• ক্রিকেট

সুপ্রিয়, আপনাকে বলছি-

পোস্টটি ৩৪৬২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সুপ্রিয়-

আমি জানি খুব একটা ভালো নেই আপনি। তাই ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নের ভণিতা রাখছি না। অথচ, জীবনটা এমন নাও হতে পারত আপনার। আজকের দিনে অসম্ভব ভালো থাকতে পারতেন আপনি। মিডিয়া পাড়া থেকে শুরু করে, আজকের দিনের আড্ডার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠা ফেসবুক গ্রুপগুলোতে আপনার স্তুতির বান ঢেকে যেতে পারত। আপনার জন্মদিন আসার মাসখানেক পূর্ব থেকে শুভেচ্ছো জানানোর প্রস্তুতি থাকতো অনেকের। লাইক/শেয়ার দিয়ে কেউ বড়লোক হয় না, তবে পরিচিতি মিলে প্রচুর। আহ্লাদী ভাষায় ‘ফেসবুক সেলিব্রেটি’ বলা হয় যাকে। সেই ফেসবুক সেলিব্রেটি হওয়ার অন্যতম উপায় হতে পারতেন আপনি। আপনার ছবি দিয়ে, দুই লাইনে জন্মদিনের শুভেচ্ছে। ব্যস! লাইক/লাভ/ওয়াওয়ের বন্য বইয়ে যেত না!

আপনাকে ওয়ালে টাঙিয়ে দারুণ ক্রিকেট বিশারদ বনে যেতেন অনেকে। দেশপ্রেমের গর্ব আর আবেগে কাঁপতেন কেউ কেউ, নিশিরাতে ট্রাক গেলে যেমন কেঁপে উঠে রাস্তার পাশের ভবনগুলো। আচমকা মর্ত্যে নেমে আসতেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। অথবা ব্র্যাডম্যানের জগৎ থেকেই চোখ কচলে জেগে উঠে বলতেন- আজ আবার মর্ত্যে কি হলো, সবাই আমাকে নিয়ে মাতলো কেনো! ওহ, আবার সেই ছোটখাটো পিচ্চিটা! সে আবার কি করলো? অ্যাঁ? কিছুই করেনি। কেবল জন্মদিন বলে!

 

সুপ্রিয় বঙ্গদেশীয় ব্র্যাডম্যান-

আপনাকে ঘিরে স্বপ্নের পালক যখন পাখনা মেলে উড়ছিল ক্রিকেটের অনিন্দ্য সুন্দর আকাশপানে, আমরা যখন সত্যিকার একজন ‘ক্ল্যাসিক ক্লাস’ এ বুঁদ, ছোটখাটো গড়নের আপনার সঙ্গে তুলনা টানি ক্রিকেটলোকের সব রথী-মহারথীদের। ঠিক সেইসময় অদ্ভুত বিষণ্ণতায় আপনার অধঃপতনের বিদগ্ধ সাক্ষী আমরা। রঙিন পোষাক থেকে আপনার ছিঁটকে পড়া, আর তারপর শ্বেতপোষাকের বনেদী আঙিনায় আপনার আভিজাত্যের সঙ্গে নির্মম প্রহসন। আপনাকে আট নাম্বারে ঠেলে দিয়ে চূড়ান্ত অপমান, আপনার ব্যাটসম্যানশীপের অসম্ভব অবহেলা, ভীষণ ব্যথাতুর হৃদয়ে অবলোকন করেছি আমরা। আপনাকে ঘিরে, আপনাকে নিয়ে সবসময় সোচ্চার থেকেছে আমাদের কন্ঠস্বর। আপনার প্রতিটি মোলায়েম কব্জীর ফ্লিকে, অলস সৌন্দর্য্যের অদ্ভুত মোহে মোহগ্রস্থ করা প্রতিটি আলতো কাটে, কবিতার মতো প্রতিটি কাভার ড্রাইভে, আমরা চিৎকার করেছি আপনার জন্য। আমরা সবসময় বলার চেষ্টা করেছি- আপনার সাথে কৃত অন্যায় ও পাপ, পুনর্বার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।

আমরা আমাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁসটার ‘স্বর্ণ ডিম’ চেয়েছি প্রতিদিন, তার পেট কেটে একত্রে সব ডিম প্রাপ্তির লোভ আমরা করিনি। আপনার খানিক নেতিয়ে পড়া, অল্প অল্প ঝিমানো, শিশুতোষ সব ভুলে চাদর পরিয়েছি, আপনার সাথে অযাচিত যত আচার ও ব্যবহার। আপনাকে আক্রান্ত হতে দিইনি, অন্তত যতটা পেরেছি আগলে রাখার চেষ্টা কম করিনি। শুধুমাত্র আপনাকে ঘিরে আমাদের আবেগ, ভালোবাসা ও প্রতিক্রিয়াশীলতায় বিরক্ত এক ভিনদেশী কোচ নির্ঘুম নিশিতে টুইট করেছিলেন-

একটি জাতির আবেগ নাকি টিম কম্বিনেশন। নির্ঘুম রাত!

 

সুপ্রিয় বাঁহাতি-

আপনার পরিশ্রম আর নিবেদন সম্পর্কে আমরা জানি। আপনার একাগ্রতা, মনোযোগ আর দৃঢ়তাও অজানা নেই। আপনার অধ্যাবসায় নিয়ে লেখা যায় আলাদা একটি আলেখ্য। তারপরও ক্রমাগত অবনমন কেন আপনার? আপনার সঙ্গে ব্যবহার ঠিক হয়নি, পরিচর্যাও যেভাবে দরকার ছিল সেভাবে পাননি হয়তো-বা; তারপরও থেকে যায় কথা। আপনাকে তো আমরা ‘অসাধারণ’ বলেই জানি। আপনার প্রতিভা যেমন অসাধারণ, আপনার অধ্যাবসায়-অনুশীলন, ও পরিশ্রমও তেমনি ‘অসাধারণ’ হবে বলেই বিশ্বাস করি। আপনার চিত্তের দৃঢ়তাও তেমনি অবচল হবে বলেই বিশ্বাস আমাদের। তাহলে সাধারণের মতো এমন নেতিয়ে পড়া কেনো? অসাধারণত্বের চাদর ফেলে সাধারণের কাতারে কেনো? আপনার বিনয়, মনুষত্ব্য ও আচরণ নিঃসন্দেহে অসাধারণ হয়েও সাধারণ। কিন্তু আপনার প্রতিভা-পরিশ্রম আর অনুশীলন-অধ্যাবসায় তো তেমন সাধারণ হতে পারে না। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, এক সিঁড়ি থেকে আরেক সিঁড়িতে উত্তরণে আরো নিশ্ছিদ্রতা ও অপরাজেয় মনোভাবের অভাব থাকবে কেনো?

এই পর্যায়ে এসে তীব্র অভিমান আর এক পাহাড় হতাশা নিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি- আপনি আমাদের হতাশ করেছেন। একইভাবে আমাদের আশন্বিতও করছেন আপনি। আপনাকে ঘিরে আমাদের আকাশ উচ্চতার স্বপ্নরেখা এখনো পাতালে নামেনি, শুধুমাত্র ব্যক্তিটি আপনি বলেই। পেঁছোতে পেঁছোতে পেঁছোবেন আর কত? এবার এগোন। দৃঢ়পণ হোক এমন- ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত আর পেঁছোবেন না আপনি। মায়ের মুখের হাসিটি মুছে যাবে না আর কখনোই। মায়ের জন্য খেলেন না আপনি, আপনার খেলাটা, আপনার ব্যাটিংটা মায়ের মুখের মধুর হাসির মতো হোক চিরঅম্লান।

 

সুপ্রিয় ক্ষুধে জিনিয়াস-

আপনাকে নিয়ে মানে ঠিক এমন সুনির্দিষ্ট দিনে আপনাকে নিয়ে লিখছি কত বছর পর জানেন?

পাক্কা তিন বছর।

তিন বছর আগের লেখাটার সময় কল্পনাও করিনি ‘আমাদের ব্র্যাডম্যান’ এমন ব্যাডপ্যাঁচ-এ পড়বেন? শুরুর তাক লাগানো গড়টা না থাকলেও তখনো পঞ্চাশোর্ধ্ব গড় ছিল, সুযোগ পেলে দেখিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা ছিল, বয়সে আরো নবীন ছিলেন, তাই অনেক ভুলও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল। কিন্তু এই সময় এসে যদি দেখতে হয়, ত্রিশের দোর থেকে খানিক দূরে দাঁড়ানো আপনি, এখনো ২৪-২৫ এর মতোই প্রলোভনে ভুলছেন, ভুগছেন শুরুর সেই দিনগুলোর মতো; তাহলে দুঃখবোধে আপনার প্রতি হতাশা জাগা অন্যায় কি?

বিশ্বাস করুন, আপনার মতো প্রতিভা খুব একটা আসেনি এদেশের ক্রিকেটে। পুল-ফ্লিক-কাটের এমন সহজাত ও সহজবোধ্যতা বিশ্বক্রিকেটেই যে বিরল। যে শিল্প বা আর্ট আয়ত্তে মানুষের পাড়ি দিতে হয় পরিশ্রমের কঠিন পথ, আপনার তা স্রষ্টাপ্রদত্ত। এই আশীর্বাদের সঙ্গে মননের দৃঢ়তা আর পরিশ্রমের অভিনবত্ব মিশিয়ে নিজেকে ‘অনন্য’ করে গড়ে তুলবেন না আপনি? বিশ্বক্রিকেট দেখবে না এক ক্ষুধে বঙ্গসন্তানের অবাক শিল্পোচ্ছ্বাস?

 

সুপ্রিয় শিল্পী-

ফিরে আসুন। প্রবল দাপট, দুর্দান্ত প্রতাপে। সুদীর্ঘ সমুদ্র বালুকাবেলার শহর কক্সবাজারে জন্ম আপনার। সেই কক্সবাজার সমগ্র বিশ্বে সমস্ত সাগরতীরের রাজা, সেই তীর ঘেরা শহরে জন্ম নেয়া আপনাকে ‘কিং অব কক্স’ বলাটা বাড়াবাড়ি হয় না হয়তো। আপনার ইদানীংকার অবনমনে যদিও উপাধিটা ‘বাহুল্য’ মনে হতে পারে।

তারপরও, হ্যাঁ তারপরও- জন্মদিনের এই লগ্নে আমাদের চাওয়া ক্রিকেট মাঠে আপনার প্রত্যাবর্তন। যেন তেন প্রত্যাবর্তন না, রাজার মতো প্রত্যাবর্তন। ‘কিং অব কক্স’ নামটার সার্থক রুপায়ন।

 

সুপ্রিয়-

শুভ জন্মদিন!