• ক্রিকেট

অবাক আক্রমণের একদিন

পোস্টটি ৩৯৬৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

পার্থের ঝকঝকে নীলাকাশ। রোদটাও হাসছে ঝলমলিয়ে। ঝড়ের কোনো পূর্ভাবাস তো দূরের, সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ডিসেম্বরের অস্ট্রেলিয়া। ছুটি উপভোগের জন্য পৃথিবীর হাতে গোণা সর্বোত্তম কয়েকটি জায়গার একটি। হাজার কুড়ি দর্শকের সমাগম ঘটেছে পার্থের ওয়াকায়। ফেনিয়ে উঠা বিয়ার মৌ মৌ করছে। কোরাস আর হর্ষধ্বনিতে এক অনন্য ক্রিকেট-পরিবেশ।

 

ফ্র্যাংক ওরেল ট্রফির দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় সকাল। স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া একদিন কুড়ি মিনিট ব্যাটিং করে স্কোরবোর্ডে জমা দিয়েছে ৩২৯ রান। এবার সফরকারী দলের ব্যাটিংয়ের পালা। উইন্ডিজ ড্রেসিংরুমে এক ভীতিজাগানিয়া পরিবেশ। আগের টেস্টের উভয় ইনিংসে ‘শূণ্য’ পাওয়া গর্ডন গ্রিনিজ বাদ পড়লে ইনিংস সূচনা করবেন কে? দুই মানবরুপী উন্মত্ত দানব লিলি-টমসনের চকচকে নতুন লাল গোলার সামনে সাধ করে পড়তে চায় না কেউই। শেষ পর্যন্ত ১১ নাম্বার ব্যাটসম্যান অসীম সাহসী ল্যান্স গিবস উঠে দাঁড়ালেন। ‘কেউ না গেলে আমিই করবো ওপেন।’

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো- বার্নার্ড জুলিয়ান যাবেন উদ্বোধনে। যিনি ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে খেলেছেন সাত বা আট নাম্বারে।

 

তা জুলিয়ানের সঙ্গী কে?

 

উইন্ডিজ দলপতি ক্লাইভ লয়েড যেনো এক ঘূর্ণিঝড় মুঠোবন্দী করে এনে, এই পার্থের ওয়াকায় তাঁকে ছেড়ে দিলেন মুঠো-মুক্ত করে। ঝলমলে রোদ আর উজ্জ্বল নীলাকাশের নীচে কোনো রকম পূর্ভাবাস ছাড়াই সেদিন তিনি এমন ঝড় তুললেন যে, লন্ডভন্ড-ছত্রখন্ড হয়ে গেল স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। তো সেই ঝড়ের নাম?

রয় ফ্রেডেরিকস!

 

২.

যদি বলা হয়- ডিসেম্বর, ১৯৭৫-এ কী কী ঘটেছিল?

উত্তর হবে এমন- টাইগার উডস জন্মেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল নির্বাচনে গাফ হুইথলাম-কে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন ম্যালকম ফ্রেসার। আর রয় ফ্রেডেরিকস ওয়াকার মাঠে অস্ট্রেলীয় বোলিং-কে স্রেফ কচুকাঁটা করেছিলেন।

 

রয় ফ্রেডেরিকসের ইনিংসটি সম্পর্কে লিন্ডসে হ্যাসেট বলেছিলেন “নিঃসন্দেহে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মাঠে খেলা সেরা ইনিংস এটাই।”

হ্যাসেটের কথামালা অনেকটা গুরুত্ব বহন করে বৈকি! ভদ্রলোক ব্র্যাডম্যানের সাথে খেলেছেন, সেই ‘ইনভিন্সিবল’ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ছিলেন, বহু বহু ইনিংস তাঁর চোখের সামনে শুরু আর শেষ হতে দেখেছেন। তো তিনি যখন বলছেন, এটাই তাদের মাঠে সেরা, দ্বিমত করবেন আপনি?

চ্যাপেল ভাইদের বড়জন, ইয়ান চ্যাপেল ছিলেন সে ম্যাচে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ স্কোরার, ১৫৬ রান এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকে। তিনি বলেছিলেন- “এটা ছিল অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। বল কোথায় বা ফিল্ডার কোন জায়গায় সেসব কিছুই তাঁর মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলছিল না। সে কেবল একটার পর একটা মেরেই যাচ্ছিল। হ্যাঁ অবশ্যই, এটার মতো এমন ধুন্ধুমার অবিশ্বাস্য ইনিংস আমি খুব একটা দেখিনি!”

বড় চ্যাপেলের অভিমতের বিপক্ষে ভিন্নমত আছে আপনার?

 

ফ্রেডেরিকস সেদিন এমন এক অবস্থায় ছিলেন, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার করণীয় ছিল শুধু দেখে যাওয়া এবং বাহবা দেওয়া!

 

৩.

পার্থের ঘরের ছেলে লিলি। ভরা যৌবন তাঁর। দৃপ্ত তারুণ্যের সবটুকু উজার করে দেন বোলিংয়ে এলে। তাঁর অমন আগ্রাসী আর খুনে বোলিংয়ে দর্শক আরো উন্মত্ত হয়ে উঠে। দর্শকের কোরাসে প্রমত্ত জোয়ার আসে লিলির রক্তে। ‘লিলি লিলি’ বা ‘কিল লিলি’ দর্শক-কোরাসে নেচে উঠেন লিলি। পায়ে পায়ে রান-আপ মেপে এমন জায়গা থেকে লক্ষ্য স্থির করেন, যেখান থেকে দৌঁড়ে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ওই লাল-গোলক ছুঁড়ে দিলে- তিন কাষ্ঠকাঠিকে আগলে রাখে মানুষটা তো বটেই, তাঁর পরের প্রজন্মও যেনো আর এ-মুখো না হয়!

আর আছেন টমসন। বোলার তো নন, যেনো খুনী। প্রত্যেকটা বল যেনো আঁচড় কেটে যাবে ব্যাটসম্যানের উরু-বুকে-নাকে। ঐ প্রলয়ংকারী টমসন ঝড়ের সম্মুখে যদি খানিকক্ষণও কেউ থাকে, তবে তাঁর শরীরে পড়ে যাবে নানা ক্ষত। আর নিজেকে বাঁচাতে চাইলে পালিয়ে বাঁচো প্যাভিলিয়নে।

 

লিলি-টমসন নামের এক জোড়া ভীষণ আতঙ্ক যখন দু’পাশ থেকে ধেঁয়ে আসেন বন্য হিংস্রতায়, তখন ব্যাটসম্যান আর যা-ই করুন, তাদের সম্মুখে প্রতি আক্রমণের কথা সুদূর সুখস্বপ্নেও কল্পনা করার কথা ভাবতে পারেন না। এক-একটি বল নাক বা বুক ঘেঁষে বেরিয়ে যায়, আর হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন ব্যাটসম্যান।

 

সেদিনের সকালটা কেমন যেন! ইনিংসের মাত্র দ্বিতীয় বল। ছোটোখাটো গড়নের ব্যাটসম্যানের খুলি-টা তাক করে এক বাউন্সার ছুঁড়লেন লিলি। আর সেটাই হুক করে দিলেন ফ্রেডেরিকস। ম্যাক্স ওয়াকার সীমানা-প্রান্তে ক্যাচের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দেখেন- বল তাঁকে ছাড়িয়ে হারিয়ে গেছে দর্শকের ভিড়ে। দ্বিতীয় বলেই ছয়! ফাজলামো পেয়েছো নাকি বাছা!

আরো ক্ষেপে উঠেন লিলি। একে একে ছুঁড়তে থাকেন তূণে সযতনে সাজিয়ে রাখা সমস্ত তীর। টমসনও বসে নেই অন্য প্রান্তে। একের পর এক গোলা ছুঁড়েই যাচ্ছেন। অথচ কি আশ্চর্য্য পাঁচ ফুট ছ’ ইঞ্চির ছোকরা-মানব, প্রায় প্রতিটি বলকেই দেখাচ্ছেন সীমানা দড়ির পথ।

 

লিলি-টমসনের ছ’ওভারে রান নেওয়া দূরে থাক, উইকেট আঁকড়ে থাকতে পারলেই বর্তে যান সবাই। আর রান যদি ১৫-২০ চলেই আসে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সেখানে সেদিন কী ঘটলো? এই ছ’ওভার থেকে এলো ৬০ রান! ওই বামন-দৈত্য বুঝি পণ করেছেন, চাবকে বলের ছাল নয় শুধু, লিলি-টমসনকেও দেখে নেবেন!

 

ফ্রেডেরিকসের তান্ডবে বিহ্বল দলপতি ছোটো চ্যাপেল বড় ভাইয়ের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেন, কথা বলেন সতীর্থদের সঙ্গেও। শুরু করেছি কী ব্যাটা! গৌরব আর অহংয়ের ধন, লিলি-টমসনের কোনো পাত্তা নেই! ঠাট্টা পেয়েছো! দাঁড়াও, ব্যবস্থা নিচ্ছি। আক্রমণে এলেন গিলমোর। কাজ হলো তাতে, স্লিপে ধরা পড়লেন জুলিয়ান।

১০ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে জমা পড়লো ৯১, জুলিয়ানকে খুঁইয়েই। আমাদের বীরপুরুষ ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছেন পঞ্চাশ, খেলেছেন ৩৩ বল।

 

 

৪.

সেসময় আজকের মতো র‍্যাংকিং পদ্ধতি ছিল না। ছিল না সেরা টেস্ট দলের স্বীকৃতি স্বরুপ ‘গদা’ উপহার দেওয়ার রীতিও। তারপরও টেস্ট সাম্রাজ্যের মুকুটহীন অধিপতি ছিল তখন অস্ট্রেলিয়াই। আগের শীতেই চিরপ্রতিদ্বন্ধি ইংল্যান্ডকে চূরমার করেছে তাঁরা। ছয় টেস্ট খেলতে আসা ক্যারিবিয়ান অতিথিদেরও প্রথম টেস্টে পরাজয় দিয়ে আতিথ্য সেধেছে। সেখানে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় সকালেই এমন ফ্রেডেরিকস-কান্ডে কিছুটা বিমূঢ় তো হয়েছিলই।

লাঞ্চ পর্যন্ত, ১৪ ওভারে ১৩০ রান উঠে গেল বোর্ডে। লরেন্স রো আর রয় ফ্রেডেরিকস বিন্দুমাত্র দয়া দাক্ষিণ্যও বুঝি দেখাবেন না স্বাগতিকদের!

বিরতির পরপর রো ফিরে গেলে, উইকেটে আসেন আরেক ক্ষুদ্রকায় আলভিন কালীচরণ। হুক-পুল-কাট যাঁর কাছে হাতের সামান্যতম সঞ্চালন মাত্র। দুই খর্বাকায় বাঁহাতির ব্যাটে চলছিল অস্ট্রেলীয় বোলারদের নির্মম ধোলাই। দুই ব্যাটসম্যানেরই হুক-পুলের সহজাত অভ্যাস থেকে ফায়দা তুলতে চেয়েও সুবিধে হলো না।

 

ফ্রেডেরিকস কাট-পুল আর ড্রাইভের সমন্বয়ে যেনো দর্শক-কূলকে তাঁর দিকে সম্মোহন করতে থাকেন অদ্ভুত এক মোহনীয় ভঙিমায়। পয়েন্টের আশ-পাশ দিয়ে বল ক্রমাগত ছুটে যাচ্ছে, ফিল্ডার নড়ারই সময় পাচ্ছেন না। ক্যারিবিয় সমুদ্র সৈকতের জাম্বুরা ক্রিকেটে খুব জনপ্রিয় এই শট- নট এ ম্যান মুভ শট। লোক না নড়া মার।

 

পেছন-পায়ে কষে চাবকে দিলেন আরো একবার। সেই সাথে পূর্ণ হয়ে গেলো তাঁর শতক। অনবদ্য বীর-রসে সিক্ত আর বাঁধনহারা মুক্ত আক্রমণের চোখ ধাঁধানো উন্মুক্ত উপস্থাপনায় যেনো দর্শক-সম্মুখে দৃশ্যায়িত। মাত্র ৭১টি বল খেলতে হয়েছে তাঁকে। এর আগে সিড গ্রেগরিরই শুধু এত (৬৭ বল) কম বলে সেঞ্চুরী ছিল! ওয়াকার অবারিত করতালি তাঁকে অভিনন্দিত করলো বহুক্ষণ!

  

দর্শক দল পালটে ফেলেছে বহু আগেই। সমর্থককূল তো আসলে ক্রিকেটেরই দর্শক। তাঁরা তো কেবল লিলির গোলা বা অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য দেখতেই মাঠে আসেননি, তাঁরা মাঠে এসেছেন ক্রিকেট দেখতে। সেই ক্রিকেটটা যখন নান্দনিক আগ্রাসনে এমন সর্বোচ্চ দর্শনীয় হয়ে ধরা দেয়- তখন মোহাবিষ্ট হয়ে তাঁরা তো দল পালটে ক্রিকেটের সমর্থনে গলা আর তালির তোড় মেলাতেই পারেন!

তেমনই এক করতালি হঠাৎ কানে কেমন যেনো ঠেকলো বড় চ্যাপেলের। সামান্য একটা চারের জন্য এত প্রলম্বিত করতালি কেনো? সচকিত হয়ে দেখে নেন চারপাশ। চোখ দেন স্কোরবোর্ডে। আরে, বলে কী! এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে দুইশো! ওভারের সংখ্যা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে ওভারের ঘরে লেখা- ২২! চক্ষু চড়কগাছ হলে যা হয়, হচ্ছেটা কী? সবাই কী পাগল হয়ে গেছে নাকি! টেস্ট ক্রিকেট খেলছি না আমরা! তামাশা পেয়েছো নাকি!

 

“আমি আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিলাম পুরো। কী বাবা, তোমরা রসিকতা পেয়েছো নাকি! টেস্ট ক্রিকেটে প্রায় ওভারপ্রতি ১০! হ্যাঁ, ৮ বলের ওভার ছিল এটা। তারপরও...।” স্মৃতিচারণায় কেমন যেনো ঘোর থেকে বলছিলেন অজি-গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল।

 

৫.

সেবার একদল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক টমসনের বলের গতি পরিমাপ করতে গিয়ে দেখেন- একটা বলের গতি প্রায় ৯৯.৬৮ মাইল প্রতি ঘন্টায়! মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম স্পেলে ৩ ওভারে ৩৩ রান দেওয়া, আর ইনিংস শেষে ১৭ ওভারে ১২৮ দেওয়া টমসনের কোন বল-টা সর্বোচ্চ গতি পেয়েছে তা বোঝার সাধ্য ছিল না কারও। সম্ভবত ফ্রেডেরিকসের ব্যাটই সবচেয়ে ভালো অনুমান করতে পেরেছিল আদতে কোন বল পেয়েছিল সবচেয়ে বেশী গতি! কিন্তু বোবা ব্যাটের সাধ্য কী আমাদের জানায় কোন বল-টা সর্বোচ্চ গতিময় ছিল!

 

সৃষ্টির উৎকর্ষে, নান্দনিকতার ঔজ্জ্বল্যে, অপরুপ বিভায় ভাস্বর ছিলেন সেদিনকার রয় ফ্রেডেরিকস। প্রতিপক্ষ-পরিবেশ বিবেচনায় আর ঔদ্ধত্যের অনন্যতায়, অবিশ্বাস্য এক প্রতিভার পদচারণা যেনো ছিল সেদিন ওয়াকার ২২ গজে।

 

অ্যাশলে ম্যালেট অফ স্পিনার ছিলেন সে ম্যাচে। বোলিং কার্ডে খানিক ভদ্রস্থ চেহারায় ছিলেন কেবল তিনিই।

“অবাক করা কান্ড হচ্ছে, আমরাও সবাই মিলে ইনিংসটা উপভোগ করছিলাম। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে ইনিংসটা টেকনিক্যালি বিশুদ্ধ বলা চলে না। আবার এমন কোনো দুঃসহ চাপের মুহূর্তেও তাঁকে খেলতে হয়নি। তারপরও দুঃসাহসিকতার ঔজ্জ্বল্যে এটা ছিল অসাধারণ এক ইনিংস। আমি তো বলবো- অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা সেরা ইনিংসগুলোর মধ্যে এটা থাকবে উপরের দিকেই।” বলছিলেন ক্রিকেট ছেড়ে লেখক বনে যাওয়া ম্যালেট।

 

৬.

ফিল্ডার ছড়িয়েও কোনো কূল কিনারা করা যায়নি। ফ্রেডেরিকস ঝড়টাকে ঠেকাতে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। স্পিনার এনেও সামাল দেয়া যায়নি ঝড়ের প্রবল ঝাপটা। বোলিং পরিবর্তনেও মেলেনি কোনো সমাধান।

থার্ডম্যানের দিকে কাট করার প্রবণতা দেখে একপর্যায়ে দু’দুটো ফিল্ডার সেট করা হলো সেখানটায়। কাজে দিল না তা-ও। ফ্রেডেরিকসের উপর এদিন কী ভর করেছিল কে জানে! যা ইচ্ছা তা করছিলেন যেনো!

 

দোর্দন্ড প্রতাপে দুনিয়া কাঁপানো অস্ট্রেলিয়া, প্রতিপক্ষকে শুরুতেই গিলে খেতে খুনে বোলার লেলিয়ে দেয়া অস্ট্রেলিয়া, আক্রমণকেই একমাত্র অব্যর্থ অস্ত্র মানা অস্ট্রেলিয়া এবার হাঁটলো পেছন পায়ে। রক্ষণাত্মক ফিল্ডিংয়ে সমাধান খুঁজলো অস্ট্রেলিয়া। ফিল্ডার ছড়িয়ে গেলেন, ম্যাক্স ওয়াকার, অ্যাশলে ম্যালেট বোলিংয়ে এলেন। তেমন লাভ হলো না।

 

শেষ পর্যন্ত প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত লিলির এক বলকে খুঁচিয়ে স্লিপে চ্যাপেলের হাতে ধরা পড়লেন ফ্রেডেরিকস। সাঙ্গ হলো অনিন্দ্য সুন্দর এক ধ্বংসযজ্ঞের আনন্দ-মচ্ছব।

২১২ মিনিটের প্রতিটি মিনিটকে রোমাঞ্চ-রঙে রাঙিয়ে, উপস্থিত দর্শকদের অন্যলোকের ক্রিকেট আস্বাদন করিয়ে, আমাদের আজকের ক্রিকেট-বীর, ক্রিকেট-পুরুষোত্তম যখন ফিরছেন, নামের পাশে লেখা হয়ে গেছে- ১৬৯ রান। ১৪৫ বলের ইনিংসে ছিল ২৭টি চার, আর ছয় সেই একটি-ই; হুক করে রানের খাতা খুলেছিলেন যেটিতে।

 

ফ্রেডেরিকস যখন ফিরছেন- ক্ষণজন্মা এক প্রতিভার অবিস্মরণীয় ইনিংসটিকে সম্মান জানাতে ওয়াকার গ্যালারীর বুক চিরে করতালির উচ্ছ্বসিত সমাহার। ভীতিকর বোলিং আক্রমণের দুঃসাহসী সংহারের রুপকারকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন না জানিয়ে উপায় কি!

 

পরিশিষ্ট :

উইন্ডিজের সেই দলটার লয়েডের নেতৃত্বে গড়ে উঠার সময় তখন। পরের দেড় দশক যে বিশ্বক্রিকেটে একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করলো ক্যারিবিয় ক্রিকেট, এই সফর ছিল সেই সময়ের বুনিয়াদ। ইয়ান চ্যাপেলই বলেছিলেন, “সিরিজ ৫-১ এ অস্ট্রেলিয়া জিতলেও, তা আসলে দু’দলের শক্তিমত্তা বোঝাচ্ছে না ঠিকভাবে।” বলাই বাহুল্য সেবারের উইন্ডিজের একমাত্র জয়টি ছিল ফ্রেডেরিকস বীরত্বে পরিপূর্ণ।

ফ্রেডেরিকসের আরো কীর্তি, লর্ডস-বার্মিংহ্যাম বা পোর্ট অব স্পেনের নিঃসীম সংযমে সাজানো ইনিংসগুলো আসেনি আলোচনায়। একটা ব্যাপার- পার্থের ১৬৯ এমনই ইনিংস যে, অন্য যেকোনো ইনিংসের আলোচনা কেমন শুকনো-খটখটে মনে হতে পারে। তবে আসল কারণ তা নয়।

১৯৪২ সালের ১১ই নভেম্বর, জন্মেছিলেন ভদ্রলোক। জন্মদিনের শুভ ক্ষণের সম্মানার্থে অন্য আলোচনা আজ বরং অনুল্লিখিত-ই রইলো। সে আলোচনা অন্য কোনো দিনের জন্য বরাদ্দ থাক।

 

শুভ জন্মদিন, জিনিয়াস!