত থাকতে হবে। উষ্ণ আবহাওয়া বা বুকের ব্যথা, সব সামলে তাঁর লক্ষ্যে তিনি অবিচল ছিলেন- সবটা জেনে ও বুঝে। এই ভীষণ চাপ সামাল দেয়া কী চাট্টিখানি কথা? এই মুশফিক-ই না কতবার এমন চাপে ভেঙে পড়েছেন?

হ্যাঁ, আকরাম খানও খুব চাপে ছিলেন। হয়তো মুশফিকের মতোই, অথবা খানিক কম কিংবা বেশী! তবে আকরাম খানকে দ্বিতীয় ওভার থেকে পঞ্চাশতম ওভার পর্যন্ত লড়াই চালাতে হয়নি। একটানা চাপ, এভাবে সামাল দিয়ে যেতে হয়নি।

 

৭.

যুক্তি-তর্ক অনেকভাবে টানা যায়, করা যায়। চাপ যেমন পরিমাপ করা যায় না, করতে চাওয়া অর্থহীন। ঠিক তেমনি এমন সব আলোচনার শেষ টেনে দেয়া যায় না, দেয়াটা অর্থহীন। আরো অনেকভাবে অনেক রঙে, এই আলোচনা ফিরে ফিরে আসবে। হয়তো এমনও অনেক ইনিংস রয়ে গেছে, যা এখানে বলা-ই হয়নি। এইভাবে তুলনায় যাওয়া কিছুটা বিপদজনক, তারপরও তুলনা করা একটা নেশার মতো। কার ফ্লিক সবচেয়ে বেশী আনন্দ দেয় আজহার উদ্দীন নাকি লক্ষণ? কোনটা সেরা- কপিলের ১৭৫ নাকি ভিভের ১৮৯? এই আলোচনা ভয়াবহ, বিপদজনক! খাঁজকাটা খাঁজকাটার মতো এর শেষ নেই, সমাপ্তি নেই।

শুরুতেই দৃষ্টিকোণ বা দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বলেছিলাম। সেই হিসেবে আমি আমার মতামত জানাতে পারি। আপনার বা অন্যদের অভিমত ভিন্ন হতে পারে। সেটা ভুল-ঠিকের ব্যাপার নয়, দেখার ভঙ্গী বা চিন্তার ভিন্নতা।

 

তো, আমার কাছে- মুশফিকের এই ১৪৪-টাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের এযাবৎকালের সেরা ওয়ানডে ইনিংস!

আপনার কাছে, কোনটা?