• ফুটবল

দানি আলভেজ : শুভ জন্মদিন'এল পোকো'

পোস্টটি ৫৩১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০১৪ সাল। ভিয়ারিয়ালের মাঠে ওদের বিপক্ষে ম্যাচ খেলছে বার্সা। ম্যাচের ৭৫ তম মিনিটে কর্নারকিক নেওয়ার জন্যে এগিয়ে যান দানি আলভেজ। কর্নার নিতে গেলে এক সমর্থক বর্ণবাদের চরম রুপ প্রকাশ করলেন, তিনি আলভেজের সামনে কলা ছুড়ে মারেন। একজন দানি আলভেজ তাৎক্ষণিকভাবে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যে দারুণ এক জবাব দিলেন, তা মুহুর্তেই ট্রেন্ডে পরিণত হয় সারা বিশ্বে। কলাটি কুড়িয়ে নিয়ে, খেয়ে নেন পুরোটা, একটুও বাজে অভিব্যক্তি ছাড়াই। মাঠে বসা দর্শক কিংবা টিভি সেটের সামনে বসা কোটি দর্শকদের সামনে আলভেজ যে মুগ্ধতা ছড়ালেন, তা ঠিক ক'জন পারে!

আচ্ছা, ছাড়ুন। বলুন তো, আপনি আপনার বন্ধুর জন্যে সর্বোচ্চ কি করতে পারেন?? হয়তো বন্ধুর জন্যে মারামারি করতে পারেন কিংবা সর্বোচ্চ বন্ধুকে লাখখানিক টাকা ধার দিতে পারেন; কিন্তু আপনি কি বন্ধুর জন্যে নিজের যকৃতটুকু দান করতে পারবেন?? অসম্ভব! পৃথিবীতে এমন মানুষ হয়ত হ্যালির ধুমকেতুর মত খুঁজে পেতে পারেন, যে কিনা বন্ধুর জন্যে নিজের জীবনের এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকবে! অথচ একজন দানি আলভেজ তার সতীর্থ বন্ধুর জন্যে নিজের যকৃতের একটি অংশ দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! আবিদাল বলেন, "আমি যখন অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সে আমাকে তার লিভার দান করতে চেয়েছিল। যদিও তেমনটা করার কোনো প্রশ্নই ছিল না, কারণ সে নিজেও একজন পেশাদার ফুটবলার।"

এমন দু/এক ঘটনা দিয়ে হয়তো আলভেজ'কে ভালোবাসার কারণ বুঝানো সম্ভব না। একজন দানি আলভেজকে ভালোবাসার অসংখ্য কারণ রয়েছে। মানুষ'টার সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি হাসতে পারেন, সবাইকে হাসাতে পারেন, সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারেন। ড্রেসিংরুমে সবাইকে চাঙা রাখার কৌশল রসিকতাপ্রিয় দানি'র চেয়ে আর কেই বা বেশি জানে!

দানি'কে সবাই ডাকে "এল লোকো" নামে; যার অর্থ পাগল বা উন্মাদ! মানুষটা সারাদিন যেসব হাস্যরসাত্মক কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়, তাকে পাগল না ডেকে কিই বা আর ডাকা যায়!?

দেখুন লিখতে গিয়ে, কেবল মাঠের বাইরের আলাপে পড়ে আছি। আচ্ছা, মাঠের দানি আলভেজ কেমন!? বাহিয়া থেকে শুরু, এখন পিএসজি তে। ৩৫ বছর বয়সে এসেও একজন রাইটব্যাক দানি ইউরোপে নিজের প্রতাপ ধরে রেখেছে কেবল নিজের স্ট্রং মেন্টালিটি দিয়ে। যখনই সবাই ভেবে বসে এইতো বুঝি বয়সের ভারে আলভেজ নুয়ে গেছেন, ঠিক তখনই তিনি ফিরে আসেন নতুন করে, নতুন উদ্যামে, নতুন সুরে। আসবেনই বা কেনো, খারাপ সময় কে পিছনে ফেলে আলোর মুখ দেখা তো আলভেজের শৈশবের দীক্ষা! কনক্রিটের উপরে বিছানা বিছিয়ে শৈশবে বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে এখন তো তিনি ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ট্রফিধারী ফুটবলার!


বিশ্বের সর্বোচ্চ ট্রফিধারী ফুটবলার'টার যাত্রাটা ছিলো কস্টে, পরিশ্রমে, দুঃস্বপ্নের মত!

বাহিয়ার জুয়াজেইরো শহরের দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম আলভেজের। নিজের কিংবা আরো ৪ ভাই সহ পুরো পরিবারের দু'বেলা খাওয়ার জন্যে ছোট্ট থেকেই পরিশ্রম করতে হতো আলভেজ কে!

আলভেজ সহ বাকী চার ভাই কে নিয়ে ওর বাবা বিছানা পাততো কনক্রিটের উপরে। দৈনিক ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে ফসলের মাঠে বাবাকে সাহায্য করার জন্যে বেরিয়ে পড়তেন। বড় ভাই নাকি সে কে বেশী পরিশ্রমী এই নিয়ে দুই ভাই এর মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো, ওদের বাবা থাকতেন বিচারক। পুরস্কার হিসেবে কি থাকতো, জানেন?? আলভেজের বাড়িতে একটা মাত্র বাইসাইকেল ছিল। যেদিন যে জয়ী হতো, তার ভাগ্যে জুটতো স্কুল যাবার জন্য সাইকেল। আর অন্যজনকে সেদিন স্কুলে যেতে-আসতে হতো হেঁটে। কে জানে, এই প্রতিযোগিতার ছলেই হয়তো আরেকটু ভালো আয়ের ছল কষতেন ওদের বাবা!

এই অভাব আর কাজের মাঝেও আলভেজের ভালোবাসা ছিলো একটাই, ফুটবল। আলভেজের বাবাও ছোটতে ভালো ফুটবল খেলতেন, তবে অভাবের কারণে বেশিদুর এগুনো হয়নাই। ফুটবলের নিয়ে আলভেজের কারিকুরি দেখে ওর বাবা মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকেন ছেলেকে ফুটবলার বানানোর!

দানি আলভেজের যখন ১০ বছর বয়স, তখন ওর বাবা লোকাল একটা ক্লাব তৈরি করে, যার নাম দেয় পালমেইরাস দা সেলিটার! যেখানে আলভেজ'কে উইঙ্গার হিসেবে খেলান ওর বাবা। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন, আলভেজ গোল করতে কিংবা গোল করাতে ব্যার্থ হচ্ছেন। ঠিক সেই সময়ে ওর বাবা ওকে রাইটব্যাক পজিশনে খেলানো শুরু করে! লোকাল এই ক্লাবটির কোচ জোসে কার্লোস কুইরোজ ক্লাব ছেড়ে পাড়ি দেন বাহিয়ার একটি লোকাল ক্লাব'কে কোচিং করার উদ্দেশ্যে, তিনি ক্লাব ছাড়ার সময় আলভেজ'কে সঙ্গে করে নিয়ে যান। দুই বছর পর আলভেজ বাহিয়া'য় যোগ দেন, এবং যুবদলের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পান। বছরখানিক পর আলভেজ নিয়মিত ভালো খেলার সুবাদে বাহিয়ার মুল দলে সুযোগ পান। সে বছরই আলভেজ তার প্রোফেশনাল ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফির স্বাদ পান।


প্রথম ট্রফি থেকে শুরু করে আজ ৩৯ ট্রফির মালিক দানি আলভেজ'কে আর কখনো পিছে ফিরে তাকাতে হয়নাই!

বাহিয়ায় ভালো পারফরম্যান্স'র পুরস্কার স্বরুপ ডাক পেয়ে যান ব্রাজিল অ-২০ দলে, খেলেন ২০০৩ ফিফা যুব বিশ্বকাপে, যেখানে নিজেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার মঞ্চ খুঁজে পান আলভেজ! আলভেজ ভালো করেন ঐ টুনার্মেন্টে, ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন'ও হয়! সে বছরই আলভেজের ইউরোপে খেলার স্বপ্ন সত্য হয়! সেভিয়ায় সুযোগ পান দানি আলভেজ! সেভিয়ায় আলভেজের সময় যাচ্ছিলো স্বপ্নেত মতো, উয়েফা কাপে কোয়ালিফাই, টানা দুইবার উয়েফা কাপ জয়, কোপা দেল রে জয় আলভেজের রেপুটেশন কিংবা মার্কেট ভ্যালু সবকিছুকেই আরো উচ্চতায় নিয়ে যায়।

আলভেজ এরই মাঝে ব্রাজিল জাতীয় দলেও ডাক পেয়ে যান, ২০০৬ সালে। এরপরে দুঙ্গার ০৭ কোপার স্কোয়াডেও সুযোগ পান আলভেজ। অনবদ্য পারফরম্যান্সে নজর কাড়েন সবার, আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে হারানোর ম্যাচেও অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান।

এর মাঝে চেলসি বিড করে আলভেজের জন্যে, সেভিয়া যা রিজেক্ট করে দেয়।

২০০৮ সালে ঐ সময়ের রেকর্ড ৩০ মিলিয়িনের বিনিময়ে আলভেজ'কে দলে ভিড়ান ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা! এরপর যা, তা কেবলই ইতিহাস!

৬ লালীগা, ৩ উচল, ৪ কোপা দেল রে, ৪ স্প্যানিশ সুপার কাপ, ৩ উয়েফা সুপার কাপ, ৩ ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে গেছে আলভেজ কে ধরাছোঁয়ার বাইরে অনন্য উচ্চতায়!

এরপরে আলভেজ জুভেন্টাস কিংবা পিএসজিতে যেখানেই গেছেন, সফল হয়েছেন! দলের অপরিহার্য অংশ হিসেবে ট্রফি ক্যাবিনেটে অর্জন করেছেন একের পর এক ট্রফি!

ব্রাজিলের হয়েও পারফর্ম করে গেছেন, দলে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে গড়েছেন। তবুও একজন আলভেজকে নিয়ে সেলেসাও সমর্থকদের আফসোসের শেষ নেই! হয়তো তা সময়ের কিংবা ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাইটব্যাকের হাতে একটা বিশ্বকাপ না দেখা নিঃসন্দেহে আফসোসের!

মানুষ হিসেবে আলভেজ অসাধারণ! যখন যেখানে গিয়েছেন রসিকতায় মজিয়ে রেখেছেন সবাইকে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সবার প্রতি! খেলোয়াড়ি জীবনে ট্রফি জয়ের পরে সবচেয়ে বড় পাওয়া বোধহয় টিমমেট আর ভক্তদের ভালোবাসা জয় করা! আর আলভেজ তা করে গেছেন অবলীলায়!

ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে আলভেজ; খুব বেশিদিন হয়তো আর ইউরোপে দেখবোনা মানুষটাকে। প্রত্যাশা মানুষ'টা সুস্থ থাকুক, বিশ্বের যে প্রান্তেই যাক না কেনো আনন্দ আর উচ্ছাসে মাতিয়ে রাখুক চারপাশ!

আলভেজ'কে নিয়ে একটা অভিযোগ রয়ে গেছে, বার্সা তথা ক্লাবের আলভেজ'কে হলুদ জার্সিতে সেভাবে পাওয়া যায়নাই; এরপরেও পুরা বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটা সেলেসাও সমর্থকদের মনে একটা দুর্বলতা ছিলো আলভেজের প্রতি সবসময়; একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে এটুকু অর্জন করাই বা কম কিসে!!

সম্ভবত আসন্ন কোপা আমেরিকাই হলুদ জার্সিতে আলভেজের শেষ মিশন! ব্রাজিল দলে জায়গা হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেক আগেই, কিন্তু পারফরম্যান্স দিয়ে সেই জায়গা ফিরে পেয়েছেন আবারো! জীবনযুদ্ধে হার না মানা, দমে না যাওয়া আলভেজের কাছে আমাদের প্রত্যাশা করতে বাঁধা নেই! টিতে সহ পুরো ব্রাজিল দলের কোচিং স্টাফদের চাওয়া, সিনিয়র'রা যেনো অন্তত একটা ট্রফি জয় করে দল থেকে বিদায় নিতে পারেন; সেই চাওয়ার পালে আমিও হাওয়া দেই, প্রিয় আলভেজ কে আরেকটা ট্রফি হাতে জয়োৎসব রাঙ্গাতে দেখতে চাই!

মানুষ'কে ভালোবাসলে নাকি সৃষ্টিকর্তাও তাকে ভালোবাসেন। বন্ধুর জন্যে যে মানুষ'টা নিজের লিভার দিয়ে দিতে চায় তার ভিতরটা বোঝার জন্যে কি আরো কিছু প্রয়োজন হয়!?

হেই দানি, তুমি অসাধারণ! তুমি অনন্য!
শুভ জন্মদিন! ভালো থেকো, ভালো রেখো সবসময়!!