• ক্রিকেট

বিবশ রজনীর পর...

পোস্টটি ৩৯৮৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বৃষ্টি আসে, বৃষ্টি যায়। বিকেল প্রায় পৌনে চারটা। আগের দিন রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে পুরো চট্টগ্রাম ধুয়ে গেছে। বৃষ্টি ছিল আগের সপ্তাহেও। প্রথম সেমিফাইনালের সময়ই বাসার জন্য সন্ধ্যের নাস্তা আর বিস্কিট কিনতে গিয়ে দোকানের কর্মচারীর একটা কথা কানে লেগে থাকে- বাংলাদেশের বৃষ্টি ইংল্যান্ডে চলে গেছে বুঝি!

ছাতা আছে। তবে সে ছাতায় বৃষ্টি মোটেই পোষ মানে না। বাতাসের প্রাবল্যে অবাধ্য ঘোড়ার ন্যায় হাত থেকে ছুটে যেতে যায় ছাতা। আকাশ আবার মেঘলা হবে হবে করছে। কর্মক্ষেত্রের একজন ঈষৎ বিদ্রুপের সুরে বলে উঠেন- বুঝতে পারছি ঠিক পাঁচটায় বৃষ্টিটা আসবে। যাওয়ার সময় আসতে হবে তার।

বিষণ্ণ আকাশের দিকে আরেকবার তাকিয়ে খারাপ হয়ে যায় মনটা। আসলেই কি? নাকি ঘনঘোর বর্ষার মতো আনন্দদায়ক বর্ষণ-দর্শন আর হয় না? আষাড়ের মেঘগুলো জড়ো হয় আকাশে, এদিকে চকিতে ফাইনালের কথা মনে পড়লে, ফোন বের করে ক্রিকবাজ-এ চোখ বুলানো হয়। ব্যাটিং নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। ফেসবুকে ঢুঁ মারা হয়, চোখ রাখা হয় স্কোরেও, ক্রিকেটের গ্রুপগুলোতে অনুভূতি জানাতে ক’লাইন পান্ডিত্যও ঝাড়া হয়... আর চলে সময় ক্ষেপণ। ছুটির ঘন্টা পড়বে কবে? বাড়ি যাওয়া ঘটবে কবে? ফাইনাল চলে যাচ্ছে যে...!

 

বিকেল আর সন্ধ্যের মাঝামাঝি সময়টায় চটিটা গলিয়ে পা’য় ধরা হয় বাড়ির পথ। ভীষণ লম্বা জ্যাম। সমস্ত গাড়ি আর মানুষ বুঝি এই সময়টাতেই বসে ছিল বেরোবে বলে। প্রয়োজনের সময় মেলে না কিছুই। পাঠাও-সহজ কিছুই মেলে না সহজে। খানিকটা হেঁটে আর ছুটে, আর খানিকটা গাড়িতে চড়ে ফেরা শান্তির নীড়ে। ততক্ষণে ইংল্যান্ডের বোলিং শেষ। শুরু হয়ে গেছে ওয়েম্বেলির সবুজ মঞ্চে আরেক লড়াইও। ফেদেরার-জোকোভিচ। যেন শিল্প আর পাথরের লড়াই। শিল্পের দিকে ঝোঁকটা বা টান থাকলেও, পাথরকে অগ্রাহ্য বা অশ্রদ্ধা করার সুযোগ বা কারণ কোনোটাই নেই। জিততে জিততেও জেতা হলো না প্রথম সেট। দ্বিতীয় সেট সহজেই জয় ফেদেরারের। ওদিকে কি দারুণ আর রোমাঞ্চকর সূচনা লর্ডসের ফাইনালের দ্বিতীয় অংশের। ট্রেন্ট বোল্টের ইনসুইঙ্গিং ডেলিভারিতে প্রায় কুপোকাত জ্যাসন রয়। আম্পায়ারস কল বা ক’ইঞ্চির হেরফের-এ বাঁচোয়া। তাও বেশীক্ষণ থাকা গেল না। ম্যাট হেনরীর অনবদ্য সুইং, বলকে শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছেন বোঝায় যায়। ইচ্ছেমতো বলকে দোল খাওয়াচ্ছেন আর নাচাচ্ছেন ব্যাটসম্যানদের। নাচতে নাচতে বোধহয় কোমর ধরে এল ব্যাটসম্যানদের, ফেরেন একে একে প্যাভিলিয়নে। রয়, রুট, বেয়ারেস্টো, মরগান। টপ ফোর গন। তখনো একশো ছোঁয়নি স্কোরটা।

ইট’স কামিং হোম... সুরটা আবার বিদ্রুপ আর হাস্যরসে ভরে উঠবে?

 

বিদ্যুৎ আসে, বিদ্যুৎ যায়। বজ্রপাত হয়, চমকায় বিদ্যুৎ। বৃষ্টি আসে। বাড়ে, কমে। বাতাসও বাড়ে, আবার কমেও। সময় বয়ে চলে, কারেন্টের দেখা নেই। চারবছর পর পর আসে বিশ্বকাপ ফাইনাল, আর এই সময়ই বিদ্যুৎ চলে যায়! হায়, নিয়তি!

স্কোর বোর্ডে চোখ বুলানো আবার। জমে উঠে বাটলার-স্টোকস জুটি। ভাঙনও ধরে আবার। ভাঙা-গড়ার এই খেলাঘর, একবার এদিক হেলে তো আবার ওদিক। আধ মিনিটের মধ্যে বারকয়েক বিদ্যুৎ আসে আর যায়, যেন বাচ্চাদের মজার খেলা- সুইচ টিপো আর মজা নাও। এই আলো, এই আঁধার। তড়িৎ প্রকৌশলের ছাত্রের পান্ডিত্যে ঝাড়ার সুযোগ আবার, ভোল্টেজ ফ্ল্যাকচুয়েট করছে আসলে!

ম্যাচেও ভীষণ ফ্ল্যাকচুয়েশন। বোঝা যায় না ব্যাপারটা। চঞ্চল চৌধুরীকে দরকার ছিল, ‘বোঝো নাই ব্যাপারটা’ বলে বুঝিয়ে দিতেন হয়তো, নাকি বলেই মিলিয়ে যেতেন তিনি?

বিশ্বকাপ ফাইনালের অমরত্বের পথে হাঁটা অথবা কারেন্টের ঘন ঘন যাওয়া-আসা ভুলিয়ে দিয়েছে ফেদেরার-জোকোভিচ এর মধ্যকার শিল্প আর পাথরে দৈরথ। মনযোগের পুরোটা ঘিরে কেবল লর্ডস, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, স্টোকস, উইলিয়ামসন, বোল্ট। হিসেবও চলে নিয়মিত, লকি নেই, হ্যানরী নেই, তাহলে টার্গেট হবে নিশাম। স্লোয়ারে বাজিমাৎ নিশামের। বাজির ঘোড়ার আড়াই চালে ‘কিস্তিমাৎ’ প্রায় হয়েই যেত- ক্যাচটা যদি ছয় না হতো! স্টোকস এদিন স্ট্রোক করাবেন বুঝি? দমবন্ধ হয়ে আসে প্রায়! শ্বাস-প্রশ্বাস বোঝা যায় না খুব একটা। কি হচ্ছে, কি হবে, ঘটনার ঘনঘটা কেমন ঘোরগ্রস্থ করে ফেলে যেন!

 

স্পোর্টসম্যানশীপের চূড়ান্ত। ওভার থ্রোতে ‘চার’ পেয়েও মুষ্ঠিবদ্ধ উদযাপনের বদলে ‘সরি’ প্রদর্শন, আম্পায়ারের দিকে তেঁড়ে গিয়ে কৈফিয়তের পরিবর্তে মাথায় হাত!

কেন উইলিয়ামসন। স্যার ফ্র্যাংক ওরেলের সর্বোত্তম ক্রিকেট শিষ্য। সর্বোত্তম মন্ত্রে দীক্ষিত। চূড়ান্ত ভদ্রতার মোড়কে সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ক্রিকেট বা স্পোর্টসের এই আপ্তবাক্য- বিশ্বাসে, কাজে, কথায়, আচরণে, চলনে-বলনে বারবার প্রমাণ করেন উইলিয়ামসন। ইংল্যান্ডও প্রমাণ দেয়- হারজিৎ বড় নয়, বড় হচ্ছে স্পোর্টসম্যানশীপ। প্রমাণ রাখেন স্টোকসও। সেই মাথা গরম করা স্টোকস, সাকিবের স্যালুট পাওয়া স্টোকস, স্যামুয়েলসের স্যালুট নেওয়া স্টোকস।

সেই নন্দন কাননে চার ছয়ে নুয়ে পড়া স্টোকস, এখানে উঠে দাঁড়ান বাহবার করতালিতে। বিজয়ের ঔজ্জ্বল্যে যিনি আরো রঙিন হন খানিক বাদে।

 

ম্যাচ টাই। কেঁপে উঠেন ইয়ান স্মিথ। ইউ ক্যান নট রাইট স্ক্রিপ্ট লাইক দিজ! একদম সত্যি। নাসের হুসেইন-ইয়ান বিশপ উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টায়, কিন্তু ধরা পড়ে যান ঠিক। সময়ের ধারাপাত বর্ণনার শ্রেষ্ঠ কুশীলবেরাও সাধারণের মতো মন্ত্রমুগ্ধ, বিমোহিত, বিবশিত।

সুপার ওভার শুরু হতে না হতেই নেই কারেন্ট। অদ্ভুত নাটুকেপনা। বিষিয়ে উঠে মন, মেজাজ তিরিক্ষি হয়। ২০-২২ বছর পূর্বে ফিরে যাওয়া। স্কোর দেখে কি ‘ছাই’ বোঝা যায়? রেডিও শোনো তাহলে। শামীম আশরাফকে চেনা যায় সেখানেও, অন্যজন চেনা চেনা লাগে তবুও অচেনা রয়ে যান। সুপার ওভার শেষ হতে হতে আবার ফিরে আসা বর্তমানে। বিদ্যুৎ আসে আবার। নিউজিল্যান্ডের ‘এক’ ওভারের ইনিংস নিশামময়। গাপটিল, চুড়ান্ত ফ্লপ একজন। এক রান আউটের হিরো। শতকোটির আশায় জল ঢেলে দেওয়া মহা ভিলেন। আলতো টোকায় দুই রানের জন্য ছোটেন। কিন্তু দৌঁড় শেষ করা হয়ে উঠে না তাঁর। দৌঁড় শেষ হয় না বাটলারের, মরগানের, স্টোকসের। কে কোনদিকে ছুটছেন কেউ জানে না। কেউ জানে না আনন্দের সীমানা। উদযাপনের নেই কোনো বারণ মানা। বিপরীত শিবিরে তখন কেবলই কান্না, হতাশা, বিহ্ববলতা। গাপটিল একলা উঠতে পারেন না, টেনে তুলতে হয় তাঁকে। নিষ্পলক চেয়ে থাকেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম মস্তিষ্কের মালিক- কেন উইলিয়ামসন। আশ্চর্য্য শান্ত, অদ্ভুতুড়ে নির্লিপ্ত।

সম্ভবত বিশ্বক্রিকেটকে দেয়া নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার এই যে- তাঁরা একজন ‘কেন উইলিয়ামসন’ দিয়েছেন!   

 

১০০ ওভার শেষে টাই। ১ ওভারের ‘সুপার’ সংযুক্তি শেষেও তাই। নিয়মের কি নির্মম নিষ্ঠুরতা! একদল বিজয়ী, অন্যদল বিজিত?

ট্রফিটার সমান হক্বদার কি নয় উইলিয়ামসন আর তাঁর সতীর্থ বন্ধুরা? ইংল্যান্ডের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডও? অনিন্দ্য সুন্দর এক ম্যাচ উপহার দেয়ার পরও, অসম্ভব মোহগ্রস্থতার আনন্দ প্রদানের পরও, নিউজিল্যান্ড পায় না জয়ের মুকুট!

যদি বৃষ্টির জয় হতো? প্রবল বর্ষণে ভেসে যেত ম্যাচ? টানা ক’দিনের ঝড়ে ফাইনালটাই অনুষ্ঠিত না-হতে পারতো? তখন? ঘোষিত হতো যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন? ২০০২-এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো? জয়ের গৌরবে ধন্য হতো ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড, দুই দলই? না খেলেই?

অথচ এখন ১০২ ওভারের অমন অসম্ভব আবেশে অবশ করা ক্রিকেটানন্দ দেয়ারও নেই কোনো মূল্য?   

 

রাত বাড়ে (নাকি কমে?)। ঘড়ির সময় জানায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেক্ষণ। ঘনিয়ে আসছে ভোর। আঁধারের ঘনত্ব কমে আসতে দেরী নেই। ভোরে আবার কর্মময় সময়ের তাড়া। তবুও ঘুম আসে না চোখে। ইংলিশ ক্রিকেটে বহুদিনের অপ্রাপ্তি ঘুচার আনন্দ উদ্বেল করে। ব্যথিত করে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের বেদনাও। ক্রিকেট দর্শক হিসেবে আরাধ্য লালিত স্বপ্নের মতো এক ম্যাচ সত্যি হতে দেখা বিহ্বল করে, বিবশ করে। বয়সের ভারে ন্যুজ হওয়া এক বিকেলে, যদি ঘিরে বসে গল্প শুনতে আগ্রহী ছানাপোনার দল, এই ম্যাচটার গল্পের শেষে একটা বাক্য আসবেই।  

দ্যা গ্রেটেস্ট ফাইনাল অব অল। নিঃসন্দেহে।